Advertisement
০৯ জানুয়ারি ২০২৫
Team India

দাদাগিরি উধাও, বিশ্বকাপে রোহিতদের দাপট শুধুই ‘বাচ্চাদের’ উপর! উঠছে একের পর এক প্রশ্ন

এশিয়া কাপে সুপার ফোর থেকে বিদায়ের পর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে সেমিফাইনালেই দৌড় শেষ রোহিতের ভারতের। কোচ দ্রাবিড়ের ‘আমি তো সবে এসেছি’ পর্বও শেষ হয়ে গিয়েছে। এ বার চাপ বাড়ার সময়।

ছবি: এএফপি

শান্তনু ঘোষ
শেষ আপডেট: ১০ নভেম্বর ২০২২ ২২:১১
Share: Save:

বড় ম্যাচ যেমন বড় ক্রিকেটার চিনিয়ে দেয়, তেমনই বড় প্রতিযোগিতা চিনিয়ে দেয় বড় দলকে। ভারত বার বার বড় প্রতিযোগিতাতেই ব্যর্থ। এ বারে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ খেলতে আসার আগে ঘরের মাঠে অস্ট্রেলিয়া এবং দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে ‘অনুশীলন’ করেছিল ভারত। পরিবেশের সঙ্গে অভ্যস্ত হওয়ার জন্য আগে অস্ট্রেলিয়া চলে যাওয়ার পরেও কাজের কাজ হল না। সেমিফাইনালে হেরেই ঘরে ফিরতে হচ্ছে রোহিত শর্মাদের।

এ বারের বিশ্বকাপে প্রথম ম্যাচে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ৪ উইকেটে জেতে ভারত। সেই ম্যাচে শেষ ওভারে ১৬ রান প্রয়োজন ছিল। ১৬০ রান তাড়া করতে নেমে হারের ভয় ভুরু নাচাচ্ছিল। শেষ রক্ষা করেন বিরাট কোহলি। তাঁর ব্যাট সেই ম্যাচ জিতিয়েছিল। ‘বিরাট’ জয় নিয়ে মাতামাতি শুরু করে দেয় ভারত। ঢেকে যায় স্পিনারদের ব্যর্থতা। চোখ এড়িয়ে যায় যে, ভারতের বোলাররা শেষ ৫ ওভারে ৫৩ রান দিয়েছেন। ওপেনারদের ব্যর্থতা তো ছিলই।

এই সব দুর্বলতা ভুলে ভারতের দাদাগিরি শুরু হয় নেদারল্যান্ডসের বিরুদ্ধে। যোগ্যতা অর্জন পর্ব খেলে উঠে আসা দুধুভাতু দলকে ৫৬ রানে হারিয়ে হুঙ্কার দিতে থাকেন ভারতীয় সমর্থকেরা। সেই ম্যাচে রোহিতের অর্ধশতরান দেখে মনে করা হয় তিনি তো রানে ফিরেই এসেছেন। নির্বিষ ব্যাটারদের বিরুদ্ধেও যে আরশদীপ সিংহ ৪ ওভারে ৩৭ রান দিয়েছেন, তা আলোচনার বিষয় হয় না। বিক্রমজিত সিংহ, কোলিন আকেরমানদের সামনে পেয়েও যে ভারত ১০ উইকেট তুলতে পারে না, সেটা ভুলেই যায় সকলে। রবিচন্দ্রন অশ্বিন, অক্ষর পটেলদের বিরুদ্ধে পুরো ২০ ওভার ব্যাট করে যান নেদারল্যান্ডসের ব্যাটাররা। ৫৬ রানে জয় তো এসেছে। ২ পয়েন্ট এসেছে। তাতেই খুশি হয়ে যান সকলে।

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ

ধাক্কাটা লাগে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে। ঘরের মাঠে যে দলকে হারিয়ে ছিল ভারত, অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে তাদের বিরুদ্ধে ভেঙে পড়ে রোহিত, বিরাট সমৃদ্ধ ব্যাটিং। ১৩৩ রানে শেষ হয়ে যায় ভারতের ইনিংস। সূর্যকুমার যাদব ছাড়া কোনও ব্যাটার রানই করতে পারেননি। ব্যাটাররা ব্যর্থ হতেই হাহাকার পড়ে যায় বোলারদের মধ্যে। অশ্বিন সেই ম্যাচে ৪ ওভারে ৪৩ রান দেন। অল্প রান হাতে নিয়ে তাঁর মতো অভিজ্ঞ বোলারের এমন হাল। মহম্মদ শামি ৪ ওভারে ১৩ রান দিয়ে একটি উইকেট নিয়েছিলেন। চেষ্টা করেছিলেন আটকে রাখার। কিন্তু অল্প পুঁজি নিয়ে তাঁর লড়াইও কাজে লাগেনি। ভারত হেরেই যায় ৫ উইকেটে।

পরের দু’টি ম্যাচ ছিল বাংলাদেশ এবং জ়িম্বাবোয়ের বিরুদ্ধে। ভারতের শক্তির বিচারে তারা খুব বেশি প্রতিরোধ গড়বে, এমন আশা সে দেশের খুব বেশি সমর্থক করেননি। তবু বাংলাদেশ ম্যাচে ভয় ধরিয়ে দিয়েছিলেন লিটন দাস। পাওয়ার প্লে-তে তিনি যে ভাবে ভুবনেশ্বর, আরশদীপদের মারতে শুরু করেছিলেন তাতে সিঁদুরে মেঘ দেখছিলেন ২০০৭ সালের ঘর পোড়ারা। বৃষ্টি এসে ম্যাচের ব্যাঘাত ঘটায়। ছন্দ কেটে যায় বাংলাদেশের। ভারতও ম্যাচে ফিরে আসে। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ৫ রানে কোনও মতে জয় আসে। দুর্বল জ়িম্বাবোয়ের বিরুদ্ধে নিয়মরক্ষার ম্যাচে ৭১ রান জয় আসে। গ্রুপ শীর্ষে থেকে কলার তুলে সেমিফাইনালে ওঠে ভারত। কিন্তু চোখ এড়িয়ে যায় ফাঁকগুলি। বোলারদের ব্যর্থতা, ওপেনারদের রান না পাওয়া, হার্দিকের রান না পাওয়া সবই ঢেকে যায় বিরাট এবং সূর্যের ব্যাটে।

সেমিফাইনালে হারের পর বেশ কিছু প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। পরের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ দু’বছর পর। তার আগে রোহিত, বিরাটরা টি-টোয়েন্টি থেকে অবসর নেবেন কি না সেই প্রশ্ন উঠছে। রাহুল দ্রাবিড় যদিও বৃহস্পতিবার বলেন, “এখনই এটা নিয়ে বলা উচিত হবে না। দু’বছর সময় আছে। এমন একটা ম্যাচের শেষে এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়। বেশ কিছু ভাল ক্রিকেটার রয়েছে দলে। আগামী দিনে অনেক ম্যাচ আছে। সেগুলিতে খেলে পরের বিশ্বকাপের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া যাবে।”

প্রশ্ন উঠছে রোহিতের অধিনায়কত্ব নিয়েও।

প্রশ্ন উঠছে রোহিতের অধিনায়কত্ব নিয়েও। ছবি: এএফপি

প্রশ্ন উঠছে রোহিতের অধিনায়কত্ব নিয়েও। বিরাটের নেতৃত্বে আগ্রাসন ছিল। কিন্তু রোহিতের মধ্যে সেটা প্রকাশ পায় না। ব্যাট হাতে রান পাচ্ছেন না। ম্যাচ জেতাচ্ছেন প্রাক্তন অধিনায়ক বিরাট। বৃহস্পতিবার যখন পাওয়ার প্লে-তে বাটলাররা ভারতীয় বোলারদের ঘুম ওড়াচ্ছেন, তখন হার্দিক পাণ্ড্যকে দেখা গেল দর্শকদের তাতাতে। আগামী সিরিজ়ে তিনিই নেতৃত্ব দেবেন ভারতকে।

ভারতের ফিল্ডিং নিয়েও যত কম বলা যায়, তত ভাল। স্বয়ং বিরাট ক্যাচ ফেলেছিলেন এ বারের প্রতিযোগিতায়। বৃহস্পতিবার মহম্মদ শামি যে ভাবে ফিল্ডিং করতে গিয়ে হাস্যকর ভাবে বল ছুড়লেন তা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ক্যাচ ফেলেছেন সূর্যকুমার। স্কোরবোর্ডে কম রান থাকলে অনেক দল ফিল্ডিং দিয়ে সেটা ঢেকে দিতে পারে। ভারত কিন্তু পারল না।

দলের বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। ফিনিশার হিসাবে বিশ্বকাপের আগে তৈরি করা হল দীনেশ কার্তিককে। কিন্তু সেমিফাইনালে খেললেন ঋষভ পন্থ। ডেথ বোলার হিসাবে ভাবা হচ্ছিল হর্ষল পটেলকে। তাঁকে বিশ্বকাপের আগে খেলানো হল পুরো দমে। কিন্তু প্রতিযোগিতায় তিনি বেঞ্চে বসে রইলেন। খেলতে দেখা গেল না যুজবেন্দ্র চহালকেও। দলের প্রধান স্পিনার ছিলেন তিনি। কিন্তু বিশ্বকাপে খেললেন অশ্বিন এবং অক্ষর পটেল। ব্যর্থ হওয়ার পরেও খেললেন। অক্ষরকে অলরাউন্ডার হিসাবে ভাবা হলেও তাঁকে সে ভাবে ব্যাট করতে পাঠানো হল না। বৃহস্পতিবার তাঁর আগে নামানো হয় অশ্বিনকে। বল হাতে অক্ষর যে বিরাট কিছু করেছেন তাও নয়। ছ’টি ম্যাচে নিয়েছেন মাত্র তিনটি উইকেট। অশ্বিন ছ’টি ম্যাচে নিয়েছেন ছ’টি উইকেট। এর মধ্যে জ়িম্বাবোয়ের বিরুদ্ধেই নিয়েছিলেন তিনটি।

আইপিএলে যশপ্রীত বুমরা, রবীন্দ্র জাডেজারা ফিরবেন। তাঁদের দলকে জেতাবেন। ভারতীয় সমর্থকরা আফসোস করবেন যে, বিশ্বকাপে তাঁদের পেলাম না। আরশদীপরা ঘরের মাঠে আইপিএলের দলের হয়ে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠবেন। কিন্তু আন্তর্জাতিক মঞ্চে খেলার চাপ সামলাতে ব্যর্থ হবেন। বৃহস্পতিবারের মতো রোহিত আবার ম্যাচ হেরে হয়তো বলবেন, “নক আউট পর্বে চাপ সামলানোই আসল। এই বিষয়টা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির উপর নির্ভর করে। চাপ সামলানোর বিষয়টা কাউকে শেখানো যায় না। চাপ নিয়ে খেলা দলের ছেলেদের কাছে নতুন নয়। আইপিএলের প্লে অফ ম্যাচ যখন খেলে তখনও প্রচুর চাপ থাকে। দলের সকলেই চাপ সামলাতে অভ্যস্ত। আসলে সেমিফাইনালে আমাদের বোলিং আক্রমণের শুরুটাই ঠিকঠাক হয়নি। সে সময় আমরা একটু স্নায়ুর চাপে ছিলাম। সেটাই একমাত্র কারণ নয়।” আর ভারতীয় দল সম্পর্কে শোনা যাবে, ‘বন্যেরা বনে সুন্দর আর ভারত আইপিএলে।’

কোচ দ্রাবিড়ের ‘আমি তো সবে এসেছি’ পর্বও শেষ হয়ে গিয়েছে।

কোচ দ্রাবিড়ের ‘আমি তো সবে এসেছি’ পর্বও শেষ হয়ে গিয়েছে। —ফাইল চিত্র

ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে সেমিফাইনালে ১০ উইকেটে হেরে জস বাটলারদের প্রশংসা করেন রাহুল দ্রাবিড়। তিনি বলেন, “বাটলার সাংঘাতিক ক্রিকেটার। আমরা আক্রমণ করার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু বল খুব বেশি সুইং করেনি। খেলাটা ইংল্যান্ডের হাতে চলে যায়। দুর্দান্ত ব্যাট করল ওরা। আমরা খেলাটার রাশ নিজেদের হাতে নিতে পারিনি। বাটলার অন্যতম সেরা টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটার।” কিন্তু যেটা বলেননি, সেটা হচ্ছে বোলাররা উইকেট নেওয়ার মতো বোলিংটাই করতে পারেননি। রোহিত সে কথা মনে করিয়ে দেন। তিনি বলেন, “ভুবনেশ্বর কুমারের প্রথম ওভারটা ঠিকঠাক হল না। ঠিক জায়গায় বলই রাখতে পারল না। আমাদের পরিকল্পনা ছিল আঁটোসাটো বল করা। ইংল্যান্ডের ব্যাটারদের মারার জায়গা না দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল আমাদের। উইকেটের দু’পাশের এলাকা নিয়ে সতর্ক ছিলাম আমরা। কারণ এই মাঠে উইকেটের দু’পাশে প্রচুর রান ওঠে। এই ম্যাচেও উঠেছে। ভাল বল করার পরেও ব্যাটাররা রান করলে বলার কিছু থাকে না। কিন্তু আমরা তো ভাল বলই করতে পারিনি।”

বোলারদের উপর হারের দায় চাপালেও প্রতিযোগিতায় নিজের ছন্দে না থাকা নিয়ে কিছু বলেননি ভারতীয় দলের অধিনায়ক। এ বারের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ছ’টি ম্যাচ খেলে মাত্র ১১৬ রান করেছেন রোহিত। গড় ১৯.৩৩। অর্ধশতরান একটি। সেটাও আবার নেদারল্যান্ডসের বিরুদ্ধে। আইসিসি প্রতিযোগিতা এলে রোহিত যে ভাবে বিধ্বংসী হয়ে উঠতেন, সেটা এ বার দেখা যায়নি।

ভারতের আরও বড় সমস্যা ছিল পাওয়ার প্লে। নিজেরা প্রথম ৬ ওভারে রান করতে পারেনি, বল হাতে আবার ওই পাওয়ার প্লে-তেই রান দিয়ে গিয়েছে ভারত। সেমিফাইনালে হেরে দ্রাবিড় নিজেও সেটা স্বীকার করেন। ভারতের কোচ বলেন, “আমি হতাশ। শুরুতে উইকেট নিতে পারলে আমরা ওদের চাপে ফেলতে পারতাম। প্রথম ৬ ওভারেই হেরে গিয়েছিলাম। দুই ইনিংসের প্রথম ৬ ওভারে ভাল খেলতে পারিনি। এই ম্যাচকে যদি পাঁচ ভাগে ভাগ করা হয় তা হলে আমরা চারটেতেই হেরে গিয়েছি। শুধু শেষ ৫ ওভারে আমরা ভাল ব্যাটিং করেছিলাম।”

প্রতিযোগিতা থেকে ছিটকে যাওয়ার পর এ সব বুঝে কোনও লাভ নেই সেটা দ্রাবিড় জানেন। ভারতে বিশ্বকাপ আসেনি ১১ বছর হয়ে গিয়েছে। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ এসেছিল ২০০৭ সালে। শেষ আইসিসি ট্রফি এসেছিল ২০১৩ সালে। সেটাও চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি। অধিনায়ক বিরাট কোহলিকে বার বার শুনতে হয়েছে যে, তাঁর ট্রফি ভাগ্য নেই। আইপিএল জেতেননি, বিশ্বকাপ জেতেননি। সেই কারণে রোহিতকে অধিনায়ক করার দাবি উঠেছিল। মুম্বইকর অধিনায়ক হয়েছেন। পাঁচ বারের আইপিএলজয়ী অধিনায়ক তিনি। কিন্তু নেতার মুকুট পরার পর থেকেই রান পাচ্ছেন না। দলে বিরাট, হার্দিক, সূর্যকুমারের মতো মেদহীন ক্রিকেটারদের মাঝে ভারত অধিনায়কের চেহারা নিয়েও কটাক্ষ শুরু হয়েছে।

এশিয়া কাপে সুপার ফোর থেকে বিদায়ের পর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে সেমিফাইনালেই দৌড় শেষ রোহিতের ভারতের। কোচ দ্রাবিড়ের ‘আমি তো সবে এসেছি’ পর্বও শেষ হয়ে গিয়েছে। এ বার চাপ বাড়ার সময়। নেতা হার্দিক গোকুলে বাড়ছেন কি না সেটার প্রমাণ পাওয়া যেতে পারে নিউজ়িল্যান্ড সফরে। ঘরের মাঠে পরের বছর ৫০ ওভারের বিশ্বকাপের আগে ক্রিকেটে শুধু আর্থিক ভাবে নয়, খেলাতেও ‘দাদা’ হিসাবে ভারতকে দেখতে চাইবেন সমর্থকরা।

অন্য বিষয়গুলি:

Team India T20 World Cup 2022 Rohit Sharma Rahul Dravid BCCI Hardik Pandya
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy