উৎসব: পেনাল্টি থেকে ইস্টবেঙ্গলকে এগিয়ে দিয়ে সতীর্থের কোলেই উঠে পড়লেন কোলাদো। বৃহস্পতিবার। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক
খেলা শুরুর ঠিক মিনিট দশেক আগেই ঝমঝম করে বৃষ্টি নেমেছিল যুবভারতীতে। যা দেখে মুখ শুকনো করে প্রেসবক্স লাগোয়া দর্শকাসনে বসা এক লাল-হলুদ সমর্থক প্রমাদ গুনে বলছিলেন, ‘‘রেনবো আর মোহনবাগান ম্যাচ বাদে এ বারের কলকাতা লিগে আমাদের সব খেলাতেই বৃষ্টি হল। দেখা যাক ৯০ মিনিট পরে আমাদের ভাগ্যে কী লেখা থাকে! গত বার কলকাতা লিগে এ রকম বৃষ্টিভেজা মহমেডান ম্যাচ কিন্তু আমাদের হারতে হয়েছিল!’’
নব্বই মিনিট পরে মহমেডানকে ৩-২ হারিয়ে যখন ইস্টবেঙ্গল কোচ আলেসান্দ্রো মেনেন্দেস সাংবাদিক সম্মেলনে এলেন, তখন তাঁর মুখে স্বস্তির হাসি। লিগ জয়ের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়ে তিনি ইঙ্গিতপূর্ণ ভাবে বলে দিলেন, ‘‘দেখুন না শেষ পর্যন্ত কী হয়!’’
যা শুনে বাইপাসের ধারে কালিকাপুরের বাড়িতে বসে হেসে ওঠেন পিয়ারলেস অধিনায়ক আনসুমানা ক্রোমা। আত্মবিশ্বাসী সুরে তিনি বলেন, ‘‘মহমেডান আর লিগ পাচ্ছে না এ বার। শুক্রবার আগে রেনবোকে বড় ব্যবধানে হারাতে হবে আমাদের। তার পরে জর্জ টেলিগ্রাফকে হারালেই এ বারের কলকাতা লিগ জিতবে পিয়ারলেস।’’
লিগ জয়ের কাছাকাছি এসেও তা ছুঁতে না পারার বেদনা তখন মহমেডান শিবিরে। সত্যম শর্মা, তীর্থঙ্কর সরকাররা খেলা শেষে স্টেডিয়াম ছাড়ছিলেন হতাশ মুখে। তাঁদের টেকনিক্যাল ডিরেক্টর দীপেন্দু বিশ্বাস বড় ম্যাচে ইস্টবেঙ্গলের কাছে হারের জন্য ততক্ষণে কাঠগড়ায় তুলে দিয়েছেন রেফারিকে। দীপেন্দুর কথায়, ‘‘রেফারি প্রথমার্ধের শেষ দিকে বক্সের মধ্যে হাতে বল লাগানোয় প্রথমে সইফুলকে লাল কার্ড দেখালেন। তার পরে আমাদের বিরুদ্ধে পেনাল্টি দিয়ে লড়াইটাই শেষ করে দিলেন। ওটাই ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দিল।’’
সব মিলিয়ে লিগের লড়াই আপাতত জমজমাট। এ দিন দ্বিতীয়ার্ধে উজ্জীবিত ফুটবল খেলেও হারের পরে ১১ ম্যাচে ১৯ পয়েন্ট নিয়ে খেতাবের স্বপ্নভঙ্গ মহমেডানে। ১০ ম্যাচে ২০ পয়েন্ট নিয়ে এই মুহূর্তে লিগ শীর্ষে ইস্টবেঙ্গল। অন্য দিকে, ৯ ম্যাচে ১৭ পয়েন্ট নিয়ে তৃতীয় পিয়ারলেস। শেষ দুই ম্যাচ জিতলে ছয় দশক পরে তিন প্রধানের বাইরে কলকাতা লিগ জিতবে তারাই। আর যদি পিয়ারলেস এই দুই ম্যাচে পয়েন্ট নষ্ট করে, তা হলে শেষ ম্যাচে কাস্টমসকে হারালেই শতবর্ষে কলকাতা লিগ ঢুকবে লাল-হলুদ শিবিরে। কলকাতায় কোচিং করাতে এসে প্রথম কোনও ট্রফি জিতবেন ইস্টবেঙ্গল কোচ আলেসান্দ্রো মেনেন্দেস। লাল-হলুদের এই স্পেনীয় কোচ এ বারের লিগে প্রায় প্রতি ম্যাচেই প্রথম দলে একাধিক রদবদল করেছেন। আগের ম্যাচে রেনবোর বিরুদ্ধে খেলা প্রথম একাদশের পাঁচজনকে বদলে দিয়েছিলেন এ দিন। দলে রাখেননি কাশিম আইদারাকেও। বদলে বোরখা গোমেস পেরেসকে স্টপারে নিয়ে এসে রক্ষণকে পোক্ত করেছিলেন। অভিজ্ঞ আলেসান্দ্রো বুঝেছিলেন বিপক্ষ দ্বিতীয়ার্ধে মরিয়া হয়ে আক্রমণ করবে। তাই প্রথম থেকেই মহমেডানকে চাপে রাখার জন্য আক্রমণে তিনি রেখে দিয়েছিলেন খাইমে সান্তোস কোলাদো ও হোয়ান মেরা গঞ্জালেসকে। মাঝমাঠে লালরিনডিকা রালতে ও তনদোম্বা নওরেমের উপর দায়িত্ব ছিল আক্রমণে বল জোগানো ও মাঝমাঠে বিপক্ষের ছন্দ নষ্ট করে বল কেড়ে নেওয়া। সেই কাজে একশো শতাংশ সফল এ দিন
ইস্টবেঙ্গল মাঝমাঠ।
অন্য দিকে মহমেডান টিডি দীপেন্দু বিশ্বাস প্রথম চমকটি দিয়েছিলেন তাঁর গেম মেকার তীর্থঙ্কর সরকারকে ডান প্রান্তে নামিয়ে। কিন্তু এই ম্যাচের আগে লিগে ছয় গোল করা আর্থারকে রেখে দিয়েছিলেন দ্বিতীয়ার্ধে বিপক্ষকে চাপে ফেলার জন্য। এতে অনেকটা চাপমুক্ত ছিল ইস্টবেঙ্গল রক্ষণ। তীর্থঙ্করের জন্য ইস্টবেঙ্গল কোচ পেতে রেখেছিলেন ‘ডাবল কভারিং’-এর ফাঁদ। তীর্থঙ্কর তাই গোটা প্রথমার্ধ ও দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতে বল নিয়ে সক্রিয় হতে পারেননি। ইস্টবেঙ্গলের একজনকে কাটিয়ে এগোতে গেলেই তাঁর সামনে হাজির হয়ে যাচ্ছিলেন আরও এক জন লাল-হলুদ জার্সিধারী। ফলে জন চিডিরা বল পাচ্ছিলেন না।
তার উপরে বড় ম্যাচে ১২ মিনিটেই পিন্টু মাহাতোর দুরন্ত গোলে এগিয়ে গিয়ে আত্মবিশ্বাসও বেড়ে গিয়েছিল লাল-হলুদ শিবিরের। পরিকল্পনামাফিক আক্রমণে মহমেডান মাঝমাঠ থেকে কোলাদোর বাড়ানো বল ধরে ডানপ্রান্ত ধরে ওভারল্যাপে উঠে এসেছিলেন ইস্টবেঙ্গল রাইটব্যাক কমলপ্রীত সিংহ। তার ক্রস থেকেই দুরন্ত হেডে গোল করে যান অরক্ষিত অবস্থায় থাকা পিন্টু।
এই গোলের ১২ মিনিট পরেই সমতা ফেরায় মহমেডান। ইস্টবেঙ্গল বক্সের বাইরে বল হাতে লেগেছিল তনদোম্বা নওরেমের। রেফারি ফাউল দিলে ফ্রি-কিক নিয়েছিলেন মহমেডানের করিম ওমালোজা। কিন্তু সেই বল হেড দিয়ে বিপন্মুক্ত করতে গিয়ে নিজের গোলেই ঢুকিয়ে দেন ইস্টবেঙ্গল স্টপার বোরখা গোমেস পেরেস। রেফারি যদিও গোল দেন করিমকেই। গোলের পরেই হাঁটুতে চোট পেয়ে বোরখা বেরিয়ে গেলে তাঁর জায়গায় নামানো হয় আসির আখতারকে। তিনিও নিরাশ করেননি।
৪৩ মিনিটে লালরিনডিকার কর্নার থেকে হেডে গোল করে ফেলেছিলেন কোলাদো। কিন্তু সেই বলে হাত ছুঁইয়ে ফেলেন মহমেডানের সইফুল। কিন্তু রেফারি ক্রিস্টাল জন পেনাল্টি দেওয়ার পাশাপাশি সইফুলকে লাল কার্ড দেখিয়ে দশ জন করে দেন মহমেডানকে। পেনাল্টি থেকে ফের ইস্টবেঙ্গলকে এগিয়ে দেন কোলাদো। পেনাল্টির সিদ্ধান্ত নিয়ে খুশি নয় সাদা-কালো শিবির। তাঁদের দাবি, সইফুল নাকি বলে হাত লাগিয়েছিলেন গোলে ঢুকে যাওয়ার পরে। তাই লাল কার্ড নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন তাঁরা। ১-২ পিছিয়ে থেকে দ্বিতীয়ার্ধে রণনীতি পরিবর্তন আনেন দীপেন্দু। তীর্থঙ্করকে মহমেডান রক্ষণের আগে নামিয়ে আনা হয়। এতেই খেলায় ফেরে মহমেডান। কিন্তু ৫৯ মিনিটে খেলার গতির বিরুদ্ধে ইস্টবেঙ্গলের বাঁ দিক থেকে ডিকার বাড়ানো বলে পা ছুঁইয়ে ৩-১ করেন মার্কোস। এর পরেই আর্থারকে নামিয়ে শেষ চেষ্টা করেছিলেন দীপেন্দু। কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। তা সত্ত্বেও ৮৩ মিনিটে তীর্থঙ্করের বাড়ানো বল ধরে ডান পায়ের জোরালো শটে ৩-২ করেন আর্থারই। এই গোলের আগে একা ইস্টবেঙ্গল গোলরক্ষককে সামনে পেয়ে তার হাতে মারেন তিনি। শেষ মুহূর্তে আর্থারের শট ক্রসপিসে লেগে ফিরে আসে। না হলে ম্যাচের ফল অন্যরকম হতে পারত।
ইস্টবেঙ্গল: লালথুয়াম্মাউইয়া রালতে, কমলপ্রীত সিংহ, মেহতাব সিংহ, বোরখা গোমেস পেরেস (আসির আখতার), অভিষেক আম্বেকর, লালরিনডিকা রালতে, তনদোম্বা নওরেম, পিন্টু মাহাতো (মার্কোস এস্পারা মার্তিন), খাইমে সান্তোস কোলাদো (বৈথাং হাওকিপ), হোয়ান মেরা গঞ্জালেস, রোনাল্ডো অলিভিয়েরা।
মহমেডান: প্রিয়ন্ত সিংহ, সুজিত সাধু, প্রসেনজিৎ পাল, করিম ওমালোজা, সইফুল রহমান, মুসা মুদ্দে (আর্থার কউয়াসি), ফিরোজ আলি (শামসাদ আলি), তীর্থঙ্কর সরকার, সত্যম শর্মা, ভানলাল ছাংতে, জন চিডি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy