স্মৃতি: নরেশ কুমারের বাড়িতে সস্ত্রীক ডেক্সটার। ফাইল চিত্র
নামটা বলতেই একটা ছবি ভেসে উঠছে তাঁর পরিচিত-ঘনিষ্ঠদের সামনে। দীর্ঘদেহি, সুদর্শন এক পুরুষ। যিনি রাজকীয় ভঙ্গিতে ক্রিকেটটা খেলেছেন এবং একই রকম দাপটে মাঠের বাইরের জীবনটাও কাটিয়েছেন। সাধে কী আর তাঁর নামের আগে জুড়ে গিয়েছিল ‘লর্ড’ তকমাটি।
সেই ‘লর্ড’ টেড ডেক্সটার চলে গেলেন চিরনিদ্রায়। ৮৬ বছর বয়সে, মধ্য ইংল্যান্ডের উলভারহ্যাম্পটনে বুধবার প্রয়াত হলেন ইংল্যান্ডের প্রাক্তন অধিনায়ক। যাঁর মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ে বৃহস্পতিবার। ক্রিকেটারের বাইরেও অবশ্য বেশ কয়েকটি পরিচয় আছে ডেক্সটারের। তিনি ছিলেন ইংল্যান্ডের জাতীয় নির্বাচক কমিটির চেয়ারম্যান, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পাইলট, দুর্দান্ত গল্ফার, সাংবাদিক! তালিকা শেষ হয়নি। আরও একটা পরিচয় আছে ডেক্সটারের। তিনি ছিলেন কলকাতার জামাইও!
স্বাধীনতার আগে, ১৯৩৮-৩৯ সালে বাংলা যাঁর নেতৃত্বে রঞ্জি ট্রফি জিতেছিল, সেই টম লংফিল্ডের মেয়েকে বিয়ে করেছিলেন ডেক্সটার। সুসান লংফিল্ড আবার আট বছর বয়স পর্যন্ত এই কলকাতাতেই বড় হয়েছেন। যে কারণে পঞ্চাশ বছরের বিবাহবার্ষিকী উদ্যাপনের সূচনা কলকাতা থেকে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ডেক্সটার দম্পতি। সেই সময় তাঁরা আতিথেয়তা গ্রহণ করেছিলেন ভারতের প্রাক্তন টেনিস তারকা নরেশ কুমারের।
এ দিন নরেশ কুমার বলছিলেন, ‘‘আমার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল টেড। প্রায় প্রতি বছরই দেখা হত। গরমের সময় ইংল্যান্ডে গিয়ে ওর আতিথেয়তা গ্রহণ করতাম। আবার শীতকালে অনেক বার টেড এখানে এসে থেকেছে।’’ ২০০৮ সালে ডেক্সটার দম্পতি কলকাতায় এসেছিলেন। পরের বছর ছিল তাঁদের পঞ্চাশতম বিবাহবার্ষিকী। নরেশ বলছিলেন, ‘‘টেডকে কলকাতার জামাই বলা যেতেই পারে। সুসান কলকাতায় জন্মেছিল। তাই চেয়েছিল ওই সময় এই শহরে আসতে।’’
কী রকম ক্রিকেটার ছিলেন ডেক্সটার? তাঁর পরিসংখ্যান বলছে, ৬২ টেস্টে ৪৫০২ রান, সর্বোচ্চ ২০৫। গড় ৪৭.৮৯। সেঞ্চুরি ন’টি, হাফসেঞ্চুরি ২৭টি। ৬৬টি উইকেটও ছিল। তবে শুধু শুষ্ক পরিসংখ্যানের বিচারে ডেক্সটারের মতো ক্রিকেটারকে যে মাপা যায় না, তা বলছিলেন ভারতের দুই প্রাক্তন ক্রিকেটার। নরি কন্ট্রাক্টর এবং চাঁদু বোর্ডে। ১৯৬১ সালে ইডেনে কন্ট্রাক্টরের নেতৃত্বে যে ইংল্যান্ড (এমসিসি) দলকে হারায় ভারত, তার অধিনায়ক ছিলেন ডেক্সটারই। আর সেই সিরিজে বোর্ডের ঘূর্ণির কাছে বারবার হার মেনেছিলেন তিনি।
দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর চোখে কী রকম ক্রিকেটার আর মানুষ ছিলেন প্রয়াত ইংল্যান্ড অধিনায়ক? কন্ট্রাক্টরের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে প্রথমেই তিনি বলে উঠলেন, ‘‘ভাবতেই পারছি না ডেক্সটার আর নেই। ও যে অসুস্থ, এ রকম কোনও খবরও তো পাইনি।’’ তার পরে বললেন, ‘‘ওর মতো জোরে শট নেওয়ার ক্ষমতা খুব কম ব্যাটসম্যানেরই ছিল। এক বার লর্ডসে খেলা হচ্ছে। আমরা লং অন আর লং অফ রেখেছি। কিন্তু ডেক্সটার এত জোরে স্ট্রেট ড্রাইভ মারছিল যে, বাউন্ডারি লাইনের ওই দুই ফিল্ডার নড়ার আগে বল চার হয়ে যাচ্ছিল।’’ টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে কি মানিয়ে নিতে পারতেন ডেক্সটার? প্রাক্তন ভারত অধিনায়কের জবাব, ‘‘অবশ্যই। টি-টোয়েন্টির আদর্শ ব্যাটসম্যান হত ডেক্সটার। একবার তো মেরে চার্লি গ্রিফিথের বলের সুতো খুলে দিয়েছিল। পাশাপাশি ভাল মিডিয়াম পেসারও ছিল।’’
এই ডেক্সটারের ইংল্যান্ডকেই তো ইডেনে হারিয়ে দিয়েছিলেন আপনারা? ৮৭ বছর বয়সি কন্ট্রাক্টারের স্মৃতিচারণ, ‘‘ডেক্সটার ওই সিরিজ়ে পাঁচশোর বেশি রান করেছিল। কিন্তু ওকে বারবার আউট করছিল বোর্ডে। ওই আমার তুরুপের তাস হয়ে উঠেছিল।’’ সেই ইডেন টেস্টে প্রথম ইনিংসে ৫৭ রান করে বোর্ডের বলে বোল্ড হয়ে যান ডেক্সটার। কন্ট্রাক্টর বলছিলেন, ‘‘মনে আছে, লেগস্টাম্পের উপরে সোজা ইয়র্কার ছিল। স্টাম্প উড়ে যায়।’’ ২০১২ সালে সিএবির আমন্ত্রণে আবার ইডেনে দেখা হয়েছিল দু’জনের। ওই সময় ডেক্সটার-পত্নী সেই ’৬১ সালের স্কোরবোর্ড দেখান কন্ট্রাক্টরকে।
আর সেই ইডেন টেস্টের নায়ক বোর্ডের কী মন্তব্য? পুণে থেকে ফোনে প্রাক্তন অলরাউন্ডার বলছিলেন, ‘‘আমি লেগস্পিনার ছিলাম। কিন্তু আমার গুগলি আর সোজা বলে বেশ কয়েক বার আউট হয়ে গিয়েছিল।’’ কী রকম ব্যাটসম্যান ছিলেন ডেক্সটার? বোর্ডের কথায়, ‘‘অত্যন্ত ভাল। তবে মাঠে ওর চালচলনের জন্য ওকে ‘লর্ড টেড’ বলতাম।’’
ডেক্সটার একবার বলেছিলেন, তাঁকে ঠাট্টা করেই ‘লর্ড’ বলা হত। সত্যিই কি দাম্ভিক ছিলেন? বন্ধু নরেশ কুমারের কথায়, ‘‘আদর্শ ভদ্রলোক ছিল। ভাল পাইলট ছিল। এক বার নিজের বিমান নিয়ে ইংল্যান্ড থেকে অস্ট্রেলিয়া উড়ে যায়।’’ কন্ট্রাক্টরের কথায়, ‘‘সবসময় হাসিখুশি থাকত। ও রকম বন্ধুত্বপূর্ণ অধিনায়ক হয় না।’’ ডেক্সটার রেখে গেলেন স্ত্রী, পুত্র এবং কন্যাকে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy