নায়ক: ১০ উইকেটে জয়ের উচ্ছ্বাস অ্যালেক্সের। ছবি সংগৃহীত।
গোটা ক্রিকেট দুনিয়া যখন ভারত-পাকিস্তান ফাইনাল দেখার আশায় প্রহর গুনছে, তখনই অন্য ছবি। ১৯৯২ বিশ্বকাপের মতোই পাকিস্তান বনাম ইংল্যান্ড ফাইনাল। ছিটকে গেল ফেভারিট ভারত। আবারও বোঝা গেল, কেন ক্রিকেটকে মহান অনিশ্চয়তার খেলা বলা হয়।
যখনই কেউ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে হারে, নানা মতামত উড়ে আসবেই। সমর্থকদের নিশ্চয়ই স্বপ্নভঙ্গ হয়, কিন্তু হিংসাত্মক প্রতিক্রিয়াও কাম্য নয়। সকলের মনে রাখা উচিত, সব চেয়ে বেশি যন্ত্রণাবিদ্ধ হয় পরাজিত ক্রিকেটারেরাই।
ম্যাচের শেষে যেমন দেখা গেল রোহিত শর্মার চোখে জল। কোচ রাহুল দ্রাবিড় সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু রোহিতকে যেন শান্ত করাই যাচ্ছিল না। পুরস্কার বিতরণীতেও দেখে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল, ভীষণই ভেঙে পড়েছে অধিনায়ক।
এই প্রতিক্রিয়া হওয়াটাই স্বাভাবিক কারণ ভারতকে অনেকেই ফেভারিট ধরছিলেন। বিশেষ করে পাকিস্তানকে প্রথম ম্যাচে বিরাট কোহলির অমন মহাকাব্যিক ইনিংসের জোরে হারিয়ে দেওয়ার পরে ভারতীয় দলকে নিয়ে প্রত্যাশা অনেক বেড়ে গিয়েছিল। গ্রুপ পর্বে ভারতই একমাত্র দল, যারা সব চেয়ে বেশি— চারটে ম্যাচ জিতে সেমিফাইনালে গিয়েছে। অন্যদের শেষ পর্যন্ত তাকিয়ে থাকতে হয়েছে অন্য দলের ফলাফলের উপরে। কিন্তু আবারও প্রমাণ হয়ে গেল, নক-আউটে গিয়ে অন্য খেলা, অন্য চাপ। সেই চাপ যারা নিতে পারে, তারাই চ্যাম্পিয়ন হওয়ার দাবিদার।
আরও একটি বিশ্বকাপ, আবারও স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণা। বারবার কেন এ ভাবে নক-আউটে গিয়ে হারছে ভারত? নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, নক-আউটে চাপ সামলানোটাই আসল। ওই দিনটায় যারা ফুরফুরে, খোলামেলা ভাবে দ্বৈরথকে উপভোগ করতে পারবে, তারাই সেরাটা দিতে পারবে। তাদেরই জেতার সম্ভাবনাই বেশি থাকে। বৃহস্পতিবার অ্যাডিলেডে ভারতের চেয়ে ইংল্যান্ডকেই কিন্তু বেশি চাপমুক্ত দেখিয়েছে। হার্দিক পাণ্ড্য যখন মারছে, তখনও কিন্তু নিয়ন্ত্রণ হারাতে দেখিনি ইংল্যান্ড অধিনায়ক জস বাটলারকে। ইংল্যান্ড নিঃসন্দেহে ভাল দল, কেউ ওদের হাল্কা ভাবে নেওয়ার সাহস দেখাবে না। দুর্ধর্ষ সব ম্যাচউইনার রয়েছে। তা বলে ভারত দশ উইকেটে হারবে, কেউ কি দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পেরেছিল?
ময়নাতদন্ত শুরু হয়ে গিয়েছে, আরও হয়তো হবে। এক্ষুনি দাঁড়িয়ে আমার যেটা মনে হচ্ছে, সেমিফাইনালে কয়েকটা ভুল হয়ে গেল। যেমন, কোনও সন্দেহ নেই ব্যাটিংয়ে কম রান হয়েছে। এই বিশ্বকাপে প্রথম ছয় ওভারে কখনও ভারতের ব্যাটিং ভাল হয়নি। তার কারণ রোহিত বা কে এল রাহুল, দু’জনের কেউ সেরা ফর্মে ছিল না। এ দিনও ছয় ওভারের পাওয়ার প্লে-তে উঠল ৩৮-১। সেখানে ইংল্যান্ড প্রথম ছয় ওভারেই তুলে ফেলল ৬৩-০। ইংল্যান্ডের দু’জন স্পিনার যখন বল করছিল, যথেষ্ট আক্রমণ করা হয়নি তাদের। আদিল রশিদকে অতিরিক্ত সমীহ করার তা-ও একটা কারণ থাকতে পারে। ও অভিজ্ঞ লেগস্পিনার, বৈচিত্র আছে। চার ওভারে ২০ রান দিয়ে এক উইকেট নিল রশিদ। কিন্তু লায়াম লিভিংস্টোনকেও আক্রমণ করব না? ওর তিন ওভারে মাত্র ২১ রান কেন? শেষের দিকে হার্দিক পাণ্ড্যর ৩৩ বলে ৬৩ রানের ঝড় না থাকলে ১৬৮-৬ স্কোরেও তো পৌঁছয় না দল। এই রানটাই মেরে ১৬ ওভারে তুলে দিয়ে দশ উইকেটে জিতে গেল ইংল্যান্ড। রানটা আরও কম হলে আরও কত একপেশে হত এই লড়াই?
দ্বিতীয়ত, নতুন বলে আরশদীপ সিংহকে সরিয়ে শুরুতেই অক্ষর পটেলকে আনা ঠিক হয়নি বলে আমার মনে হয়। গোটা বিশ্বকাপে দারুণ বল করেছে আরশদীপ। নতুন বলে ওর উপরে আর একটু আস্থা দেখানোই যেত। বোলিংয়ে কোনও কিছুই অবশ্য কাজে দেয়নি এমনই দাপুটে ব্যাটিং করে গেল ইংল্যান্ডের দুই ওপেনার। বাটলার (৪৩ বলে ৮০ অপরাজিত) এই মুহূর্তে সাদা বলের সেরা ব্যাটার। কী সব দুর্ধর্ষ শট খেলল, কী অবিশ্বাস্য সময়জ্ঞান! আর তেমনই আত্মবিশ্বাসী। সঙ্গে আলেক্স হেলস। বুঝতেই দিল না জনি বেয়ারস্টোর মতো অভিজ্ঞ, সফল ব্যাটার নেই। আয়ার্ল্যান্ডের কাছে অপ্রত্যাশিত ভাবে হেরে যাওয়ার পর থেকে ব্যাটিং নীতি পাল্টে ফেলেছিল ইংল্যান্ড। অতি আগ্রাসী মনোভাবে ফিরে গিয়েছে। এ দিন বাটলার-হেলস সেই ছকেই খেলে গেল। হেলস করল ৪৭ বলে ৮৬।
ভারতীয় বোলাররা পুরো বিশ্বকাপে দারুণ বল করেছে। কিন্তু সেমিফাইনালে সামান্যতম উদ্বেগও তৈরি করতে পারেনি ইংল্যান্ডের ব্যাটারদের মধ্যে। দু’টো দলের ব্যাটিং মনোভাবেও বেশ তফাত ধরা পড়েছে। ভারত কিছুটা হলেও রক্ষণাত্মক ছিল। ইংল্যান্ড অনেক বেশি আগ্রাসী। প্রমাণ? আলেক্স হেলস একাই মেরেছে সাতটা ছক্কা। ভারতীয় ব্যাটারেরা সবাই মিলে মেরেছে সমসংখ্যক ছক্কা। তার মধ্যে হার্দিক পাণ্ড্য একাই মেরেছে পাঁচটি ছক্কা। যুজ়বেন্দ্র চহালের মতো লেগস্পিনারকে বসিয়ে রাখা কি বড় ভুল হল? এই প্রশ্নও উঠতে বাধ্য। অস্ট্রেলিয়ায় অশ্বিনদের মতো ফিঙ্গার স্পিনারের (যারা আঙুলের ব্যবহারে স্পিন বল করায়) চেয়ে রিস্ট স্পিনারের (যারা কব্জির ব্যবহারে স্পিন করায়) সফল হওয়ার সুযোগ বেশি থাকে। তা ছাড়া লেগস্পিনার মানে উইকেট তোলার সম্ভাবনাও বেশি। টি-টোয়েন্টিতেও প্রতিপক্ষকে চাপে ফেলতে গেলে দ্রুত উইকেট তুলতেই হয়। ভারত উইকেট হারিয়েছিল বলেই চাপে পড়ে যায়, কম রান হল।
দীনেশ কার্তিক না ঋষভ পন্থ, কাকে খেলানো হবে তা নিয়েও দোনোমোনো করা হল। তবে একটা কথা বলি। একটা দল হারার পরে ছুরি-কাঁচি নিয়ে বসে মন্তব্য করা অনেক সহজ। সেই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হলে গরিষ্ঠ অংশ ফিনিশার হিসেবে সফল হওয়া কার্তিককে বসাতে চাইত না।
রোহিত শর্মা, বিরাট কোহলিরা দুর্দান্ত সব ম্যাচ জিতিয়েছে, অনেক গৌরব এনেছে দেশের জন্য। কিন্তু ওদের ট্রফি ক্যাবিনেটে সেই বিশ্বকাপ অধরা থেকে গেল। এটা যে কতটা যন্ত্রণার, ক্রিকেটার হিসেবে আমি বুঝি। আমরাও বিশ্বকাপ ফাইনালে উঠে পারিনি। মনে হয়েছিল, পৃথিবী ভেঙে পড়েছে। বারবার মনে হবে, কাপের এত কাছাকাছি এসেও পারলাম না! রোহিত, বিরাটদের বিনিদ্র রজনী যাবে এখন। খেলার যে দু’টো পিঠই থাকে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy