ছিল ৭৫০ টাকা। হল ৯০০ টাকা!
কলকাতা নাইট রাইডার্সের ঘরের মাঠ ইডেন। সেখানে গত বছর কেকেআরের ম্যাচের টিকিটের ন্যূনতম দাম ছিল ৭৫০ টাকা। এ বার সেটা হয়েছে ৯০০ টাকা। নেপথ্যে কি ভারতের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জয়?
চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ফাইনাল ছিল ৯ মার্চ। তার ঠিক ১৩ দিনের মাথায় শুরু হবে আইপিএল। ভারতের ট্রফি জয়ের রেশ কাটার আগেই শুরু হয়ে যাবে কোটিপতি টি-টোয়েন্টি লিগ। উন্মাদনা রয়েছে, এখন থেকেই বোঝা যাচ্ছে। এ বারের আইপিএলের প্রথম ম্যাচ ইডেনে। কলকাতা নাইট রাইডার্স খেলবে বিরাট কোহলিদের রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরুর বিরুদ্ধে। বিক্রি শুরু হওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যেই শেষ হয়ে গিয়েছে টিকিট।

ইডেনে কেকেআর সমর্থকদের ভিড়। —ফাইল চিত্র।
শুধু ইডেনের টিকিট নয়, চেন্নাই সুপার কিংস বনাম মুম্বই ইন্ডিয়ান্স ম্যাচের টিকিট নিয়েও চাহিদা রয়েছে। সবচেয়ে বেশি বার আইপিএল জয়ী (পাঁচ বার করে) দু’টি দলের ম্যাচ রয়েছে চেন্নাইয়ে। ২৩ মার্চ সেই ম্যাচের টিকিট কালোবাজারে বিক্রি হচ্ছে। লোয়ার স্ট্যান্ডের একটি টিকিটের দাম উঠেছে ৮৫ হাজার ৩৮০ টাকা। কিছু টিকিটের দাম লাখ পেরিয়ে গিয়েছে।
সাধারণত আইপিএল নিয়ে আগ্রহ তৈরি হয় প্রতিযোগিতা শুরু হওয়ার কিছুটা পর থেকে। গত কয়েক বছর ধরে আইপিএলের শুরুর দিকের ম্যাচগুলির টিআরপি (টেলিভিশনে জনপ্রিয়তার মাপকাঠি) কম। সব দল পরস্পরের সঙ্গে অন্তত একটি করে ম্যাচ খেলার পর উৎসাহ বাড়তে শুরু করে। টিকিটের চাহিদা তুঙ্গে ওঠে প্লে-অফ পর্বে। কিন্তু এ বারের আইপিএল নিয়ে শুরু থেকেই রয়েছে উন্মাদনা। তার কারণ, এ বারের প্রতিযোগিতা শুধু বিরাট কোহলি, রোহিত শর্মা বা মহেন্দ্র সিংহ ধোনির নয়। উৎসাহ থাকবে বরুণ চক্রবর্তী, হর্ষিত রানা, অক্ষর পটেলদের নিয়েও। নেপথ্যে ভারতের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জয়।
ভারতকে কোনও এক জন ক্রিকেটার চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জেতাননি। বিভিন্ন ম্যাচে, বিভিন্ন ক্রিকেটার নায়ক হয়ে উঠেছেন। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যেমন পেসার মহম্মদ শামি ৫ উইকেট নিয়েছিলেন। সেই ম্যাচেই শতরান করেছিলেন ওপেনার শুভমন গিল। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে শতরান করেছিলেন কোহলি। নিউ জ়িল্যান্ডের বিরুদ্ধে গ্রুপ পর্বে আবার পাঁচ উইকেট নিয়ে চমকে দিয়েছিলেন বরুণ। সেমিফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ম্যাচ জিতিয়েছিলেন কোহলি। ফাইনাল জিতিয়েছিলেন রোহিত। গোটা প্রতিযোগিতায় ধারাবাহিক ভাবে মিডল অর্ডারে রান করেছিলেন শ্রেয়স আয়ার এবং অক্ষর পটেল। ভারতীয় বোলারেরাও সকলে উইকেট নিয়েছেন। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জয়ের নেপথ্যে ভারতের একাধিক নায়ক। ফলে আইপিএল নিয়ে উৎসাহিত হওয়ার মতো চরিত্র বেশি। তাঁদের নিয়ে আকর্ষণও তুঙ্গে।

চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জয়ের রাতে দেশে এমন ভাবেই মেতে উঠেছিলেন সমর্থকেরা। ছবি: এএফপি।
আরও পড়ুন:
এই রাজ্যের ক্রিকেট প্রশাসক নরেশ ওঝা মনে করেন, ভারতের জয় অবশ্যই আইপিএলের আকর্ষণ বৃদ্ধি করবে। আনন্দবাজার ডট কম-কে সিএবি (বঙ্গের ক্রিকেট নিয়ামক সংস্থা) সচিব বললেন, “ভারতের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জয় দেশের প্রত্যেকটা মানুষ উপভোগ করেছে। তার কয়েক দিনের মধ্যেই আইপিএল শুরু হচ্ছে। স্বাভাবিক ভাবেই তাই আইপিএল নিয়ে উৎসাহ থাকবে। প্রথম ম্যাচ থেকেই আমরা সেটা দেখতে পাব।”
গত বছর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জিতেছিল ভারত। সেই প্রতিযোগিতা ছিল আইপিএলের পর। এ বার আইপিএল শুরুর ঠিক ১৩ দিন আগে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জিতেছে ভারত। যে কারণে আগ্রহটা বেশি বলে মনে করা হচ্ছে। সেটা উপলব্ধি করেই হয়তো টিকিটের দাম বৃদ্ধি করা হয়েছে।
সকলে যদিও এমনটা মনে করছেন না। বাংলার রঞ্জিজয়ী অধিনায়ক সম্বরণ বন্দ্যোপাধ্যায় মনে করেন না চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির জন্য আইপিএলের উন্মাদনা বাড়বে। তাঁর মতে আইপিএল নিয়ে মানুষের আগ্রহ এমনিই রয়েছে। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির দর্শক আলাদা, আইপিএলের আলাদা। দু’টিকে মিলিয়ে ফেলা উচিত হবে না। তিনি আনন্দবাজার ডট কম-কে বললেন, “টেস্ট ক্রিকেটের দর্শক এবং আইপিএলের দর্শক যেমন আলাদা, তেমনই চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সঙ্গেও মিল নেই আইপিএলের। আইপিএল দেখতে যাঁরা মাঠে ভিড় করেন, তাঁরা আসেন উপভোগ করতে। ক্রিকেট না বুঝলেও খেলা দেখতে আসেন অনেকে। কিন্তু টেস্ট ক্রিকেটে সেটা হয় না। ক্রিকেটকে ভালবেসেই দর্শক মাঠে আসেন। তেমনই চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে ভাল খেলা ক্রিকেটারদের দেখতে মাঠ ভরবে, এমন ভাবার কোনও কারণ নেই। আইপিএল চলবে আইপিএলের মতোই। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জয়ের প্রভাব তার উপর পড়বে বলে মনে হয় না।”
আইপিএল মানে শুধু ক্রিকেট নয়। তাতে রয়েছে বিনোদনের ককটেল। শাহরুখ খান, প্রীতি জ়িন্টাকে দেখার জন্য মাঠে ভিড় করেন অনেকে। মাঠে চার-ছক্কার সঙ্গে চলে গান, নাচ। শুধুই ক্রিকেট দেখবেন বলে আইপিএলে মাঠে যান, এমন দর্শক হাতেগোনা। সেই দর্শকেরা ভারতের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জয়ের নায়কদের দেখার জন্য মাঠ ভরাবেন বলে মনে করছেন না সম্বরণ। তিনি বললেন, “আইপিএলে কোন ম্যাচে কে, কত রান করেছে জিজ্ঞেস করলে অধিকাংশ দর্শক বলতে পারবেন না। কিন্তু টেস্ট ক্রিকেটে সেটা হয় না। দর্শকেরা মনে রেখে দেন সব কিছু। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির মতো প্রতিযোগিতাতেও সেটা হয়।”

চেন্নাই সমর্থকদের ভিড়। —ফাইল চিত্র।
২০০৭ সালে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জিতেছিল ভারত। পরের বছর শুরু হয় আইপিএল। যা নিয়ে প্রথম থেকেই উৎসাহ ছিল তুঙ্গে। ধীরে ধীরে তা ক্রমশ বেড়েছে। ২০২২ সালে বোর্ডের একটি সূত্রকে উদ্ধৃত করে সংবাদ সংস্থা পিটিআই জানিয়েছিল, ২৩,৫৭৫ কোটি টাকায় টেলিভিশন স্বত্ব কিনেছে ডিজ়নি স্টার। ২০২৩ থেকে ২০২৭ সাল পর্যন্ত আইপিএলের টেলিভিশন স্বত্ব বিক্রি হয়েছে। ২০,৫০০ কোটি টাকায় আইপিএলের ডিজিটাল স্বত্ব কিনেছে ভায়াকম। আইপিএলের মোট সম্প্রচার স্বত্ব বিক্রি হয়েছে ৪৪,০৭৫ কোটি টাকায়। টেলিভিশনে ম্যাচপিছু মূল্য দাঁড়াচ্ছে ৫৭.৫ কোটি টাকা। ডিজিটাল মাধ্যমে ম্যাচপিছু মূল্য ৪৮ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে আইপিএলে প্রতিটি ম্যাচের সম্প্রচারমূল্য ১০৫ কোটি টাকা করে। এই সংখ্যাটি গোটা বিশ্বের খেলাধুলোর পরিপ্রেক্ষিতে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। শীর্ষে রয়েছে আমেরিকার রাগবি লিগ এনএফএল। আইপিএলের জনপ্রিয়তা কোন পর্যায়ে, তার একটি প্রমাণ অবশ্যই এই সম্প্রচার স্বত্ত্বের দাম।
সম্প্রচার স্বত্বের মূল্য আগামী দিনে আরও বাড়বে বলে দাবি করেন আইপিএলের চেয়ারম্যান অরুণ ধুমল। তিনি বলেন, “যদি গত ১৫ বছরে আইপিএলের উত্থান দেখি এবং কোনও আনুমানিক অঙ্ক বেছে নিই, তা হলে আমাদের প্রত্যাশা, আগামী ২০ বছরে আইপিএলের মিডিয়া স্বত্বের দাম ৪ লক্ষ কোটি টাকারও বেশি উঠবে।” প্রসঙ্গত, ২০০৮ সালে আইপিএল শুরু হওয়ার বছরে সম্প্রচার স্বত্ব বিক্রি হয়েছিল ৬ হাজার কোটি টাকায়। তখনই বিশ্বের অনেক লিগকে টপকে গিয়েছিল তারা।
ভারতের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জয় হয়তো আইপিএলের সম্প্রচার স্বত্বের উপর সরাসরি কোনও প্রভাব ফেলবে না। তবে বাড়িয়ে দিতে পারে প্রতিযোগিতা নিয়ে দর্শকদের উৎসাহ এবং আগ্রহ। যে কারণে টিকিটের দাম বাড়লেও পরোয়া করবেন না অনেকেই।