চিঠি, পাল্টা চিঠির মাঝে ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের কর্তা দেবব্রত সরকার চুক্তি বিতর্ক নিয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিলেন।
ইস্টবেঙ্গল ক্লাব ও তাদের বিনিয়োগকারী সংস্থা শ্রী সিমেন্টের মধ্যে বিবাদ মেটার কোনও লক্ষ্মণ নেই। বরং তা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। চিঠি, পাল্টা চিঠির মাঝে শুক্রবার ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের কর্তা দেবব্রত সরকার চুক্তি বিতর্ক নিয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিলেন। এখনই আদালতের দ্বারস্থ হতে চাইছেন না তিনি। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর কাছে তাঁর অনুরোধ, বিশ্বস্ত যে কোনো দু’জনকে দেওয়া হোক, যাঁরা শতাব্দী প্রাচীন এই ক্লাব ও এই চুক্তির গভীরতা অনুধাবন করতে পারবেন।
দেবব্রতর বক্তব্য, ‘‘এখন যে চুক্তিপত্রে আমাদের সই করতে বলা হচ্ছে, তাতে সই করলে আমাদের ক্লাবের সদস্য, সমর্থকরাই একদিন প্রশ্ন তুলবেন, ক্লাব কমিটি এই কাজটা কী করে করে গেল। আমরা এমন কোনও কাজ করতে চাই না, যা নিয়ে পরের প্রজন্ম আমাদের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুলতে পারে।’’ টাকার বিনিময়ে কিছু মানুষ তাঁদের বিরোধিতা করছেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘‘আমাদের ক্লাবের বিরুদ্ধাচারণ করার জন্য দুই-একটা বেসরকারি সংস্থা পারিশ্রমিকের বিনিময়ে কাজ করছে। কিছু সুযোগ সন্ধানী মানুষ তাঁদের ব্যবহার করছে। সদস্যরা যাঁদের দায়িত্ব দিয়েছেন, তাঁদের বোকা, স্বার্থানেষী ভাবার কারণ নেই। সদস্যদের দ্বারা নির্বাচিত কর্মকর্তারাই গত ১০০ বছর ধরে দায়িত্ব নিয়ে ক্লাবকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন।’’
যেহেতু মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপস্থিতিতে প্রাথমিক চুক্তিপত্র তৈরি হয়েছিল, তাই এ বারও তিনি উদ্যোগী হতে পারেন। কিন্তু এখনও মুখ্যমন্ত্রীর তরফ থেকে কোনও বার্তা আসেনি জানিয়ে দেবব্রত বললেন, ‘‘সই করার ব্যাপারে মুখ্যমন্ত্রীর তরফ থেকে এখনও কোনও নির্দেশ আসেনি। তবে নির্দেশ এলে প্রথমে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলার জন্য সময় চাইব। আমাদের কর্মসমিতির মান্যতা নিয়ে ওঁর নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করব। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ উপেক্ষা করার সাহস বা ইচ্ছে কোনওটাই আমাদের নেই। উনি কিছু উপদেশ দিয়েছিলেন। যেমন, ক্লাবের অসম্মান হতে না দেওয়া, ভাল-মন্দ বুঝে নেওয়া, ক্ষতি না হতে দেওয়া। উনি বলেন, ‘জয় বাংলা’, আমরা বলি ‘জয় বাংলা, জয় ইস্টবেঙ্গল।’’
তা হলে সই করতে সমস্যা কোথায়, তার ব্যাখ্যা দিয়ে দেবব্রত বলেন, ‘‘একটা চুক্তিতে কী আছে, সেটা অক্ষরে অক্ষরে পড়ে দেখা মুখ্যমন্ত্রীর পক্ষে সম্ভব নয়। তাই তিনি তরুণ ঝুনঝুনওয়ালা ও বিশ্ব মজুমদারকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন। এঁরা মধ্যস্থতাকারী হিসেবে ছিলেন। ক্লাবের পক্ষ থেকে এই চুক্তিপত্র নিয়ে পর্যালোচনা করা ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্বে ছিলেন অজিত বন্দ্যোপাধ্যায়, সৈকত গঙ্গোপাধ্যায় এবং সদানন্দ মুখোপাধ্যায়। সৈকত চুক্তিপত্রের ১১-১২টা বিষয় নিয়ে আপত্তির কথা আমাদের জানিয়েছিল। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় তিনটে বিষয় ছিল। এক তরফা বিচ্ছেদ, ক্লাব তাঁবুর ব্যবহার, স্পোর্টিং স্বত্ব। আমরা সে দিনই বলেছিলাম ক্লাব তাঁবু, লোগো উভয় পক্ষ ব্যবহার করব। তরুণ ঝুনঝুনওয়ালা বুঝতে পারেন, একতরফা বিচ্ছেদটা ঠিক নয়। এ ছাড়াও না মানার বহু বিষয় ছিল। কিন্তু তরুণ ঝুনঝুনওয়ালা আমাদের বলেন, ‘এটা তো ২ বছরের লক-ইন পিরিয়ড। তাই এত চপের কিছু নেই। পরে ওদের সাথে কথা বলে নেব, ২ বছরের জন্য মানতে অসুবিধে নেই’। আমাদের খেলার একটা তাগিদ ছিল, মুখ্যমন্ত্রী নিজে চেয়েছিলেন যে আমরা আইএসএল খেলি। মুখ্যমন্ত্রীও বললেন, ভরসা রাখতে। আমরা যেন শুরু করি। উনি পরে ব্যাপারটা দেখবেন। এরপর একটা মিটিং ঠিক করেন কোম্পানির লিগ্যাল হেড খান্ডেলওয়ালজি। আমি, অজিত বন্দ্যোপাধ্যায়, সৈকত গঙ্গোপাধ্যায় এবং সদানন্দ মুখোপাধ্যায় সেখানে যাই। ওই বৈঠকে কিছু সমাধানের রাস্তা বার হয়। আমরা রাজি হয়ে যাই। তিনটি শর্ত ছিল, যেমন একতরফা বিচ্ছেদ চলবে না, দু’তরফেই বিচ্ছেদের সুযোগ থাকবে, বিচ্ছেদের পর সমস্ত স্বত্ব ক্লাবকে ফেরত দিতে হবে। এছাড়া ক্লাব প্রাঙ্গন এবং লোগোর কী হবে, সেটা নিয়েও সমাধানের রাস্তা বার করা হয়। পরে আরও একটা টেলি কনফারেন্স হয়। সেখানেও ওই তিনটি শর্তকে মান্যতা দেওয়া হয়। কিন্তু তার সুফল আজ অবধি আমরা পাইনি। হঠাৎ দেখলাম, অনেক কিছু বদলে গিয়ে আবার প্রথম থেকে শুরু হয়েছে। আমাদের কী করার আছে?’’
কিন্তু বিনিয়োগকারী শ্রী সিমেন্ট বলছে প্রাথমিক ও চূড়ান্ত চুক্তিপত্রের মধ্যে কোনও ফারাক নেই। দেবব্রত সরকার বললেন, ‘‘আজকে বাঙুর সাহেব (শ্রী সিমেন্টের কর্ণধার হরিমোহন বাঙুর) বলছেন, আমরা তো ইজিএম করে চুক্তিপত্র ওদের হাতে দিয়েছি। উনি ঠিকই বলেছেন। কিন্তু সেটা ছিল প্রাথমিক চুক্তিপত্র। দ্বিতীয় এগ্রিমেন্টের ক্ষেত্রে যে বিস্তর ফারাক, সেটা সদস্যরা এখনও দেখেননি। এই চুক্তিপত্র প্রকাশ্যে আসুক। তখন বোঝা যাবে কোনটা সত্যি, কোনটা মিথ্যে।’’
প্রথম চুক্তিপত্রে সই করলেও চূড়ান্ত চুক্তিপত্রে সই করার আগে ২ বার ভাববে লাল-হলুদ। দেবব্রত বললেন,‘‘দিল খুলে প্রথম এগ্রিমেন্টে সই করেছি। স্পোর্টিং স্পিরিট দেখিয়ে একটা সই করে চোখ খুলে গিয়েছে। আজ অবধি কোনও ১টি কাজ ক্লাবের সঙ্গে আলোচনা করে করেননি। তাতেই ওঁদের ওপর বিশ্বাস রাখতে পারছি না।’’
টাকা খরচ নিয়ে তাঁর বক্তব্য, ‘‘আমাদের ক্লাব পাড়ার বালক সংঘ হলে কি ওঁরা আসতেন? আসতেন না। আজকে উনি প্রচারের শিরোনামে আছেন। এই মাইলেজ পাবে কোথায়? উনি যদি ৫ টাকা খরচ করে থাকেন ২০ টাকার মাইলেজ পেয়েছেন। তা হলে তো ১৫ টাকা ক্লাবকে ফেরত দেওয়া উচিত। ’’
যে যে কারণে চুক্তিপত্রে সই নিয়ে আপত্তি, সেগুলো আরও এক বার তুলে ধরেছেন দেবব্রত। বলেন, ‘‘র্শ্রী সিমেন্ট কি তার লোগোটা আমায় দেবে ব্যবহার করবার জন্য? দেবে না। লোগে আমাদের কাছে মায়ের মতো। সেটা বিক্রি করে দেওয়ার কোনও অধিকার আমাদের নেই। আমরা ব্যবহার করার অনুমতি দিতে পারি শুধুমাত্র। ওরা বলছে বিচ্ছেদটা ওদের একতরফা। ওরা যখন বিচ্ছেদ করবে, সেটা আমাদের কাছে ফেরত আসবে না কোনও দিন। এটা আমরা কখনও দিতে পারি? ক্লাব তাঁবুর ক্ষেত্রেও একই জিনিস। এটা সেনাবাহিনীর জমি। যেটা আমাদের নয়, সেটা আমরা ওদের দেব কী ভাবে? আমরা বলেছিলাম, একসঙ্গে ব্যবহার করব। এতে অসুবিধেটা কোথায় ছিল? সেটা না করে ওরা যখন আমাদের প্রেসিডেন্ট বা সেক্রেটারিকে সময় দেবে তখন তাঁরা ঢুকবেন। ভাবা যায়, ক্লাবের মেম্বার অফিসটা বাইরে নিয়ে যেতে হবে। ক্লাবটা সদস্যদের। তাঁরা আমাদের নির্বাচিত করে এনেছেন। আমরা হলাম কাস্টোডিয়ান বা কেয়ারটেকার। কাস্টোডিয়ান কখনও ক্লাব বিক্রি করে দিতে পারে না। এটা ভাবতে হবে সবাইকে। ওরা চলে যাওয়ার সময় স্পোর্টিং রাইটস যে কাউকে দিয়ে দিতে পারে, আমরা কিছু বলতে পারব না। কোনও চরম শত্রুর সঙ্গেও এরকম চুক্তি হবে না। আমাদের কোনো অধিকার নেই ক্লাব বিক্রি করে দেওয়ার।’’
নতুন চুক্তিতে ক্লাবের মালিরা সমস্যায় পড়বে জানিয়ে দেবব্রত বললেন, ‘‘ওরা (বিনিয়োগকারী) আমাদের মাঠটা নিয়ে নিচ্ছে। আমাদের মাঠকর্মী যাঁরা আছেন, তাঁদেরও ওরা রাখবে কি না সন্দেহ। এই এক বছরে খোঁজ খবর নেওয়া তো দূরে থাক, বেতন পর্যন্ত দেয়নি।’’ দেবব্রতর সংষোজন, ‘‘কোনও ফুটবলার নেওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের বলেছে? নাকি কোনও কোচের ক্ষেত্রে আমাদের সঙ্গে আলোচনা করেছে? কোন কোন ম্যাচ নিয়ে আলোচনা করেছে? গত এক বছরে এর কিছুই তারা করেনি। অথচ টার্মশিটে লেখা আছে, ‘‘জয়েন্ট অ্যাক্ট’’।
আগে বিনিয়োগকারী হিসেবে যারা এসেছিল, তাদের নিয়েও অনেক বিতর্ক হয়েছিল। বার বার কর্তাদের সঙ্গে এটা কেন হচ্ছে? দেবব্রতর ব্যাখ্যা, ‘‘আগের বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে নির্দিষ্ট কী নিয়ে মতোবিরোধ হয়েছিল, কেউ কি বলতে পারবেন? বিষয়টা চারদিক থেকে তৈরি করা হয়েছিল। যেটা হচ্ছিল, সেটা বিচ্ছেদ নিয়ে। এক বছর আগেই তারা আমাদের নোটিশ দিয়েছিল, তাদের শেয়ার হোল্ডাররা অনুমতি দিচ্ছে না। তাই তারা বিচ্ছেদ চাইছে। ওরা ক্লাবের উপর ৩-৪ কোটি টাকার দেনা চাপিয়ে দিয়ে চলে গেছে। যারা আর্থিক দিক থেকে পিছিয়ে থাকে, সবাই চেষ্টা করে তাদের ব্যবহার করার। এখানেও তাই হচ্ছে। আমরা সদস্যদের দ্বারা নির্বাচিত হয়ে কেয়ারটেকার-এর ভূমিকা পালন করি। আর্থিক ভাবে দুর্বল মানুষদের উপর ক্ষমতাবান মানুষদের যুদ্ধ আগেও ছিল, ভবিষ্যতেও থাকবে। কিন্তু আমাদের শরীরে ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের রক্ত বইছে। বাঙালদের লড়াই করার মানসিকতা আর জেদের সামনে আর্থিক ক্ষমতাবান মানুষেরা কখনোই ছড়ি ঘোরাতে পারবেন না। ইস্টবেঙ্গল আর বাঙাল সমর্থকদের সঙ্গে নিয়ে এই ঐকবদ্ধ লড়াইয়ে তাঁদের জিত হবেই। ছত্রে ছত্রে লেখা আছে চিরতরে তাঁবু, লোগো দিয়ে দিতে হবে, আর ফেরত আসবে না ক্লাবে।’’
বিনিয়োগকারী সংস্থা আলোচনার টেবিলে বসতে চাইছে না, সেই অভিযোগ তুলে দেবব্রত বলেন, ‘‘যারা কাজটা করব না ভাবে, তারাই এড়িয়ে চলে। আমরা বসতে চেয়ে সবসময় সমাধানের রাস্তা খোঁজার চেষ্টা করছি। ওঁরা বলছেন এজেন্ডা আমাদের দেওয়া হোক। আমরা এজেন্ডা দিয়েছি। ওঁরা বলছেন পাননি। তাহলে এই যে ‘দিয়েছি’ আর ‘পাইনি’, এটা তো একমাত্র টেবিলে সামনাসামনি বসেই ঠিক করা যাবে। একটাই উপায়, সামনাসামনি হাতে দিয়েই আলোচনায় বসার। কেন বসছেন না ? বাঙুর সাহেব নাকি দেড় মাস এখানে ছিলেন। ওঁর যদি সৎ উদ্দেশ্য থাকত, উনি আমাদের ডেকে কথা বলতে পারতেন। ডাকেননি। কিন্তু বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে ওঁর বক্তব্য বার হচ্ছে। বলা হচ্ছে এগ্রিমেন্টে সই না করলে টিম করবে না। কেন টিম করবে না? কেন ক্লাবকে জানানো হয়নি এই এগ্রিমেন্ট সই না করলে টিম করবে না? কেন আমাদের সংবাদমাধ্যম থেকে জানতে হচ্ছে। আমাদের যখন আইএসএল-এ খেলার প্রয়োজন ছিল, তখন মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর উদ্যোগের জন্য আমরা ওঁর কাছে ঋণী। কিন্তু ইনভেস্টর পাড়ার ক্লাব বা পঞ্চম ডিভিশনের ক্লাবের জন্য আসেনি। একশো বছরের একটা ক্লাবের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সুযোগ পেয়েছে ওরা, যেটা কোটি কোটি টাকা দিয়েও পেত না। ওদের শেয়ার দড় বেড়েছে, প্রচার বেড়েছে। ওঁদের বাংলা তথা ভারতের কটা লোক চিনতেন আমার ধারণা নেই। কিন্তু এখন বাংলা তথা ভারতবর্ষ জুড়ে ওঁদের চেহারা, নাম এবং কোম্পানির নাম, সবটাই প্রচারে এসেছে। মাথায় রাখতে হবে শতবর্ষ পার করা একটা প্রতিষ্ঠানের থেকে সদস্য-সমর্থক, কর্মকর্তা, ইনভেস্টর কেউই বড় নয়। সবার আগে প্রতিষ্ঠান, তার পরে সব।’
সমাজমাধ্যমে ক্লাবকর্তাদের নিয়ে বিরোধিতা হচ্ছে। এই নিয়ে তিনি বললেন, ‘‘যে কোনও প্রতিষ্ঠানেরই একটা বিরোধী শক্তি থাকা উচিত। সেটাই প্রশাসনকে ভাল কাজ করতে শক্তি যোগায়। এরাই আমাদের প্রেরণা। আমি এদের উদ্দেশে একটা কথা বলি, খালি নেটমাধ্যমে না থেকে ক্লাবের সামাজিক কর্মযজ্ঞে বা কোনও ভাল কাজে আসা যায় কি না, সেটা ভাবার অনুরোধ করলাম।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy