ঝাঁট দেওয়া হচ্ছে পিচে। —ফাইল চিত্র
ঘরের মাঠে ভারতকে টেস্টে হারানো কঠিন। আরও কঠিন ভারতে পাঁচ দিন টেস্ট খেলা। ভারতের মাটিতে শেষ ১৫টি টেস্টের মধ্যে মাত্র দু’টি ম্যাচ পাঁচ দিন খেলা হয়েছে। কোনও দর্শক যদি পঞ্চম দিনের খেলা মাঠে এসে দেখার আশায় থাকেন, তা হলে তাঁর হয়তো আর আসার প্রয়োজনই হবে না। পাঁচ দিনের টেস্টে এক সময় শুধুই ড্র দেখা যেত। এখন প্রতিটি টেস্টেই প্রায় ফল হচ্ছে, কিন্তু খেলা শেষ হয়ে যাচ্ছে অনেক আগে।
২০১৯ সালের ১০ অক্টোবর দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে টেস্ট খেলে ভারত। সেই টেস্ট শেষ হয়ে যায় চার দিনে। সেখান থেকে এখনও পর্যন্ত ভারতে হওয়া ১৫টি টেস্টের মধ্যে যে দু’টি ম্যাচ পাঁচ দিনে গড়ায়, তার একটি ড্র হয় এবং অন্যটিতে ভারত হেরে যায়। সেই টেস্ট থেকে ধরলে ১৫টি টেস্টের মধ্যে একটি টেস্ট শেষ হয়ে যায় মাত্র দু’দিনে। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে আমদাবাদের সেই টেস্টে ভারত জেতে ১০ উইকেটে। অক্ষর পটেল দুই ইনিংস মিলিয়ে নেন ১১টি উইকেট। আইসিসি সেই ম্যাচের পিচকে ‘অ্যাভারেজ’ বলে। সেই মাঠেই বৃহস্পতিবার মুখোমুখি হতে চলেছে ভারত এবং অস্ট্রেলিয়া।
বর্ডার-গাওস্কর ট্রফির চলতি সিরিজ়ে প্রথম দু’টি ম্যাচ শেষ হয় তিন দিনে। শেষ ১৫টি টেস্টের ন’টি ম্যাচই তিন দিনে শেষ হয়েছে। স্বাভাবিক ভাবে সেই সব টেস্টে ফলও হয়েছে। এত দ্রুত টেস্ট শেষ হয়ে যাওয়া নিয়ে বার বার প্রশ্ন উঠছে। রবিচন্দ্রন অশ্বিনকে এক সমর্থক জিজ্ঞেস করেছিলেন কেন তিন দিনে টেস্ট শেষ হয়ে যাচ্ছে। ভারতীয় স্পিনার বলেন, “ক্রিকেটারদের মানসিকতা বদলে গিয়েছে। এখনকার দিনে সব ক্রিকেটারই দ্রুত খেলতে চায়। দ্রুত রান তুলতে চায়। ক্রিকেটাররা খুব বেশি সময় নেয় না। তা বলে কারও সঙ্গে এটা নিয়ে তুলনা করা উচিত নয়। আলাদা যুগে, আলাদা ভাবে খেলা হয়।”
আইসিসি যদিও দ্রুত টেস্ট শেষ হয়ে যাওয়া নিয়ে কিছু ভাবছে না। সংবাদ সংস্থা রয়টার্সকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে আইসিসির এক মুখপাত্র বলেন, “ভারতে দ্রুত টেস্ট শেষ হয়ে যাওয়া যদি চিন্তার কারণ হত, তা হলে নিশ্চয়ই আইসিসির বৈঠকে এটা নিয়ে ক্রিকেট কমিটি আলোচনা করত।”
২০১৯ সাল থেকে বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ শুরু হয়েছে। প্রতিটি দল চাইছে ফাইনালে উঠতে। সেই কারণে ঘরের মাঠে জেতার ব্যাপারে বেশি জোর দিচ্ছে সব দেশ। ভারতে স্পিন খেলা কঠিন। সেই কারণে বিপক্ষকে ঘরে এনে তেমন পিচই দিচ্ছে ভারত। অধিনায়ক রোহিত শর্মা তৃতীয় টেস্টে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে হারের পরেও তাই বলেন, “আমরা এই ধরনের পিচেই খেলতে চেয়েছিলাম। কারণ, আমাদের শক্তি স্পিন বোলিং। বিদেশ সফরের সময় ওরাও নিজেদের শক্তি অনুযায়ী পিচ তৈরি করে। আমি বুঝতে পারছি না কেন ভারতেই শুধু পিচ নিয়ে এত কথা হয়! আমরা জানতাম, এই ধরনের পিচে ব্যাট করা কঠিন। তার পরেও আমরা খেলতে চেয়েছি।”
প্রায় একই ধরনের কথা শোনা যায় ব্যাটিং কোচ বিক্রম রাঠৌরের গলাতেও। কিন্তু তিনি কারণ হিসাবে তুলে ধরেন বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপকে। রাঠৌর বলেন, “বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ আসার পর থেকে ঘরের মাঠে ম্যাচ জেতার চাপ বেড়েছে। ঘরের মাঠে জেতার জন্য ঝাঁপাচ্ছে সব দল।” অর্থাৎ ভারত মেনে নিচ্ছে যে, বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের চাপের কারণে স্পিন সহায়ক উইকেট বানিয়ে বিপক্ষকে চাপে ফেলতে পিছপা হচ্ছে না তারা। প্রশ্ন উঠছে, প্রতিটি দেশ যদি এমন করে তবে তো টেস্টের আনন্দ নষ্ট হয়ে যাবে। তা হলে আইসিসির কি নিরপেক্ষ কিউরেটর পাঠানো উচিত? রাঠৌর বলেন, “সেটা আইসিসির সিদ্ধান্ত।”
অশ্বিন যে দ্রুত খেলার কথা বলছেন, সেটা অবশ্যই সাদা বলের ক্রিকেট থেকে এসেছে। রাহুল দ্রাবিড় বা চেতেশ্বর পুজারার মতো রক্ষণাত্মক ক্রিকেটাররা এখন পরশপাথরের মতো। সাদা বলে খেলা ক্রিকেটাররা ২০ বা ৫০ ওভারের ক্রিকেটে যে মানসিকতা নিয়ে খেলেন টেস্টে সেই ভাবে খেললে ম্যাচ দ্রুত শেষ হওয়া স্বাভাবিক। রক্ষণাত্মক ক্রিকেটার তৈরি না হওয়ার পিছনে ডিআরএসের ভূমিকা রয়েছে বলে মনে করেন অরুণ লাল। আনন্দবাজার অনলাইনকে তিনি বললেন, “এখন বোলারদের কাছে রিভিউ নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। আমাদের সময় টেস্টে ক্রিজ থেকে পা বার করে যখন খেলেছি, আম্পায়াররা অনেক সময়ই আউট দিতেন না। তাঁদের পক্ষে বোঝা সম্ভব ছিল না যে বল আদৌ উইকেটে লাগবে কি না। সেই সুযোগ নিত ব্যাটাররা। এখন সেটা সম্ভব নয়। ব্যাটারদের মধ্যে ভয় কাজ করে যে, রিভিউ নিলে আউট হয়ে যাব। তাই পা বার করে খেলার প্রবণতা কমে গিয়েছে। টেস্টে তাই রক্ষণাত্মক খেলাও এখন দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না।”
ভারতের শেষ ১৫টি টেস্ট খেলা সময়ের মধ্যে ঘরের মাঠে ভারত এক দিনের ম্যাচ খেলেছে ২৪টি। টি-টোয়েন্টি খেলেছে ৪০টি। অর্থাৎ ২০ বলের ক্রিকেট অনেক বেশি খেলেছে ভারত। দল বাছার ক্ষেত্রে আইপিএলের উপরও নির্ভর করছে ভারত। সাদা বলের ক্রিকেট যে প্রাধান্য পাচ্ছে তা স্পষ্ট। অরুণ বললেন, “সাদা বলের ক্রিকেটের প্রভাব তো অবশ্যই রয়েছে। ক্রিকেট খেলাটা আমাদের সময়ের থেকে বদলে গিয়েছে অনেক। রান রেট এখন অনেক বেশি থাকে। যে কারণে টেস্টে ফলাফল হচ্ছে। অনেক বেশি আকর্ষণীয় হয়ে গিয়েছে।”
দু’দিন বা তিন দিনে টেস্ট শেষ হয়ে যাওয়া আদতে ক্রিকেটের ক্ষতি করছে বলে মনে করছেন ভারতের হয়ে ১৬টি টেস্ট খেলা অরুণ। প্রাক্তন ক্রিকেটার বললেন, “বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনাল খেলতে চাইছে সকলে। ঘরের মাঠে তাই এমন পিচ বানাচ্ছে যা বোলারদের সুবিধা করে দিচ্ছে। এতে কিন্তু ক্রিকেটের ক্ষতি হচ্ছে। পাঁচ দিনের খেলা চলছে এত বছর ধরে। সেটাকে যদি আরও ২০০ বছর চালাতে হয় তা হলে চার-পাঁচ দিন খেলা হওয়া জরুরি। না হলে টেস্ট ক্রিকেট শেষ হয়ে যাবে বলে মনে হয় আমার।”
শুধু ভারতে যে টেস্ট তিন দিনে শেষ হয়ে যাচ্ছে, এমন নয়। বিশ্ব জুড়েই এমন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। অস্ট্রেলিয়া ঘরের মাঠে পেস সহায়ক পিচ বানাচ্ছে। ইংল্যান্ডের পিচে বাউন্স থাকছে বেশি। একাধিক কারণ দেখা যাচ্ছে দ্রুত টেস্ট শেষ হয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে। তবে একটা বিষয়ে সকলেই এক মত, ক্রিকেট পাল্টে গিয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy