২৯ বছর বয়সে বিপর্যয় নেমে আসে দীপার জীবনে। দ্বিতীয় বারের জন্য মেরুদণ্ডের টিউমারে আক্রান্ত হন তিনি। চিকিৎসকরা অস্ত্রোপচারের পরামর্শ দেন। অস্ত্রোপচার করে টিউমার বাদ দেওয়া গেলেও কোমরের নীচ থেকে বাকি অঙ্গ অসার হয়ে যায়। সেখানেই থেমে যেতে পারত দীপার জীবন।
দীপা এখনও স্বপ্ন দেখেন দেশের প্রতিনিধিত্ব করার। ফাইল চিত্র।
যে বয়সে এসে ক্রীড়াবিদরা খেলা ছাড়ার কথা ভাবেন সেই সময়ে খেলার দুনিয়ায় মাইলফলক গড়েছিলেন তিনি। হুইলচেয়ারে বসা এক মহিলার গলায় যখন রুপোর পদক ঝুলছিল তখন টেলিভিশনের পর্দায় চোখ রাখা বিশেষ ভাবে সক্ষম অসংখ্য মহিলা নতুন করে স্বপ্ন দেখা শুরু করেছিলেন। শারীরিক প্রতিবন্ধকতা থাকলেই সব দরজা বন্ধ হয়ে যায়, এই ধারণার উপর সজোরে কুঠারাঘাত করেছিলেন দীপা মালিক। ভারতের হয়ে প্যারালিম্পিক্সে প্রথম পদকজয়ী মহিলা। কোটি কোটি মহিলার আদর্শ হয়ে ওঠা দীপা এখনও স্বপ্ন দেখেন দেশের প্রতিনিধিত্ব করার। এখনও স্বপ্ন দেখেন তাঁর গলায় ঝুলবে পদক আর সামনে উড়বে দেশের জাতীয় পতাকা। কিন্তু এখন তো তিনি ক্রীড়াবিদ নন। প্রশাসক হিসাবে দেশের বিশেষ ভাবে সক্ষমদের আরও বেশি করে খেলার জগতে নিয়ে আসার চেষ্টা করছেন। কিন্তু মনের কোথাও একটু আক্ষেপ রয়েছে। বাকিদের খেলতে দেখলে বুকের ভিতরটা এখনও একটু চিনচিন করে ওঠে তাঁর।
২০১৬ সালের রিও প্যারালিম্পিক্সে শট পাটে মহিলাদের ৫৩ কেজি বিভাগে রুপো জেতেন দীপা। শট পাট ছাড়াও জ্যাভেলিন, ডিসকাস, সাঁতারেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন তিনি। সব মিলিয়ে কেরিয়ারে এখনও পর্যন্ত ৫৮টি জাতীয় ও ২৩টি আন্তর্জাতিক পদক জিতেছেন। প্যারালিম্পিক্সে পদক জেতার আগেই পেয়েছেন অর্জুন পুরস্কার। পরে পদ্মশ্রী ও মেজর ধ্যানচন্দ খেলরত্ন পুরস্কারেও তাঁকে সম্মানিত করেছে সরকার। সেই দীপার গলায় ফিরে এল ক্রীড়াবিদ থেকে প্রশাসক হওয়ার গল্প।
শেষ বার আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় নেমেছিলেন ২০১৮ সালের এশিয়ান প্যারা গেমসে। জাকার্তায় হওয়া প্রতিযোগিতায় জ্যাভেলিন ও ডিসকাসে ব্রোঞ্জ পদক জেতেন। কিন্তু চলতি বছর চিনে এশিয়ান প্যারা গেমস ও ২০২৪ সালে প্যারিসে প্যারালিম্পিক্সে দীপার বিভাগ নেই। ফলে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন না তিনি। খানিকটা সেই কারণেই ২০২০ সালে তাঁকে ভারতীয় প্যারালিম্পিক্স কমিটির সভাপতি করা হয়েছে। নতুন দায়িত্ব পাওয়ার পরে ভারতের বিশেষ ভাবে সক্ষম ক্রীড়াবিদদের মান আরও ভাল করার দিকে নজর দিয়েছেন দীপা। কিন্তু এত কিছুর মধ্যেও কলকাতায় জুনিয়র ও সিনিয়রদের জাতীয় স্তরের প্যারা পাওয়ারলিফটিং প্রতিযোগিতায় আসার পরে সেখানে উপস্থিত প্রতিযোগীরা যখন তাঁর সঙ্গে কথা বলতে এলেন তখন এক অদ্ভুত আনন্দ খেলে গেল তাঁর মুখে। যেন এক লহমায় ফিরে গেলেন কয়েক বছর আগে।
বার বার দীপার মুখে ফিরে এল কঠিন পরিশ্রম ও অনুশীলনের প্রসঙ্গ। আসলে তাঁর নিজের জীবনের লড়াইও তো কিছু কম নয়। সেনা পরিবারে জন্ম নেওয়া দীপা মাত্র পাঁচ বছর বয়সে মেরুদণ্ডের টিউমারে আক্রান্ত হন। তিন বছর ধরে চিকিৎসা চলার পরে সুস্থ হয়ে ওঠেন।
দীপার জীবনের একটা বড় অংশ জুড়ে রয়েছে কলকাতা। সেই শহরে এসে বললেন, ‘‘কলকাতার কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়ে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়েছি। প্রথমে সল্টলেকে, পরে ফোর্ট উইলিয়ামে। তখন ক্লাসে সব থেকে লম্বা ছিলাম। কারণ আমি হাঁটতে পারতাম। এখানে পড়ার সময়ই প্রথম স্কুল দলের অধিনায়ক হই। প্রথম ইংরেজি ছবি দেখেছি এই শহরে। ফুচকা খাওয়া, ট্রামে চড়়া, নিউ মার্কেট, আমার জীবনের অনেক স্মৃতি এই শহরকে ঘিরে।’’ বাংলা কথা বুঝতে পারেন। এমনকি ভাঙা ভাঙা বলতেও পারেন দীপা।
বিয়ে হয়েছিল সেনা পরিবারেই। দুই মেয়েও হয়। তার পরেই ২৯ বছর বয়সে বিপর্যয় নেমে আসে দীপার জীবনে। দ্বিতীয় বারের জন্য মেরুদণ্ডের টিউমারে আক্রান্ত হন তিনি। চিকিৎসকরা অস্ত্রোপচারের পরামর্শ দেন। অস্ত্রোপচার করে টিউমার বাদ দেওয়া গেলেও কোমরের নীচ থেকে বাকি অঙ্গ অসার হয়ে যায়। সেখানেই থেমে যেতে পারত দীপার জীবন। কিন্তু সেখান থেকেই শুরু হল নতুন লড়াই। অনুশীলন আরও বাড়ালেন। তার ফলও পান দীপা। ২০১০, ২০১৪ ও ২০১৮ সালে পর পর তিন বার এশিয়ান প্যারা গেমসে পদক জেতেন। মোটর স্পোর্টসের সঙ্গেও যুক্ত দীপা। আট দিন ধরে গাড়ি চালিয়ে হিমালয়ের ১৮ হাজার ফুট উচ্চতা পর্যন্ত উঠেছেন। আর ২০১৬ সালে প্যারালিম্পিক্সে পদক জয় দীপার এত বছরের কঠিন পরিশ্রমের সব থেকে মিষ্টি ফল।
খেলোয়াড় হিসাবে যে ভাবে শৃঙ্খলা ও কড়া নিয়মের অনুশীলন করতেন সেটা বাকি ক্রীড়াবিদদের মধ্যেও দেখতে চাইছেন দীপা। তাই সাই (স্পোর্টস অথরিটি অব ইন্ডিয়া) কমপ্লেক্সে ঢোকার পরে মাটিতে জলের খালি বোতল পড়ে থাকতে দেখে তা তুলে ডাস্টবিনে ফেলার নির্দেশ দিলেন। ক্রীড়াবিদদের সৎ ভাবে খেলার পরামর্শ দিলেন। বার বার বললেন, ‘‘আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় আমরা শুধু নিজেদের জন্য নয়, দেশের জন্যও খেলতে নামি। তাই আমাদের অসম্মান হলে সেটা দেশের কাছেও কলঙ্কের। আমরা এমন কিছু করব না যাতে দেশের নাম খারাপ হয়। সাফল্যের কোনও সহজ পথ নেই। এক মাত্র কঠিন পরিশ্রম করলেই সাফল্য আসবে।’’
২০২০ সালের টোকিয়ো প্যারালিম্পিক্সে ১৯টি পদক (৫টি সোনা, ৮টি রুপো ও ৬টি ব্রোঞ্জ) জিতেছিল ভারত। তার পরেও পদক তালিকায় ২৩তম স্থানে ছিল দেশ। তালিকায় উন্নতি করাটাই প্রধান লক্ষ্য দীপার। ভারতীয় প্যারালিম্পিক্স কমিটির সভাপতি দীপা বললেন, ‘‘এ বার প্যারালিম্পিক্সের আগে বলেছিলাম, পদক দুই অঙ্কের সংখ্যায় যাবে। সেটা করে দেখিয়েছি। এ বার পদক তালিকায় দশের মধ্যে আসা আমাদের লক্ষ্য।’’
এ বারই প্রথম জুনিয়র ও সিনিয়রদের জাতীয় স্তরের প্যারা পাওয়ারলিফটিং প্রতিযোগিতার আসর বসেছে কলকাতায়। ২২ রাজ্যের ১৫০-১৬০ জন প্রতিযোগী অংশ নিয়েছেন। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে যাতে আরও বেশি বিশেষ ভাবে সক্ষম প্রতিযোগী উঠে আসেন সেই চেষ্টা করছেন দীপা। আরও বেশি দীপা তুলে আনার লক্ষ্যে ব্রতী তিনি। তাই খেলতে না পারার দুঃখ থাকলেও নতুন প্রতিভা তুলে আনার স্বপ্নে বুঁদ ৫১ বছরের দীপা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy