টিম ইন্ডিয়ার ক্যাপ্টেন হিসাবে আপাতত শেষ ‘হাড্ল’। অধিনায়কত্ব ছাড়ার দিনে নিজেই এই ছবি টুইট করলেন বিরাট কোহলি।
অদৃশ্য স্কোরবোর্ডে কী ভাবে লেখা থাকবে এই বিদায়ের বাণী?
অধিনায়ক বিরাট কোহলি ‘স্টাম্প্ড’ ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড?
না কি অধিনায়ক বিরাট কোহলি আহত, অবসৃত?
ভারতীয় এবং বিশ্ব ক্রিকেটে আলোড়ন ফেলে দিয়ে শনিবার কিং কোহলির মুকুট নামিয়ে রাখা দেখে মনে হচ্ছে, দু’টোই ঠিক। বোর্ডের ক্রমাগত বাউন্সার তো ছিলই, সঙ্গে তিনি নিজেও সম্ভবত তীব্র মানসিক অশান্তিতে ভুগছিলেন। তাতে ক্ষতি হচ্ছিল তাঁর ক্রিকেটের। তাই এমন সিদ্ধান্ত।
এক দিকে, বোর্ড চাবুক মারছে সাদা বলের ক্যাপ্টেন্সি কেড়ে নিয়ে। অন্য দিকে বলছে, আচ্ছা টেস্ট ক্যাপ্টেন্সিটা রাখো। বাঘকে চেন দিয়ে বেঁধে রাখা আবার খাবারও এগিয়ে দেওয়া। ক্রিকেট মাঠে আত্মসম্মানের সঙ্গে কখনও আপস না করে চলা বিরাট রাজা এই ‘অপমানজনক’ আয়োজন মেনে নিতে চান না বলেই সম্ভবত সরে দাঁড়ালেন সব ধরনের নেতৃত্ব থেকে।
এর পরে মুক্ত বিহঙ্গ হয়ে শুধু ব্যাটসম্যান হিসেবে ক্রিকেট পৃথিবীতে উড়ে বেড়ানোর সুযোগ থাকছে। সদ্য বিদায় নেওয়া কোচ রবি শাস্ত্রী— যাঁর অবদানের কথা কোহলি বিদায়ী বিবৃতিতে শনিবার উল্লেখ করেছেন, তিনি কয়েক দিন আগেও বলছিলেন, ‘‘বিরাটের অনেক কিছু দেওয়ার আছে ব্যাটসম্যান হিসেবে। মানসিক ভাবে কিছুটা হাল্কা হতে পারলে ওর ভালই হবে।’’ সচিন তেন্ডুলকর যেমন অধিনায়কত্ব ছেড়ে দিয়ে আরও বড় রডোডেনড্রন হয়ে ফুটেছিলেন, ব্যাটসম্যান কোহলিও তেমনই সৌন্দর্য আর ঘ্রাণ ছড়াবেন, এমনই আশা করছেন ভিভ রিচার্ডস থেকে বীরেন্দ্র সহবাগ সবাই।
একই সঙ্গে জোরালো চর্চা আর কৌতূহল চলতেই থাকবে মাত্র দু’মাসের মধ্যে বিশ্ব ক্রিকেটের সব চেয়ে প্রভাবশালী অধিনায়কের সব ধরনের নেতৃত্ব থেকে চাঞ্চল্যকর বিদায় নিয়ে। ভারতীয় ক্রিকেট ইতিহাসে অধিনায়কত্ব নিয়ে নাটকীয় কাহিনির অভাব নেই। ভিজির রাজা থেকে টাইগার পটৌডি, অজিত ওয়াড়েকর, কপিল দেব, সুনীল গাওস্কর— লম্বা তালিকা। কোহলি-কাহিনি সেই সোপ অপেরায় খুব উপরের দিকে থাকবে। এ নিয়ে কোনও সংশয় নেই যে, ভারতীয় বোর্ড যে রকম তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে ওয়ান ডে নেতৃত্ব কেড়ে নিয়েছিল, তাতে চূড়ান্ত অপমানিত বোধ করেন কোহলি। দক্ষিণ আফ্রিকায় এত গুরুত্বপূর্ণ সিরিজ় চলাকালীন নির্বাচক প্রধান চেতন শর্মা এসে ফের তাঁকে নিশানা করে বিবৃতি দিলেন। বোর্ড সেই প্রেস কনফারেন্সে অনুমতি দিল আর উল্টো দিকে অধিনায়ক হিসেবে তাঁর প্রাক-ম্যাচ সাংবাদিক সম্মেলনে আসা বন্ধ হয়ে গেল।
চেতনের বিবৃতির পাল্টা বক্তব্য
পেশ করার আর সুযোগ হয়নি কোহলির। বোর্ডের বৈঠকে তা হলে ঠিক কী ঘটেছিল? তাঁর আর বলা হয়নি। এত দিনের রীতি পাল্টে ফেলে অধিনায়কের বদলে প্রাক-ম্যাচ সাংবাদিক সম্মেলনে কোচ রাহুল দ্রাবিড়কে আনা হচ্ছিল। কোহলি বুঝতেই পারছিলেন, বোর্ড আর তাঁর মধ্যে কোভিডবিধির চেয়েও বেশি দূরত্ব তৈরি হয়ে গিয়েছে। যা দেখেশুনে বেশ কয়েক দিন ধরেই কারও কারও মনে হচ্ছিল, কোহলির সব ছেড়েছুড়ে চলে যাওয়া শুধু সময়ের অপেক্ষা। শনিবার ছিল এক রাশ অভিমান নিয়ে সেই বিদায় ঘোষণার দিন।
সাত বছর আগে সিডনিতে মহেন্দ্র সিংহ ধোনি যখন টেস্ট থেকে বিদায় নিলেন, ভারতীয় দল ছিল র্যাঙ্কিংয়ে সাত নম্বরে। সেখান থেকে টেস্ট দুনিয়ায় ভারতীয় দলের অবিশ্বাস্য উত্থান কোহলির অধীনে। টানা পাঁচ বছর বিশ্বের এক নম্বর থেকেছে ভারতীয় দল। অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ডে দাপিয়ে বেড়িয়েছে। বিদায়ী বার্তায় তাই তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘‘সম্পূর্ণ সততা নিয়ে দায়িত্ব সামলানোর চেষ্টা করেছি। উঁচুতে উঠেছি, কিছু পতনও দেখেছি কিন্তু কখনও তাগিদে অভাব হয়নি। ১২০ শতাংশ দেওয়ার
চেষ্টা করেছি।’’
গোটা দলকে ধন্যবাদ দেওয়ার পাশাপাশি দু’জনের নাম করেছেন কোহলি, যা একই রকম ইঙ্গিতপূর্ণ। এঁদের মধ্যে বোর্ড প্রেসিডেন্ট সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়, বর্তমান কোচ রাহুল দ্রাবিড় বা নির্বাচকদের কারও নাম নেই। আছেন রবি শাস্ত্রী— যাঁর সঙ্গে হাত মিলিয়ে এই সাত বছরে তিনি নতুন প্রজন্মের টিম ইন্ডিয়া গড়েছিলেন। এবং, মহেন্দ্র সিংহ ধোনি— যাঁর আন্তরিক সমর্থনে উত্থান অধিনায়ক কোহলির। ভারতীয় ক্রিকেটে অধিনায়ক এবং সহ-অধিনায়কের সম্পর্কের ইতিহাসে ‘রব নে বনা দি জোড়ি’ প্রেম-ভালবাসার ছবি খুব একটা পাওয়া যায় না। ব্যতিক্রম ধোনি-কোহলি। খারাপ সময়ে নির্বাচকদের রোষানল থেকে বাঁচিয়ে কোহলির পাশে যেমন দাঁড়িয়েছিলেন অধিনায়ক ধোনি, তেমনই কোহলিও বরাবর অগ্রজকে সম্বোধন করেছেন ‘মাই ক্যাপ্টেন’ হিসেবে। এখনকার ড্রেসিংরুমে না আছেন শাস্ত্রী, না আছেন ধোনি। বোর্ড প্রেসিডেন্ট সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে এত বড় বিতর্কে জড়িয়ে পড়লেন। তার পরে দুই মহাতারকার সহাবস্থানও অসম্ভব হয়ে দাঁড়াল।
টেস্ট অধিনায়কত্ব তাঁর হাতে থাকলেও কতটা তাঁর বক্তব্য শোনা হয়, প্রশ্ন থাকছে। রবি শাস্ত্রী এখন আর কোচ নন, রাহুল দ্রাবিড় দায়িত্বে। সব ব্যাপারে কি দ্রাবিড়ের সায় থাকবে কোহলির কথায়? জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না। তা হলে কি জয়ন্ত যাদব দলে ঢুকতেন? মহম্মদ সিরাজ দেশের মাঠে টেস্টে বাদ পড়তেন? বোর্ডের নীতি, হাবভাবে পরিষ্কার, ক্যাপ্টেন কোহলি নন, কোচ দ্রাবিড়কে তারা দলের মুখ্য পরিচালক হিসেবে দেখতে চাইছে। তাঁর কথাকেই অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। দ্রাবিড়— তিনিও কি আর চাইবেন অনিল কুম্বলে হতে?
বোর্ডের সঙ্গে চলতে থাকা সঙ্ঘাত নিয়ে তীব্র মানসিক অশান্তিতে ভুগছিলেন বলে শোনা যায়। ঘনিষ্ঠমহলে আক্ষেপ করে এমনও নাকি বলেছিলেন যে, ‘‘খেলতে খেলতে ক্রিকেটের বাইরে অন্য কিছুতে কখনও মনোনিবেশ করতে চাইনি আমি। এখন ঠিক সেটাই করতে হচ্ছে। ক্রিকেট ফেলে এ সব বিতর্ক নিয়ে পড়ে থাকতে চাই না।’’ ব্যাটসম্যান হিসেবে দু’বছর ধরে সেঞ্চুরি খুঁজতে থাকা কোহলি আর মনঃসংযোগ ক্ষতবিক্ষত করতে চাইলেন না হয়তো।
এর মধ্যেই বজ্রপাতের মতো আছড়ে পড়েছে দক্ষিণ আফ্রিকায় সিরিজ় হার। যা মেনে নেওয়া কঠিন তাঁর মতো জয়-সর্বস্ব অধিনায়কের পক্ষে। সঙ্গে ডিআরএস বিতর্কে জড়িয়ে ফের নিন্দার ঝড়ের মুখে পড়া। ফের ভাবমূর্তি কলুষিত হওয়া। কোহলির মতো নাছোড় চরিত্রেরও সম্ভবত এ বার মনে হতে শুরু করেছে, ‘‘অনেক হয়েছে। এ বার যুদ্ধবিরতির ডাক দাও।’’ তাঁর পরিবার, স্ত্রী অনুষ্কা যদি বুঝিয়ে থাকেন তাতেও অবাক হওয়ার থাকবে না।
কপিল দেবকে অধিনায়ক করা হবে শুনে এক বোর্ড কর্তা বলেছিলেন, ‘‘একে কী করে ক্যাপ্টেন করবে? ইংরেজিই তো বলতে পারে না!’’ শুনে কপিলের জবাব ছিল, ‘‘ক্যাপ্টেন্সির দরকার নেই। আমাকে ক্রিকেটটা খেলতে দাও। অক্সফোর্ড থেকে তোমরা ক্যাপ্টেন নিয়ে এসো।’’ দীর্ঘ বিদায়ী বিবৃতির বাইরে কোহলিও হয়তো নীরব বার্তা দিয়ে গেলেন, ‘‘আমাকে ক্রিকেট খেলতে দাও। ক্যাপ্টেনটা তোমরা স্কুলের ভদ্রসভ্য, বাধ্য কোনও ছাত্রকে করে দাও।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy