ঐতিহাসিক: ম্যাকগ্রার পতন। অস্ট্রেলিয়ারও। ইডেন টেস্ট জয়ের উৎসব হরভজন ও সৌরভের। —ফাইল চিত্র।
স্টিভ ওয়ের অস্ট্রেলিয়া আসছে আর কয়েক দিন পরেই। স্টিভের দল তখন অশ্বমেধের ঘোড়া ছোটাচ্ছে। টানা চোদ্দোটা টেস্ট জিতে আসছে ভারতে। রীতিমতো ‘বর্গিরা এল দেশে’র মতো ভয় ধরানো আগমন।
আরও ভয়ের কথা, কাঁধের বড় অস্ত্রোপচারে সিরিজ়ে নেই অনিল কুম্বলে। প্রাক-সিরিজ় এক সাক্ষাৎকারে তরুণ ভারত অধিনায়ককে প্রথম প্রশ্নই করা গেল, কুম্বলে নেই...। বেহালার বাড়িতে বসে মাঝপথেই থামিয়ে দিলেন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়... ‘‘কুম্বলে নেই, বড় ক্ষতি। কিন্তু একটা নতুন ছেলে আছে। হরভজন সিংহ। ওকে খেলা কিন্তু সহজ হবে না!’’
তখন কে হরভজন সিংহ? না, যাঁর একমাত্র পরিচয় শৃঙ্খলাভঙ্গের দায়ে জাতীয় অ্যাকাডেমি থেকে বিতাড়িত হয়েছেন। পঞ্জাবের রাজ্য দল থেকেও বাদ পড়ছিলেন। শুভানুধ্যায়ী কয়েক জন অগ্রজ প্রচণ্ড বিরূপ কর্তাদের আটকান। কয়েক দিনের মধ্যেই বাবাকে হারিয়ে আরওই যেন পৃথিবী ভেঙে পড়ল মাথার উপরে। উদভ্রান্তের মতো আমেরিকা আর ইংল্যান্ডে বন্ধুদের ফোন করছেন। কেউ বিদেশে গাড়ি চালাচ্ছে, কেউ পেট্রল পাম্পে কাজ করছে, কেউ ডিপার্টমেন্টাল স্ট্রোর্সে চাকরিরত। বিধ্বস্ত, বিপর্যস্ত গলায় আর্তি, ‘‘তোদের কাছে কোনও চাকরির খবর আছে তো বল। পেট্রল পাম্পের কাজ হলেও চলবে। অসহ্য লাগছে এখানে আমার।’’
মনস্থিরই করে ফেলেছেন, বিদেশে গিয়ে বন্ধুদের সাহায্যে কাজ জুটিয়ে নিয়ে সেখান থেকে আয় করা টাকা বাড়িতে পাঠাবেন। তখন কে ভেবেছিল, ক্রিকেট বিধাতা পেট্রল পাম্পের চাকরি নয়, তাঁকে বেছে রেখেছেন বিশ্বজয়ী অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে স্পিনের মায়াজালে মহাকাব্য লেখার জন্য!
ও দিকে, কুম্বলেহীন ভারতীয় বোলিং সেই সময় আইসিসিইউ-তে ঢুকে পড়েছে। নবাগত বাংলাদেশকে অভিষেক টেস্টে চারশো তুলতে দিয়েছে। দেশের মাঠে জ়িম্বাবোয়ের অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার মনের সুখে সুইপ-রিভার্স সুইপ মেরে গিয়েছেন শরণদীপ সিংহ, মুরলী কার্তিক আর সুনীল জোশীকে। বলাবলি শুরু হয়ে গিয়েছে, বাংলাদেশ আর জ়িম্বাবোয়ের সামনেই এই হাল! তাহলে ম্যাথু হেডেন, অ্যাডাম গিলক্রিস্ট, স্টিভ ওয়রা তো রোডরোলারের মতো পিষে দিয়ে যাবে! তার উপরে শ্রীনাথও নেই। অস্ট্রেলিয়ার বোলিং শুরু করছেন গ্লেন ম্যাকগ্রা, জেসন গিলেসপি। তার পরে আসবেন শেন ওয়ার্ন। আর এ দিকে তরুণ জাহির খানের সঙ্গে নতুন বলে সৌরভ, মাঝখানে কোথাকার কে এক নতুন ছোকরা হরভজন সিংহ!
সৌরভ কিন্তু তত ক্ষণে পাখির চোখ দেখতে শুরু করেছেন। অস্ট্রেলিয়া সিরিজ়ের আগে পঁচিশ জন সম্ভাব্যকে নিয়ে শিবির বসল চেন্নাইয়ে। সেখানেই ‘ভাজ্জি-আবিষ্কার’ অধিনায়কের। কোচ জন রাইটকে নেটের পিছনে এনে দাঁড় করিয়ে বলে দিয়েছিলেন সৌরভ, ‘‘এই ছেলেটার বোলিং দ্যাখো, জন। মনে হচ্ছে আমাদের প্রধান স্পিনারের খোঁজ পেয়ে গিয়েছি।’’ সব চেয়ে বেশি তাঁদের প্রভাবিত করেছিল, যে পরিমাণ বাড়তি বাউন্স আদায় করে নিতে পারছিলেন তরুণ হরভজন। তাঁর হাত থেকে ছাড়া পাওয়া বল পিচে পড়ে লাফাচ্ছিল যেন পিংপং বলের মতো!
কিন্তু অধিনায়ক ভাবলেই কী আর সব ভোজবাজির মতো হয়ে যায় ভারতীয় ক্রিকেটে? নির্বাচক কমিটির বৈঠকে ঝড় বয়ে গেল। নির্বাচকেরা কিছুতেই নেবেন না হরভজনকে। তাঁরা অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে নাগপুরে প্রস্তুতি ম্যাচেই রাখেননি অখ্যাত, তরুণ স্পিনারকে। জোর করে শেষ মুহূর্তে ঢোকানো হয়। ভিভিএস লক্ষ্মণ সেই ম্যাচে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন ভারতীয় ‘এ’ দলের। লাঞ্চ বিরতিতেই তাঁর কাছে ফোন চলে এল সৌরভের। উদগ্রীব অধিনায়ক তখনই যে জানতে চান, কোন স্পিনার ভাল বল করছে। লক্ষ্মণ জানান হরভজনের কথা। তত দিনে ক্যাম্পে তাঁকে দেখে নিয়েছেন সৌরভ। সঙ্গে সঙ্গে অধিনায়কের পরামর্শ, ‘‘ওকে আর বল দিস না তো। অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটসম্যানদের প্র্যাক্টিস দিতে যাব কেন?’’ ওই কথোপকথনের মধ্যেই তিনি ঠিক করে ফেলেছেন, স্টিভদের বিরুদ্ধে তাঁর এক নম্বর স্পিনার কে হতে যাচ্ছে! ও দিকে, নির্বাচক কমিটির চেয়ারম্যান চাঁদু বোড়ে আবার লক্ষ্মণকে জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপার ওকে বোলিং থেকে সরিয়ে নিলে কেন? লক্ষ্মণ বললেন সৌরভের বার্তার কথা। বোড়ে শুনতে নারাজ, ‘‘না, না, ওকে বোলিং করাও। ও কেমন বোলার, আমাদের দেখতে হবে তো!’’ টেস্টের দল নির্বাচনী বৈঠকেও চলল অধিনায়ক বনাম নির্বাচক দ্বন্দ্ব। নির্বাচকদের পছন্দ শরণদীপ সিংহ। সৌরভও দল নির্বাচনী বৈঠক ছেড়ে উঠবেন না, যত ক্ষণ না হরভজনের নাম লেখা হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত অধিনায়কের জেদাজেদির কাছে হার মানতে বাধ্য হন নির্বাচকেরা।
হরভজনও যেন এর পরেই পাল্টে যাওয়া এক চরিত্র। ‘‘অস্ট্রেলিয়া সিরিজ় আমার জীবন ঘুরিয়ে দিয়েছিল। কী করে ভুলব?’’ এক বার বলেছিলেন তিনি। বলেছিলেন, ‘‘নিজেকে আলাদা ভাবে তৈরি করেছিলাম। ফিটনেস বাড়ানোর জন্য মাঠে প্রচুর দৌড়তাম। পনেরো পাক, কুড়ি পাক, পঁচিশ পাক, তিরিশ পাক— কোনও হিসাব থাকত না। নিজেকে প্রমাণ করার একটা পাগলামি যেন পেয়ে বসেছিল আমার মধ্যে। জানতাম, এটাই আমার শেষ সুযোগ। হয় সফল হয়ে দেখাও, নয়তো নিপাত যাও চিরতরে।’’ আর সারাজীবন কৃতজ্ঞ থেকেছেন অধিনায়ক সৌরভের কাছে। কখনও আনুগত্য প্রকাশে অনীহা দেখাননি। গুরু গ্রেগ-সৌরভ মহাবিতর্কে প্রকাশ্যে দাঁড়িয়েছিলেন অধিনায়কের পাশে।
তিন টেস্টে ৩২ উইকেট নিয়ে স্টিভের অস্ট্রেলিয়াকে ধ্বংস করেন হরভজন। ইডেনে হ্যাটট্রিকের পরে কলকাতার হোটেলে বসে ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে চোখে জল এসে গিয়েছিল তাঁর। বারবার স্মরণ করেছিলেন প্রয়াত বাবাকে। মনে হয়েছিল, ক্রিকেট মাঠের এক দুর্ধর্ষ বোলিং কীর্তিই শুধু নয়। টেস্টে ভারতীয় বোলারের প্রথম হ্যাটট্রিকই খালি নয়। খড়কুটোর মতো উড়ে যেতে বসা এক যুবকের জীবনের রাস্তায় পুনর্বাসন ঘটিয়েছিল ২০০১-এর ইডেন। ক্রিকেটের ইতিহাসে তিন টেস্ট বা তার কম ম্যাচের সিরিজ়ে তাঁর চেয়ে বেশি উইকেট নিতে পেরেছেন তিন জন। কী সব নাম তালিকায়! জর্জ লোম্যান, ১৮৯৬-তে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে ৩৫ শিকার। সিডনি বার্নস, ১৯১২-তে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে ৩৪ উইকেট। রিচার্ড হ্যাডলি, ১৯৮৫-তে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ৩৩ শিকার।
ইডেনের সেই মহাকাব্যিক টেস্টে লক্ষ্মণ-দ্রাবিড়ের সারাদিন ধরে ব্যাট করার মতো অলৌকিক ঘটনা না ঘটলে ঐতিহাসিক জয় আসত না, একদম ঠিক কথা। হরভজনের হ্যাটট্রিকের পরেও শোনা যায়, তৃতীয় দিনের শেষে ভারতীয় দলের প্রত্যেকের ব্যাগেজ পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল বিমানবন্দরে। ধরেই নেওয়া হয়, ফলো-অনের গিলোটিনে মাথা কাটা যাচ্ছে। লক্ষ্মণ-দ্রাবিড়ের অবিশ্বাস্য লড়াইয়ের পরে সেই রাতেই তড়িঘড়ি ব্যাগপত্তর ফিরিয়ে আনতে হয়।
তবু কে ভুলতে পারবে, ইডেনের লাখো জনসমুদ্রকে উত্তাল আবেগে ভাসিয়ে বিষাণ সিংহ বেদীর পরে ভারতীয় ক্রিকেটে নতুন এক স্পিন-সর্দারের আবির্ভাব! তারুণ্যের স্ফূর্তিতে পাখির মতো ডানা মেলে উড়ে বেড়ানো। দু’হাত উপরে তোলা ‘হাই আর্ম অ্যাকশন’-এ স্পিনের মায়াজাল তৈরি করা। অভাবনীয় বাউন্স, যা চমকে দিয়েছিল হেডেন, গিলক্রিস্টদের। ওই হ্যাটট্রিকই যে বিশ্বাস ফেরাতে শুরু করে শিবিরে।
কে ভেবেছিল, উল্টো দিকে থাকা কিংবদন্তি শেন ওয়ার্নকে টেক্কা দিয়ে নায়ক হবে উনিশ বছরের এক আনকোরা মুখ! হ্যাটট্রিকের শেষ শিকার ছিলেন ওয়ার্নই। প্রথম দু’জন রিকি পন্টিং এবং অ্যাডাম গিলক্রিস্ট। যিনি ভারতে এসেছিলেন চোদ্দোটি টেস্টের একটিতেও না হেরে। সেটাই পনেরো হয়ে গেল মুম্বইতে জিতে। কে ভুলতে পারবে, উদ্বেগের প্রহর কাটিয়ে রুদ্ধশ্বাস শেষ শিকার! গ্লেন ম্যাকগ্রা এলবিডব্লিউ হরভজন সিংহ! যতই আম্পায়ার এস কে বনসলের আঙুল নিয়ে বিতর্ক থাকুক, সারাজীবনের সংগ্রহশালায় থেকে যাবে গ্যালারির মশাল জ্বেলে মায়াবী উৎসব এবং এক তরুণকে আপন করে নেওয়া। ইডেনে সে দিন সত্যিই যে ‘সিং ইজ় কিং’!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy