ইনজুরি টাইমের ইনজুরি টাইমে গোল। ইস্টবেঙ্গলের উচ্ছ্বাসের ভিড়ে রেফারিও। ছবি: উৎপল সরকার
এরিয়ান ১ (সাগর)
ইস্টবেঙ্গল ২ (অর্ণব, সুবোধ)
সাত-আট দশকে কলকাতা লিগে চালু ধারণা ছিল, বড় দল যতক্ষণ না জয়ের গোল পাবে, ততক্ষণ রেফারি খেলা চালিয়ে যাবেন!
তিন প্রধানের এ রকম বহু বিতর্কিত জয়ের পর ‘চিত্তর চিত্তচাঞ্চল্য ঘটল না’... ‘করুণার করুণায় জয়’ রেফারির নাম ধরে হেডিং হামেশাই হত আনন্দবাজারে।
২০১৪-এ ফুটবল বিজ্ঞানের চূড়ান্ত অগ্রগতির যুগে স্প্রে, স্টপওয়াচ, গোললাইন প্রযুক্তি, গোটা মাঠে টিভি ক্যামেরা যখন যে কোনও ম্যাচের সঙ্গী, তখনও যে তিন-চার দশক আগের পুরনো ছবি ময়দানে ফিরবে জানা ছিল না!
শনিবার ইনজুরি টাইমেরও ইনজুরি টাইমের সুযোগ নিয়ে ইস্টবেঙ্গল জেতার পর সেটা জানা গেল এবং প্রমাণিত হল, কলকাতা লিগে এখনও সেই ট্র্যাডিশন চলছে।
ঊনসত্তর মিনিট পর্যন্ত আর্মান্দোর টিম ০-১ পিছিয়ে। মনে হচ্ছিল সারদা-কান্ডের জেরে ক্লাবের গত কয়েক দিনের টালমাটাল পরিস্থিতির প্রভাব হয়তো পড়েছে মেহতাব-রবার্টদের উপরও। ভুলটা ভাঙল বিরতির অনেক পর। অর্ণব মণ্ডলের হেডে গোলের পর।
১-১। খেলা শেষ। প্রাক্তন ফিফা রেফারি মীনাংশু ভট্টাচার্য ছয় মিনিট ইনজুরি টাইম দিলেন। ৯৬ মিনিট হয়ে গেল, খেলা শেষের বাঁশি কিন্তু বাজল না। নাটকীয় পরিস্থিতিতে খেলা চলতেই থাকল। ৯৭ মিনিট শেষ। এর পরেই জয়ের গোল পেল ইস্টবেঙ্গল। সুবোধ কুমারের শট এরিয়ানের এক ডিফেন্ডারের গায়ে লেগে ২-১ হল। গ্যালারিতে কালো মুখ করে বসে থাকা লাল-হলুদ কর্তাদের মুখে ফুটল চওড়া হাসি। গ্যালারিতে জ্বলে উঠল কাগজের মশাল। খেলা শেষের বাঁশিও বেজে গেল। আর সাংবাদিক সম্মেলনে এসে সাতের দশকের ছোট দলের কোচেদের মতো ‘কাঁদলেন’ ময়দানি ফুটবলের অন্যতম সফল কোচ রঘু নন্দীর ছেলে রাজদীপ নন্দী। অনেক ছোট ছেলে। তাই বাবার মতো বিস্ফোরণ ঘটেনি তাঁর কথায়। শুধু বললেন, “আপনারাই বিচার করবেন ইনজুরি টাইম শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও কেন রেফারি খেলা চালিয়ে গেলেন! বাড়ি গিয়ে বাবার কাছে খোঁজ নেব ইনজুরি টাইমেরও ইনজুরি টাইম হয়, কখনও দেখেছে কি না।”
রেফারিদের বাইবেল ‘লজ অব দ্য গেম’ বলছে, ‘ইনজুরি টাইমের পরেও রেফারি খেলা চালিয়ে যাবেন কি না, সেটা একেবারেই তাঁর সিদ্ধান্তের উপর নির্ভরশীল।’ এই আইনকে ঢাল করে মীনাংশু হয়তো নানা যুক্তি সাজাবেন, তাতে কলঙ্ক কিন্তু ঘুচবে না।
ম্যাচের শেষে ডেনসন দেবদাসের মতো র্যান্টি-দীপকরা গিয়ে মীনাংশুকে ‘চুমু’ খাননি, জিতিয়ে দেওয়ার জন্য। যা চার বছর আগে করেছিলেন তৎকালীন চিরাগ ইউনাইটেড মিডিও দেবদাস। তবে সেটা আসলে ছিল রাগ দেখানোর ‘চুমু’! মোহনবাগানকে পেনাল্টি দিয়ে রেফারি জিতিয়ে দেওয়ায়। মীনাংশুকে ‘আদরের’ জন্য সে বার দক্ষিণী ফুটবলারকে সাসপেন্ডও করেছিল আইএফএ।
রেফারির সৌজন্যে জিতলেও ইস্টবেঙ্গলের এ দিনের পারফরম্যান্সকে খাটো করে দেখার কোনও কারণ নেই। বরং হ্যান্ডশেক দূরত্ব থেকে যে ভাবে ‘গোলমেশিন’ র্যান্টি মার্টিন্স গোল নষ্ট করলেন সেটা গোয়ান কোচের কপালে ভাজ ফেলতেই পারে। চিন্তা বাড়াতে পারে শুরুতেই রক্ষণের দোষে গোল হজম করার জন্য। তাও আর্মান্দো খেলার পর গুণগানই করলেন ফুটবলারদের। “যে ভাবে এক গোলে পিছিয়ে পড়েও ছেলেরা দু’গোল দিয়েছে তাতে আমি খুশি।”
বাবা রঘু ছোট দলের বড় কোচ। বহু অঘটন ঘটিয়েছেন ময়দানে। মা রত্না নন্দী মেয়েদের কোচ ছিলেন। এখন মেয়েদের একটা ক্লাবও চালান। এই আবহে বেড়ে ওঠা ময়দানের তরুণতম কোচ রাজদীপের স্ট্র্যাটেজি ছিল রঘুর ফর্মুলা মেনেই। সামনে একজন বিদেশি। রক্ষণে সাত জনের লক গেট। মাঝমাঠে বিপক্ষের সেরা অস্ত্রদের মার্কিং করে বোতলবন্দি করে দেওয়া। বিপক্ষের ৫-৪-১ স্ট্র্যাটেজি ভাঙার জন্য আর্মান্দোর টিম সময় নিল বিরতির পর আরও মিনিট কুড়ি। কারণ ইস্টবেঙ্গলের এই টিমটা প্রচুর পাস খেললেও পেনিট্রেটিং জোনে চূড়ান্ত ব্যর্থ। র্যান্টির সঙ্গে ডুডু এসে যোগ দিলে হয়তো এই ছবি বদলাবে, কিন্তু সেটা কবে কে জানে! ক্লাবের যা ডামাডোল অবস্থা!
গোল হচ্ছে না দেখে নিউজিল্যান্ডের বিশ্বকাপার লিও বার্তোসকে নামিয়ে দিলেন লাল-হলুদ কোচ। মেহতাবকে বসিয়ে। মহম্মদ রফিককে নামিয়ে আর্মান্দো চলে গেলেন ৪-৩-৩ ফর্মেশনে। এর পরই সমতায় ফিরল ইস্টবেঙ্গল। গোলের পিছনে অবশ্য নবাগত বার্তোসের কোনও কৃতিত্ব ছিল না। কিন্তু প্রথম দেখায় বার্তোসকে খারাপ লাগেনি। অনেকটা সেই অ্যালান গাওয়ের মতো টাচ। বল ধরা-ছাড়া চোখ টানে। কিন্তু পুরো ম্যাচ ফিট নন। কড়া ট্যাকলের সামনে অবশ্য জড়সড় দেখাল বছর বত্রিশের বিদেশিকে। এক সপ্তাহ পরেই ডার্বিতে তিনি কতটা কার্যকর হবেন সেটা সময়ই বলবে। তবে বাড়িতে বসে খেলা দেখার সময় বাগান টিডি সুভাষ ভৌমিক তাঁর নোটবইয়ে বার্তোসের জন্য কড়া ট্যাকলের ফুটবলার রাখার কথা নিশ্চয়ই লিখে রেখেছেন এ দিনই।
ক্লাবের শীর্ষকর্তার গ্রেফতারের পর মাঠের বাইরে নানা সমস্যায় জেরবার ক্লাব। আর্মান্দোর দল এই অবস্থার মধ্যেই তিন পয়েন্ট নিয়ে লড়াইয়ে থাকল কলকাতা লিগে। ডার্বির আগে ইস্টবেঙ্গল তাঁবুতে যতই অন্ধকার থাকুক, লাল-হলুদ ড্রেসিংরুমে কিন্তু জ্বলে থাকল আলোই।
ইস্টবেঙ্গল: অভিজিৎ, দীপক, অণর্ব, গুরবিন্দর, রবার্ট, মেহতাব (বার্তোস), তুলুঙ্গা (রফিক), লোবো (সুবোধ), জোয়াকিম, র্যান্টি, বলজিৎ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy