গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।
২০০৮ সাল থেকে শুরু হয়েছে ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ বা আইপিএল। ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়েছে এই লিগের জনপ্রিয়তা। গত ১৬ বছরে বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় লিগে পরিণত হয়েছে আইপিএল। শুধু তাই নয়, ভারতীয় ক্রিকেটের অর্থনীতিও এখন অনেকটা নির্ভরশীল আইপিএলের উপর। অর্থনৈতিক ভাবে লাভজনক এই প্রতিযোগিতার প্রতি আকর্ষণ বাড়ছে বহুজাতিক বাণিজ্যিক সংস্থাগুলির। ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিসিআই) একটি পদক্ষেপ এই সাফল্যের চাবিকাঠি।
আইপিএলের সব দলগুলি প্রতি বার ব্যবসায়িক ভাবে সফল হয় তেমন নয়। অনেক সময়ই দলগুলি তাদের বিনিয়োগ করা টাকাও তুলতে পারে না। হাসিমুখে আর্থিক ক্ষতি মেনে নেন দলগুলির কর্তারা! কারণ তাঁরা নিশ্চিত থাকেন প্রতি বছর ক্ষতি হবে না। সামগ্রিক ভাবে লাভ হবে। আইপিএল এই বিশ্বাস তৈরি করতে পেরেছে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে। তাই টাকা খরচ নিয়ে ভাবেন না শাহরুখ খান, নীতা অম্বানী, সঞ্জীব গোয়েন্কা, পার্থ জিন্দল, প্রীতি জিন্টারা।
যেমন ২০২৩ সালে আইপিএলে রানার্স হয়েছিল গুজরাত টাইটান্স। তার আগের বছর ২০২২ সালে তারা চ্যাম্পিয়ন হয়। তবু ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে গুজরাত কর্তৃপক্ষের ক্ষতি হয়েছিল ৪২৯ কোটি টাকা। আবার ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষে তাদের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ৫৭ কোটি টাকা। আইপিএলে নাম লেখানোর পর প্রথম দু’বছরে গুজরাত কর্তৃপক্ষের ক্ষতির পরিমাণ ৪৮৬ কোটি টাকা। তবু আইপিএলের প্রতি তাঁরা আস্থা রেখেছেন। আগামী তিন বছরের জন্য নতুন করে বিনিয়োগ করেছেন। নিলামে ভাল দল তৈরির চেষ্টা করেছেন। ২০২২ সালে আইপিএলে আত্মপ্রকাশ করেছিল কলকাতার শিল্পপতি সঞ্জীবের লখনউ সুপার জায়ান্টসও। ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে লখনউ কর্তৃপক্ষের ক্ষতির পরিমাণ ছিল ২৪৩ কোটি। আবার ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষে তারা ৫৯ কোটি টাকা মুনাফা করেছে। সেই লখনউই এ বারের নিলামে শুধু ঋষভ পন্থের জন্য খরচ করেছে রেকর্ড ২৭ কোটি টাকা।
সব মিলিয়ে ২০২২-২৩ অর্থবর্ষের তুলনায় ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষে আইপিএলের ১০টি দলের সম্মিলিত আয় দ্বিগুণের বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে ১০টি দলের মিলিত আয় ছিল ৩০৮২ কোটি টাকা। পরের অর্থবর্ষে সম্মিলিত আয়ের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ৬৭৯৭ কোটি টাকা। অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, এক লাফে এতটা আয় বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান কারণ প্রতিযোগিতার সম্প্রচার স্বত্ব। বিসিসিআই ২০২২ সালে আইপিএলের সম্প্রচার স্বত্ব বিক্রি করেছিল ৪৮ হাজার ৩৯০ কোটি টাকায়। এ ছাড়াও প্রতি বছর আইপিএলের স্পনসরশিপ বাবদ বিভিন্ন বহুজাতিক সংস্থার কাছ থেকে বিসিসিআই ৪০০০ কোটি টাকার বেশি আয় করে। আইপিএলের দলগুলি বিসিসিআইয়ের কাছ থেকে এই টাকার একটা অংশ পেতে শুরু করেছে। যা তাদের আর্থিক ক্ষতির ঝুঁকি কমিয়ে দিয়েছে অনেকটা। টাটা গোষ্ঠী, সিয়েট, মাই ইলেভেন সার্কেল, অ্যাঞ্জেল ওয়ানের মতো সংস্থা আইপিএলে বিনিয়োগ করছে।
বিসিসিআইয়ের লভ্যাংশ আইপিএলের দলগুলি পেতে শুরু করায় তাদের আয়ের পরিমাণ অনেকটা বৃদ্ধি পেয়েছে। তাতে সব দলই যে আর্থিক ভাবে লাভবান হয়েছে তেমন নয়। তবে উজ্জ্বল ব্যবসায়িক ভবিষ্যতের সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। গুজরাত লাভ করতে না পারলেও আয়ের নিরিখে তারাই শীর্ষে। ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে তাদের আয় ছিল ৩৫৯ কোটি টাকা। ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষে তাদের আয় হয়েছে ৭৭৬ কোটি টাকা। বৃদ্ধির হার ১১৬ শতাংশ। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে মুম্বই ইন্ডিয়ান্স। ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে তাদের আয় ছিল ৩৫৮ কোটি টাকা। ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষে তাদের আয় হয়েছে ৭৩৭ কোটি টাকা। বৃদ্ধির হার ১০৬ শতাংশ। তৃতীয় স্থানে রয়েছে কলকাতা নাইট রাইডার্স। ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে কেকেআরের আয় ছিল ৩২২ কোটি টাকা। ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষে তাদের আয় হয়েছে ৬৯৮ কোটি টাকা। বৃদ্ধির হার ১১৭ শতাংশ। চতুর্থ স্থানে লখনউ সুপার জায়ান্টস। ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে তাদের আয় ছিল ২৮৫ কোটি টাকা। ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষে তাদের আয় হয়েছে ৬৯৫ কোটি টাকা। বৃদ্ধির হার ১৪৪ শতাংশ। পঞ্চম স্থানে চেন্নাই সুপার কিংস। ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে সিএসকের আয় ছিল ২৯২ কোটি টাকা। ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষে তাদের আয় হয়েছে ৬৭৬ কোটি টাকা। বৃদ্ধির হার ১৩২ শতাংশ। ষষ্ঠ স্থানে রয়েছে পঞ্জাব কিংস। ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে তাদের আয় ছিল ২৭৫ কোটি টাকা। ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষে তাদের আয় হয়েছে ৬৬৪ কোটি টাকা। বৃদ্ধির হার ১৪১ শতাংশ। সপ্তম স্থানে রয়েছে রাজস্থান রয়্যালস। ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে তাদের আয় ছিল ৩০২ কোটি টাকা। ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষে তাদের আয় হয়েছে ৬৬২ কোটি টাকা। বৃদ্ধির হার ১১৯ শতাংশ। অষ্টম স্থানে সানরাইজার্স হায়দরাবাদ। ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে তাদের আয় ছিল ২৭৬ কোটি টাকা। ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষে তাদের আয় হয়েছে ৬৫৯ কোটি টাকা। বৃদ্ধির হার ১৩৮ শতাংশ। নবম স্থানে রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরু। ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে আরসিবির আয় ছিল ২৪৭ কোটি টাকা। ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষে তাদের আয় হয়েছে ৬৫০ কোটি টাকা। বৃদ্ধির হার ১৬৩ শতাংশ। দশম স্থানে দিল্লি ক্যাপিটালস। ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে তাদের আয় ছিল ৩৬৬ কোটি টাকা। ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষে তাদের আয় হয়েছে কমপক্ষে ৫৮০ কোটি টাকা। (দিল্লি কর্তৃপক্ষ তাঁদের মোট আয় প্রকাশ করেননি। তাই তাঁদের আয় বৃদ্ধির সঠিক হার জানা যায়নি।)
বিপুল আয় বৃদ্ধি আইপিএলের সব দলকে লাভের মুখ দেখাতে না পারলেও ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছে অনেকটাই। প্রতিযোগিতার নতুন দু’দলের মতো সুফল পেয়েছে পুরনো দলগুলিও। মুম্বই ইন্ডিয়ান্স কর্তৃপক্ষের ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে ক্ষতির পরিমাণ ছিল ৪৯ কোটি টাকা। তারা ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষে মুনাফা করেছে ১০৯ কোটি টাকা। কেকেআরের ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে মুনাফা ছিল ২৪ কোটি টাকা। ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষে তা বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ১৭৫ কোটি টাকা। চেন্নাই ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে লাভ করে ৫২ কোটি টাকা। তারা ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষে মুনাফা করেছে ২২৯ কোটি টাকা। পঞ্জাব কিংস ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে লাভ করেছিল ৪৬ কোটি টাকা। তারা ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষে মুনাফা করেছে ২৫২ কোটি টাকা। রাজস্থান কর্তৃপক্ষ ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে লাভ করেছিলেন ১৭ কোটি টাকা। ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষে তাঁদের মুনাফা ১৪২ কোটি টাকা। বেঙ্গালুরু কর্তৃপক্ষের ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে ক্ষতি হয়েছিল ১১ কোটি টাকা। তাঁরা ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষে মুনাফা করেছেন ২২১ কোটি টাকা। আবার দিল্লি কর্তৃপক্ষের ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে ৫৮ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছিল। তাঁরা ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষে অন্তত ১৯৫ কোটি টাকা লাভ করেছেন (সম্পূর্ণ হিসাব পাওয়া যায়নি)। এ ছাড়া হায়দরাবাদ কর্তৃপক্ষ তাঁদের লাভ-ক্ষতির হিসাব জানাননি।
আইপিএল শুরুর পরের বছর অর্থাৎ ২০০৯ সালে প্রতিযোগিতার ব্র্যান্ড মূল্য ছিল ২ বিলিয়ন ডলার (প্রায় ১৬ হাজার ৯৭০ কোটি টাকা)। ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষে ১৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে তা হয়েছে ১২ বিলিয়ন ডলার (প্রায় ১ লাখ ১৮ হাজার ২০০ কোটি)। প্রতিযোগিতায় প্রথম বছর থেকে খেলা চেন্নাই সুপার কিংস, মুম্বই ইন্ডিয়ান্স, রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরু এবং কলকাতা নাইট রাইডার্সের ব্র্যান্ড মূল্য ১০০ মিলিয়ন বা প্রায় ৮৫০ কোটি টাকার বেশি।
আইপিএলের সম্প্রচার স্বত্ব এবং বিজ্ঞাপন বাবদ বিসিসিআইয়ের বিপুল আয়ের সুফল পেতে শুরু করেছে দলগুলি। বিভিন্ন ক্ষেত্রে আরও বেশি বিনিয়োগ করার সাহস পাচ্ছে তারা। চেন্নাই, মুম্বইয়ের মতো দলগুলির নিজস্ব অ্যাকাডেমি রয়েছে। তাদের ক্রিকেটারেরা বছরের যে কোনও সময় সেই অ্যাকাডেমিতে অনুশীলন করতে পারেন। যেমন আফগানিস্তান এবং ভারতের বিরুদ্ধে টেস্ট ম্যাচের কথা মাথায় রেখে রাচিন রবীন্দ্র বেশ কিছু দিন অনুশীলন করেছিলেন চেন্নাইয়ের অ্যাকাডেমিতে। সঙ্গে এনেছিলেন জাতীয় দলের অন্য এক সতীর্থকেও। ভারতের আবহাওয়া এবং পিচের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার জন্য প্রায় তিন সপ্তাহ তাঁরা এ দেশে ছিলেন। ঘরের মাঠে নিউ জ়িল্যান্ডের কাছে রোহিত শর্মারা ০-৩ ব্যবধানে টেস্ট সিরিজ় হারার পর রাচিনকে সেই সুবিধা দেওয়ার জন্য সমালোচিত হতে হয়েছিল চেন্নাই কর্তৃপক্ষকে।
মুদ্রার অন্য পিঠও রয়েছে। আইপিএল দলগুলির সঙ্গে যুক্ত প্রাক্তন ক্রিকেটারদের একটা অংশ বছরের বিভিন্ন সময় দেশের নানা প্রান্তে আয়োজিত প্রতিযোগিতাগুলি থেকে প্রতিভা খুঁজে আনেন। আইপিএলের দলগুলি নিজেদের অ্যাকাডেমি বা পরিকাঠামোয় তাদের গড়ে পিঠে নেয়। সময় মতো তাদের নাম আইপিএলের নিলামে অন্তর্ভুক্ত করিয়ে তাদের মূল দলের অংশ করে। এর ফলে দেশের প্রতিভাবান তরুণ ক্রিকেটারেরা উপকৃত হচ্ছেন। আখেরে লাভবান হচ্ছে ভারতীয় ক্রিকেট।
আইপিএলের দলগুলির আয়ের পরিমাণ বৃদ্ধি এবং ক্ষতি থেকে লাভের মুখ দেখতে শুরু করার মধ্যে তাই ইতিবাচক দিক রয়েছে। বছরের পর বছর ক্ষতির ধাক্কায় আইপিএল থেকে দল তুলে নেওয়ার মতো পরিস্থিতি আর নেই। এর কৃতিত্ব ভারতের ক্রিকেট কর্তাদের। ভুললে চলবে না দেশের কোটি কোটি ক্রিকেটপ্রেমীর কথাও। তাঁদের ভালবাসার জন্যই এ দেশে ক্রিকেটর এত জনপ্রিয়তা। সঠিক বিপণনের কারণে অর্থের জোয়ার এসেছে ভারতীয় ক্রিকেটে। লাভবান হচ্ছে বোর্ড, বিনিয়োগকারীরা এবং অবশ্যই ক্রিকেটারেরা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy