টেনিস কোর্টে কি সফল প্রত্যাবর্তন হবে বুশার্ডের। ফাইল ছবি
খ্যাতির বিড়ম্বনা সামলানো সহজ কথা নয়। হঠাৎ পাওয়া খ্যাতি এক লহমায় জীবন বদলে দিতে পারে। কেউ সেটা সামলে এগিয়ে যান। কেউ সামলাতে না পেরে পিছিয়ে পড়েন এবং কালের নিয়মে হারিয়ে যান। কানাডার খেলোয়াড় ইউজিনি বুশার্ড হয়তো হারিয়ে যাননি, কিন্তু পিছিয়ে যে পড়েছেন, তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। এবং তিনি সেটা স্বীকারও করেন। টেনিস সার্কিটে তাঁর উত্থান যতটা আকস্মিক, পতনও ততটাই দ্রুত হয়েছে। অনেক ঝড়ঝাপ্টা সামলে আবার কোর্টে ফেরার চেষ্টায় মগ্ন বুশার্ড। কিন্তু তাঁর সাম্প্রতিক মন্তব্য একটি প্রশ্ন তুলে দিয়েছে— আধুনিক সময়ে প্রত্যাশার চাপ সামলাতে পারা কতটা গুরুত্বপূর্ণ?
সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে বুশার্ড বলেছেন, “টেনিসে সাফল্যের সঙ্গে যে খ্যাতিও আসে সেটা আমি জানতাম। তবে আমার ধারণা, বেশিরভাগ খেলোয়াড়ই আগে থেকে সেটার জন্য প্রস্তুত থাকে না। আমিও ছিলাম না। আমরা সবাই একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে চলি। কিন্তু সেই লক্ষ্য পূরণ না হলে কী ভাবে পরিস্থিতি সামলাতে হবে সেটা কেউই বুঝতে পারি না।” বুশার্ড জনসমক্ষে খোলাখুলি এ কথা স্বীকার করলেও অতীতে অনেকেই তা পারেননি। রবিন সোডারলিং, ডেভিড নালবান্দিয়ান, ডেভিড ফেরার, নিকোলাই ডেভিডেঙ্কোরা প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও এক সময় হারিয়ে গিয়েছেন। সম্প্রতি মহিলা বিভাগে শীর্ষস্থানীয় খেলোয়াড় অ্যাশ বার্টিও অবসর নিয়েছেন। যিনি এর আগেও এক বার অবসাদে টেনিস খেলা ছেড়ে দিয়েছিলেন।
বুশার্ড এমন একটা পরিবার থেকে উঠে এসেছেন, যেখানে কেউ টেনিস খেলেননি। কিন্তু পরিবারের ইচ্ছায় পাঁচ বছর থেকেই টেনিসে হাতেখড়ি বুশার্ডের। ১২ বছর বয়সে ফ্লোরিডায় আসা এবং স্কুল স্তর থেকে টেনিস খেলতে খেলতে উত্থান। ২০১২-য় মাত্র ১৮ বছর বয়সে জীবনের অন্যতম বড় সাফল্য। জুনিয়র উইম্বলডনে চ্যাম্পিয়ন হন তিনি। ধীরে ধীরে বড়দের টেনিসেও ছাপ ফেলতে থাকেন।
সাফল্য আসতে বেশি সময় লাগেনি। দু’বছর পরেই প্রথম ডব্লিউটিএ খেতাব জেতেন। অস্ট্রেলিয়ান ওপেন এবং ফরাসি ওপেনের সেমিফাইনালে ওঠেন। উইম্বলডন ফাইনালে ওঠেন। কানাডার প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে সেই কৃতিত্ব অর্জন করেছিলেন বুশার্ড। তাঁর প্রতিভা এবং গ্ল্যামার নজর কেড়ে নেয় আপামর টেনিসবিশ্বের। তুলনা শুরু হয়ে যায় মারিয়া শারাপোভা, সেরেনা উইলিয়ামস এবং আরও অনেকের সঙ্গে। খ্যাতির প্রতিটা মুহূর্তই প্রাণভরে উপভোগ করছিলেন বুশার্ড। বুঝতেই পারেননি সামনে কী বিপদ আসতে চলেছে! বাড়িতে সে অর্থে টেনিসের চল না থাকায় তাঁকে যে কেউ পরামর্শ দেবেন, সেই উপায়ও ছিল না।
আচমকা পাওয়া খ্যাতি টেনিস থেকে একটু একটু করে বুশার্ডের নজর সরিয়ে দিচ্ছিল। পরপর কয়েকটি প্রতিযোগিতায় চূড়ান্ত ব্যর্থ হন। রাতারাতি তাঁর যে সমর্থককুল তৈরি হয়েছিল, আস্তে আস্তে তা দূরে সরতে থাকে। বুশার্ড বুঝতে পারছিলেন সেটা। নিজেকে খবরে রাখার জন্য তিনি অন্য পন্থা নেন। কখনও নিক কির্গিয়সকে ‘ডেট’ করছেন, কখনও সমুদ্রসৈকতে স্বল্পবসনা হয়ে ধরা দিচ্ছেন, কখনও আবার টুইটারে বাজি ধরে হেরে অচেনা কোনও সমর্থকের সঙ্গে ‘ডেট’-এ চলে যাচ্ছেন। শারাপোভা ডোপিং করে নির্বাসিত হওয়ার পর যখন কোর্টে ফিরলেন, তখন তাঁকে ‘প্রতারক’ বলতেও পিছপা হননি বুশার্ড। নিজেকে শিরোনামে রাখার জন্য যা যা দরকার তাই করছিলেন। কিন্তু সেই সবকিছুই যে তাঁকে টেনিস থেকে আরও দূরে সরিয়ে দিচ্ছে, সেটা সম্ভবত বুঝতে পারেননি। বুঝতে পারেননি, ‘ফোকাস’ নড়ে যাচ্ছে তাঁর।
বাংলা তথা ভারতের প্রাক্তন টেনিস খেলোয়াড় জয়দীপ মুখোপাধ্যায় অবশ্য অবাক নন। তাঁর কথায়, “বিদেশে এমন ঘটনা প্রায়ই দেখা যায়। ১৭-১৮ বছর বয়সে আচমকা বিখ্যাত হয়ে যায় ওরা। পরে সেটার সঙ্গে আর তাল রাখতে পারে না। ভারতীয় ক্রিকেটই দেখুন। এখন অনেকেই কম বয়সে কোটিপতি হয়ে যাচ্ছে। কয়েক বছর পরে তাদের আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। পেশাদার টেনিসে অনেক সময় একা একা বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় খেলতে হয়। এতে অনেক সময় মানসিক চাপ পড়ে। খেলাতেও সেটা প্রভাব ফেলে। নেয়োমি ওসাকাকেও দেখেছি প্রত্যাশার চাপ সামলাতে পারছে না। কিছুদিন আগে অ্যাশ বার্টি খেলা ছেড়ে দিল। ওরা কেউ কেউ মজা করে খেলাটা খেলে। তবে আমাদের দেশে সেই ঘটনা বেশি নেই। সানিয়া মির্জাকে দেখুন। অনায়াসে খেলে চলেছে।”
কী ভাবে এই বিষয়টা সামলানো যায়? জয়দীপ বললেন, “চাপ সামলাতে পারাটাই আসল ব্যাপার। আমাদের সময়ে নেটমাধ্যম, সংবাদমাধ্যমের এত দাপট ছিল না। ফলে এ ধরনের সমস্যায় পড়তে হয়নি। কিন্তু এখন খেলোয়াড়দের অনেক কিছু সামলাতে হয়। সব সময় মনোযোগ রাখা সম্ভব হয় না। টেনিসের সঙ্গে গ্ল্যামার থাকবেই। কিন্তু সেটাকে প্রয়োজনমতো এড়িয়েও যেতে হবে। সেরিনা উইলিয়ামস, রজার ফেডেরারদের মতো মনের জোর আমি বুশার্ডের মধ্যে দেখিনি। যদি সেই ইচ্ছেশক্তি থাকে, তা হলে কোর্টে নেমে আগের মতো সফল হতেও পারে।”
টেনিসভক্তরা বুশার্ডের সঙ্গে মিল খুঁজে পেতে পারেন আনা কুর্নিকোভার। রাশিয়ার প্রাক্তন খেলোয়াড়কে এক সময় ‘পরবর্তী স্টেফি গ্রাফ’ বলা হত। দু’বার অস্ট্রেলিয়ান ওপেন জিতেছেন। ফরাসি ওপেনের ফাইনালে উঠেছেন। নামের পাশে ১৬টি খেতাব রয়েছে। স্পেনীয় গায়ক এনরিকে ইগলেসিয়াসের সঙ্গে প্রেম করার পর থেকেই টেনিস কোর্ট থেকে মনোযোগ সরতে থাকে তাঁর। গ্ল্যামারদুনিয়া বেশি করে টানতে থাকে কুর্নিকোভাকে। এক সময় টেনিস ছেড়ে মডেলিংকেই পেশা হিসেবে বেছে নেন।
বুশার্ডও মডেলিং দুনিয়ায় নামার ইচ্ছে গোপন করেননি। কিন্তু এখনও পর্যন্ত সে দিকে কোনও রকম পদক্ষেপ করতে দেখা যায়নি তাঁকে। কোর্টে ‘প্রত্যাবর্তন’ পর সফল না হলে ভবিষ্যতে বুশার্ডকেও হয়তো কুর্নিকোভার রাস্তায় হাঁটতে দেখা যেতে পারে। তাঁকে তো ‘খবরে’ থাকতে হবে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy