উন্মাদনা: শুক্রবার এ ভাবেই বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে উচ্ছ্বাসে মাতলেন সমর্থকেরা। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক।
সুন্দরী ইডেন হাসাতে জানে। সুন্দরী ইডেন কাঁদাতেও জানে।
এই ইডেনে দাঁড়িয়ে কি চোখটা ছলছল করে ওঠেনি মাইক গ্যাটিংয়ের? তাঁর একটা রিভার্স সুইপই যে সে বার বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন শেষ করে দিয়েছিল ইংল্যান্ডের!
জানফ্রাঙ্কো লুনেত্তা কি কোনও দিন ভুলতে পারবেন এই মায়াবী কুহকিনীকে? আগের রাত পর্যন্ত লুনেত্তার সেই লেজ়ার শো ছিল মেগাহিট। ১৯৯৬ সালে, যাঁরা আগের রাতে সেই শো দেখেছিলেন, তাঁরা মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন ইতালীয় শিল্পীর আলোর জাদুতে। কিন্তু ইডেনের মন কি অত সহজে জেতা যায়! সে হয়তো ক্রুদ্ধ হয়েছিল কোনও অজানা কারণে। তাই তো বিশ্বকাপ উদ্বোধনীর রাতে, ক্রুদ্ধ নাগিনীর ফোঁসফোঁসানি উড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিল লক্ষ লক্ষ টাকার পরিকল্পনা। ভগ্নহৃদয়ে জগমোহন ডালমিয়া আর লুনেত্তাকে দেখতে হয়েছিল, তাঁদের স্বপ্ন উড়ে যাচ্ছে গঙ্গার হাওয়ায়! যে রেশমি নেটের উপরে লেজ়ার রশ্মি খেলা করবে, সে তো তখন হাওয়ায় উড়ছে! রশ্মির খেলা হবে কী করে।
সেই ১৯৮৭ থেকে শুরু। তার পরে ১৯৯৬, ২০১১, ২০১৬— ৫০ ওভার থেকে টি-টোয়েন্টি, নানা বিশ্বকাপের স্বাদ পেয়েছে ইডেন। আর সে কাউকে কাঁদিয়েছে, কাউকে হাসিয়েছে। কাউকে ভালবেসেছে, কাউকে দূরে ঠেলে দিয়েছে।
শুক্রবার দুপুর থেকে রেড রোড দিয়ে কার্নিভালের শোভাযাত্রা একই সঙ্গে উৎসব এবং বিষণ্ণতাকে সঙ্গী করে এগিয়ে যাচ্ছিল গঙ্গার দিকে। আর উল্টো দিকের ইডেন তখন সেজে উঠছিল আরও একটা বিশ্বকাপের জন্য। ১২ বছর পরে আবার ৫০ ওভারের বিশ্বকাপ যে ফিরে এসেছে কলকাতায়। শনিবার বাংলাদেশ বনাম নেদারল্যান্ডস ম্যাচ দিয়ে যে কাপ-যজ্ঞের সূচনা হতে চলেছে ইডেনের বুকে।
যে দু’টো দল কাল মাঠে নামবে, তাদের ক্রিকেটারদের অতীত নিয়ে সে রকম উৎসাহ নেই। তারা চায়, বর্তমানের হিসেব-নিকেশ মেটাতে। কিন্তু সুন্দরী ইডেনের স্পর্শ পেলে যে চলে যেতেই হয় অতীতের সরণি বেয়ে। চোখের সামনে ভেসে ওঠে হাসি-কান্না ভরা নানা মুখের কোলাজ।
১৯৮৭ সালে অ্যালান বর্ডারের অস্ট্রেলিয়া বিশ্বকাপ জিতেছিল এই ইডেনের বুকে। ইংল্যান্ডকে হারিয়ে। বর্ডার আজও বলে থাকেন, ‘‘এখনও বুঝতে পারি না, গ্যাটিং সে দিন কেন ওই রিভার্স সুইপটা মেরেছিল!’’ গ্যাটিংও কি কোনও দিন বুঝতে পারবেন? হয়তো মোহময়ী ইডেনের কোনও সম্মোহনী শক্তি বাধ্য করেছিল ইংল্যান্ড অধিনায়ককে ওই শট খেলতে। সুন্দরী ইডেন হয়তো ইংরেজদের হাসিমুখ দেখতে চায়নি!
শুক্রবার একই সঙ্গে বাংলাদেশ এবং নেদারল্যান্ডসকে অনুশীলন করতে দেখা গেল মাঠের দু’প্রান্তে। ঠাকুর বিসর্জনের কার্নিভালের জন্য পুলিশ জানিয়ে দিয়েছিল, সাড়ে চারটের মধ্যে মোটামুটি মাঠ খালি করে দিতে হবে। তাই একই সঙ্গে দু’দল নেমে পড়েছিল অনুশীলনে।
পুলিশের নির্দেশের কথা শুনতে শুনতে আরও একটা দৃশ্য মনের মধ্যে ভেসে উঠছিল। সে দিনও ইডেন কাঁদিয়েছিল এক জনকে। বিনোদ কাম্বলি যখন ইডেন ছেড়ে বেরিয়ে আসছেন, তখন তাঁর চোখে জল। ১৯৯৬ সালের ওই দিন সেমিফাইনাল জিতে আর ফাইনালে যাওয়া
হয়নি ভারতের।
সেই ম্যাচে ভারতের ব্যাটিং ব্যর্থতার কারণে আগুন জ্বলেছিল ইডেনের গ্যালারিতে! বোতল উড়ে এসেছিল মাঠে। পুলিশ অনেক চেষ্টা করেছিল গ্যালারিকে শান্ত করে খেলা চালাতে। কিন্তু পুলিশের নির্দেশ কেউ শোনেনি, ম্যাচও আর হয়নি। শ্রীলঙ্কা ফাইনালে চলে যায়।
সে দিন সুন্দরীও কি রেগে গিয়েছিল তার প্রিয় পাত্রের উপরে? হয়তো বা তাই। মহম্মদ আজ়হারউদ্দিনকে বলা হয়ে থাকে ইডেনের বরপুত্র। ইডেন নাকি কোনও দিন তাঁকে শূন্য হাতে ফেরায় না। কিন্তু সে দিন ফিরিয়ে দিয়েছিল। কেন রেগে গিয়েছিল ইডেন? হয়তো মাঠের সবুজ ঘাসেও গুমরে গুমরে উঠেছিল প্রশ্নটা— ‘‘আজ়হার, তুমি টস জিতে কেন ফিল্ডিং নিয়েছিলে? তোমাকে তো আগেই বলে দেওয়া হয়েছিল, পরের দিকে বল ঘুরবে! তা সত্ত্বেও কেন ছিল ওই সিদ্ধান্ত? কেন?’’ শ্রীলঙ্কার স্পিনাররাই তো বাজি মেরে দিয়ে চলে যায় ইডেনের বুকে! সুন্দরী ইডেন হয়তো তা সহ্য করতে পারেনি। হয়তো তার রাগটাই প্রতিফলিত হয়েছিল সে দিন মাঠে থাকা হাজার হাজার মানুষের মধ্যে।
পুজো কার্নিভালের শেষে ইডেনে যে বিশ্বকাপ কার্নিভাল শুরু হতে চলেছে, সেখানে কিন্তু ওই রকম ঘূর্ণি পিচ হওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই। বাংলাদেশের পেসার তাসকিন আহমেদ বলে গেলেন, ‘‘ইডেনের উইকেট শুনেছি ভালই হবে। রানও উঠবে।’’ নেদারল্যান্ডস অধিনায়ক স্কট এডওয়ার্ডসও বড় রানই আশা করছেন এই পিচে।
একটা নয়, দু’টো নয়। এ বার বিশ্বকাপের পাঁচ-পাঁচটা ম্যাচ হচ্ছে ইডেনে। বাংলাদেশ-নেদারল্যান্ডস ছাড়াও খেলবে ভারত, পাকিস্তান, দক্ষিণ আফ্রিকা, ইংল্যান্ড। আছে একটি সেমিফাইনালও। মেয়েদের মন যেমন বোঝা দায়, সে রকমই সুন্দরী ইডেনের ভালবাসা শেষ পর্যন্ত কে বা কারা পাবে, তা বোঝাও কিন্তু কঠিন।
ইডেন কি এ বারও জাদু-চুম্বনে কোনও অনামী-অখ্যাতকে কার্লোস ব্রেথওয়েট বানিয়ে দেবে? যত দিন এই মাঠ থাকবে, তত দিন ব্রেথওয়েটকে কে ভুলতে পারবে? কে ভুলতে পারবে ২০১৬ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ফাইনালে বেন স্টোকসের করা শেষ ওভারে ব্রেথওয়েটের মারা ওই চার ছক্কা? যে চারটে ছয় ইংল্যান্ডের মুখের হাসি কেড়ে নিয়ে বিশ্বকাপ তুলে দিয়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ়ের হাতে।
সুন্দরী ইডেনের অনুকম্পা না পেলে কি সেই ইনিংস খেলতে পারতেন ব্রেথওয়েট!
সাংবাদিক বৈঠক শেষ করার আগে তাসকিন আহমেদ বলে গেলেন, ‘‘কাল নিশ্চয়ই অনেক বাঙালি ভাই আমাদের সমর্থন করতে মাঠে আসবেন। পাঁচ শতাংশ হলেও আমাদের মনোবল বাড়াবে ইডেনের জনসমর্থন। আমাদের জন্য প্রার্থনা করুন আপনারা।’’
সেই ২০১১ সালের বিশ্বকাপে আয়ারল্যান্ডের বিরুদ্ধে নেদারল্যান্ডস একটি ম্যাচ খেলেছিল ইডেনে। সেই হারের ইতিহাস বদলে দিতে চান এডওয়ার্ডস। ইডেনের দর্শকদের কাছে তাঁরও একটাই আর্জি, ‘‘ভাল ক্রিকেট খেললে আমাদেরও একটু সমর্থন করবেন।’’
আগামী ক’দিন তুমি কাকে ভালবাসায় ভরিয়ে দেবে, ইডেন? কাকেই বা কাঁদাবে?
প্রেমিকদের প্রহর গোনার পালা শুরু হল!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy