Advertisement
২৬ নভেম্বর ২০২৪

দেশের মাঠে ফুটবল ভবিষ্যতের ‘ভার’ গোপীবল্লভপুরে

রেফারির অনিচ্ছাকৃত ভুলে কোনও দল বিপাকে পড়ে। সমাধানে বিশ্ব ফুটবলে হয় প্রযুক্তির ব্যবহার। দেশে চালু হয়নি। সেই প্রযুক্তি ব্যবহার করল জেলার ক্লাব। দেখলেন সৌমেশ্বর মণ্ডলরেফারি ও সহকারী রেফারিদের ক্ষণিকের ভুল শোধরাতেই বিশ্ব ফুটবলে চালু হয়েছিল ‘ভিডিয়ো অ্যাসিস্ট্যান্ট রেফারি’ (ভার) পদ্ধতির। সেই পদ্ধতি এবার জেলার মাঠে।

 একনজরে: খেলার রেকর্ডিং চলছে। নিজস্ব চিত্র

একনজরে: খেলার রেকর্ডিং চলছে। নিজস্ব চিত্র

শেষ আপডেট: ২৮ ডিসেম্বর ২০১৯ ০০:৫২
Share: Save:

থিয়েরি অঁরির হ্যান্ডবল জিতিয়ে দিয়েছিল ফ্রান্সকে। কিন্তু আয়ারল্যান্ডের কপাল পুড়েছিল। ২০১০ সালের ফুটবল বিশ্বকাপে আর যোগ দেওয়া হয়নি আয়ারল্যান্ডের। বিশ্বকাপের যোগ্যতা নির্ণায়ক ম্যাচে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকে। কিন্তু জেলার কোনও গুরুত্বপূর্ণ প্রতিযোগিতায় যদি রেফারির চোখ এড়িয়ে হ্যান্ডবল হত? আর সেটাই ফলাফলের গোল হত? গন্ডগোলের সমূহ সম্ভাবনা।

রেফারি ও সহকারী রেফারিদের ক্ষণিকের ভুল শোধরাতেই বিশ্ব ফুটবলে চালু হয়েছিল ‘ভিডিয়ো অ্যাসিস্ট্যান্ট রেফারি’ (ভার) পদ্ধতির। সেই পদ্ধতি এবার জেলার মাঠে। ঝাড়গ্রাম জেলার গোপীবল্লভপুরে ভার-এর আদলে মাঠে ক্যামেরা বসিয়ে খেলা পরিচালনা শুরু হল। গত ২১ ডিসেম্বর থেকে দু’দিনের নকআউট ফুটবল প্রতিযোগিতা হয় গোপীবল্লভপুরের বর্গিডাঙার মাঠে। যোগ দিয়েছিল মোট ১৬টি দল।

ভার-এর প্রথম পরীক্ষামূলক প্রয়োগ হয়েছিল নেদারল্যান্ডসে। ২০১০ সালে। ২০১৬ সালে ‘ইন্টারন্যাশনাল ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন বোর্ড’ বিশ্ব ফুটবলে ভার-এর প্রয়োগের জন্য জোরাল সওয়াল করে। উদাহরণ দেওয়া হয়েছিল অঁরির হ্যান্ডবল এবং গোলের। সেই সঙ্গে আয়ারল্যান্ডের ছিটকে যাওয়ার। ২০১৮ সালের ফিফা বিশ্বকাপে ভার প্রথম চালু হয়। এই বিশ্বকাপে ৩৩৫টি ঘটনায় ভার-এর সাহায্য নিয়েছিলেন রেফারিরা। বিশ্বকাপ ফাইনালে ফ্রান্সের পাওয়া পেনাল্টিও ভার-এর মাধ্যমে দেওয়া।

কী ভাবে খেলা পরিচালনায় সাহায্য করে ভার? এই পদ্ধতিতে মাঠের রেফারিকে আরও কয়েকজন রেফারি ও প্রযুক্তি সাহায্য করে। মাঠের বিভিন্ন কোণে বেশ কয়েকটি ক্যামেরায় খেলা রেকর্ডিং করা চলে। মাঠের পাশে আরও চারজন সিনিয়র রেফারির প্যানেল থাকে। সেখানে অভিজ্ঞ রেফারিরা ক্যামেরার ছবি দেখে খেলার বিভিন্ন দিক খতিয়ে দেখেন। মোট চারটি বিষয় খতিয়ে দেখতে ভার ব্যবহার করা হয়। প্রথম, গোল হয়েছে না হয়নি? দ্বিতীয়, পেনাল্টি ছিল কিনা? বা সঠিক ভাবে পেনাল্টি দেওয়া হয়েছে কিনা? তৃতীয়, সরাসরি লাল কার্ড। আর চতুর্থ ক্ষেত্র হল, লাল কার্ড না হলুদ কার্ড, কী দেখানো হবে।

কয়েক বছর ধরেই জঙ্গলমহলের কয়েকটি ফুটবল প্রতিযোগিতায় পুরস্কার মূল্য ৫ লক্ষ টাকার বেশি হয়েছে। ফলে ক্লাবগুলো কলকাতা মাঠের নামী-দামি খেলোয়াড়দের নিয়ে আসেন। গ্রামের মাঠে হাইভোল্টেজ খেলায় রেফারির কিছু সিদ্ধান্ত নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করছেন খেলোয়াড় থেকে ক্লাবকর্তারা। রেফারির সিদ্ধান্তের চেয়ে নামী খেলোয়াড়দের সিদ্ধান্তকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন দর্শক থেকে ক্লাবকর্তারা। তাতে অনেক ক্ষেত্রেই রেফারির সিদ্ধান্ত মানা হয়নি। গন্ডগোলে কয়েকটি খেলা মাঝপথে বন্ধ করে দিতে হয়েছে। গন্ডগোল এড়াতে গোপীবল্লভপুরের মাঠে ক্যামেরার ব্যবস্থা ছিল। আর আর ব্রাদার্স কো-অপারেটিভ অ্যাথলেটিক ক্লাবের এই টুর্নামেন্টের পুরস্কার মূল্য ছিল সাড়ে ছ’লক্ষ টাকা। সুষ্ঠু ভাবে খেলা পরিচালনার জন্য আয়োজকেরা গোপীবল্লভপুর স্পোর্টস লাভার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাহায্য চান। অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক মোহিত দে, সভাপতি সত্যব্রত রাউত ও অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য তথা জাতীয় রেফারি শুভঙ্কর কর্মকার আলোচনায় বসেন। শুভঙ্কর প্রস্তাব দেন, আরও ৫০-৬০ হাজার টাকা খরচ করলে ‘ভার’এর আদলে খেলা পরিচালনা করতে পারবেন রেফারিরা। শুভঙ্করবাবুর প্রস্তাবে রাজি হন আয়োজকেরা। মাঠে সাতটি ক্যামেরা বসানো হয়। কন্ট্রোল রুম খোলা হয়। কন্ট্রোল রুমের পাশেই রেফারি প্যানেল বসে। খেলার মুহূর্তগুলো খতিয়ে দেখেন তিনজন রেফারি। চতুর্থ রেফারির কাছে মাঠের পাশে ৪২ ইঞ্চির এলইডি টিভি ছিল। সেই টিভিতে রিপ্লে দেখে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন রেফারি।

দু’দিনের খেলায় ১৫টি ম্যাচে রেফারিরা ১০টি সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে রেকর্ডিং ফুটেজ থেকে রিপ্লে দেখেছেন। মাঠে ১২ ফুট বাই ৮ ফুটের বড় ডিজিটাল স্ক্রিন লাগানো ছিল। বিশেষ মুহূর্তগুলোর রিপ্লে দেখানো হয়। তবে ক্যামেরা ব্যবহার করা হলেও ‘কমিউনিকেশন সিস্টেম’ ছিল না। মাঠের পাশ থেকে রেফারির প্যানেল প্রধান রেফারিকে কোনও বিষয়ে পরামর্শ দিতে ওয়াকিটকি ব্যবহার করে। সে ব্যবস্থা ছিল না। তবে চতুর্থ রেফারি পতাকা নেড়ে রেফারির দৃষ্টি আকর্ষণ করে প্যানেলের বার্তা দিয়েছেন। এ ছাড়া রেফারি কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে রিপ্লে দেখেছেন, প্যানেলের সাহায্য চেয়েছেন। দ্বিতীয় দিনের একটি খেলায় অফসাইড থেকে এক খেলোয়াড় গোল করেন। রেফারি ভাদু সরেন গোল দিয়েছিলেন। কিন্তু প্যানেলের চোখে অফসাইড ধরা পড়ে। এই বার্তা চতুর্থ রেফারির মাধ্যমে রেফারির কাছে পাঠানো হয়। রেফারি এসে রিপ্লে দেখে গোল বাতিল করেন। আরেক ম্যাচে রেফারি রঞ্জিত বক্সি পেনাল্টি দিয়েছিলেন। প্যানেল সেই পেনাল্টি বাতিল করে দেয়। ওই খেলাতেই একটি ক্ষেত্রে রেফারি একটি পেনাল্টি না দিয়ে খেলা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। প্যানেলের পরামর্শে খেলা থামিয়ে পেনাল্টি দেওয়া হয়। আরেকটি ম্যাচে রেফারি নৃপেন হালদার বক্সের কাছে ফাউল হওয়ায় পেনাল্টি দেন। প্যানেলের পরামর্শে পেনাল্টি পরিবর্তন করে ফ্রি কিক দেওয়া হয়। টুর্নামেন্টের উদ্বোধন করেন গোপীবল্লভপুর বিডিও দেবজ্যোতি পাত্র ও গোপীবল্লভপুর থানার আইসি সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। মাঠে টিকিটের ব্যবস্থা ছিল। মাটিতে বসে খেলা দেখার জন্য ২০ টাকা। চেয়ারে বসলে ৬০ টাকা। খেলা পরিচালনার জন্য পুলিশ ও প্রশাসন সহযোগিতা করেছে।

মোট দশজন রেফারি খেলা পরিচালনা করেন। তাঁদের কয়েকজন জাতীয় রেফারি। দু’জন মহিলা জাতীয় রেফারি রাজশ্রী হাঁসদা ও মাহি টুডুও ম্যাচ খেলিয়েছেন। মাহি ফাইনাল পরিচালনা করেন। গোপীবল্লভপুরের বাসিন্দা জাতীয় রেফারি শুভঙ্কর খামরই বলেন ‘‘যতদূর মনে হয় গোপীবল্লভপুরে রাজ্য তথা দেশের মধ্যে প্রথম ভার পদ্ধতির আদলে খেলা পরিচালনা করা হল। এতে আমাদের খেলা পরিচালনা করতে অনেক সুবিধে হয়েছে।’’ ইন্ডিয়ান সুপার লিগের খেলা পরিচালন করেছেন জাতীয় রেফারি রঞ্জিত বক্সি। তিনিও গোপীবল্লভপুরে খেলা পরিচালনা করেন। রঞ্জিতবাবু বলেন, ‘‘বিদেশের মাঠে ভার ব্যবহার করা হয়। গোপীবল্লভপুরে ভার-এর আদলে ক্যামেরার ব্যবস্থা করায় আমি অবাকই হয়েছি। জঙ্গলমহলের গ্রামের মধ্যে এমন আয়োজন দেখে আমি খুবই খুশি। তবে এখানে কমিউনিকেশন সিস্টেম থাকলে আরও ভাল হত। ভবিষ্যতে ভার আমাদের দেশের বিভিন্ন খেলায় চালু হলে ভালই হবে।’’

পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা রেফারি সংস্থার সম্পাদক ইন্দ্রজিৎ পাণিগ্রাহী বলেন, ‘‘গোপীবল্লভপুরে খেলায় ক্যামেরার সাহায্য নেওয়া হয়েছে। ভবিষ্যতে জেলার বিভিন্ন ফুটবল টুর্নামান্টে ক্যামেরা ব্যবহার শুরু হলে ভালই হবে।’’ ক্যালকাটা রেফারি অ্যাসোসিয়েশনে সম্পাদক সুকৃতি দত্ত বলেন, ‘‘ভার পদ্ধতিতে অনেক খরচ। আমাদের দেশে ভার এখনও চালু হয়নি।’’ আয়োজক সংস্থার পক্ষ থেকে রঞ্জিত মুর্মু বলেন, ‘‘টুর্নামেন্ট আয়োজনে ১০ লক্ষ টাকার বেশি খরচ হয়েছে। এন্ট্রি ফি ও টিকিটের মূল্য থেকে এত টাকা উঠে আসেনি। তবে ক্যামেরা বসিয়ে সুষ্ঠু ভাবে খেলা শেষ করতে পেরেছি। এটাই শান্তি।’’

ময়দানের হাইভোল্টেজ ম্যাচের ‘ভার’ প্রযুক্তি নিলে শান্তিকল্যাণই হবে। মত অনেকের।

অন্য বিষয়গুলি:

Football VAR
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy