সচিনের জন্মদিনে পরবর্তী সচিন কি পাওয়া গেল ফাইল ছবি
মুম্বই ইন্ডিয়ান্স বনাম চেন্নাই সুপার কিংস ম্যাচের মাঝে সঞ্চালক হর্ষ ভোগলের সঙ্গে কথাবার্তার ফাঁকে একটি কথা বলেছিলেন তিনি, “জীবনে কোনও দিন নিজের রান আর বয়স গুনিনি।”
এই একটি কথাই বোধ হয় বাকিদের থেকে তাঁকে আলাদা করে দেয়। তিনি, অর্থাৎ সচিন তেন্ডুলকর এমন একজন ক্রিকেটার বা মানুষ যাঁকে নিছক বয়স বা পরিসংখ্যান দিয়ে মাপা যায় না। তিনি তার চেয়েও অনেক বড়। খেলা ছেড়ে দেওয়ার পর প্রায় দশ বছর পেরোতে চলল। এখনও তিনি আপামর ভারতীয়ের কাছে একটা আবেগ, একটা চরিত্র। বছরের পর বছর ভারতীয় ক্রিকেটের মহাকাশে একের পর এক তারা, নক্ষত্রের উদয় হয়েছে। কেউ থেকে গিয়েছেন, কেউ কালের নিয়মে মিলিয়ে গিয়েছেন। কিন্তু আর একটি সচিন সম্ভবত এখনও দেখা যায়নি।
আরও একটা ২৪ এপ্রিল। জীবনের ৪৮টি বসন্ত পার করে ফেললেন সচিন। ক্রিকেট মাঠে তাঁকে দেখতে পেলে এখনও সমান আবেগ দেখা যায় ভারতীয় ক্রিকেট সমর্থকদের মনে। মাঠে তখন যে-ই খেলুন না কেন, গ্যালারি থেকে যে ‘সচিন, সচি-ই-ই-ইন’ বলে আওয়াজটা ওঠে, সেটা বহু পরিচিত। বছরের পর বছর ধরে এই চিৎকারই করে এসেছে ভারতীয় সমর্থককুল। সচিন এখানেই বাকিদের থেকে আলাদা। তিনি এমন একটি চরিত্র, যার কোনও বিকল্প হয় না। বিকল্প পাওয়া যায় না।
সচিন আসার আগেও চরিত্র পেয়েছে ভারতীয় ক্রিকেট। সেই পঙ্কজ রায় বা বিনু মাঁকড়কে দিয়ে শুরু। আন্তর্জাতিক আঙিনায় ভারতীয় ক্রিকেটকে যদি কেউ পরিচিতি দিয়ে থাকেন, তা হলে সেটা তাঁরাই। এর পর এসেছেন মনসুর আলি খান পটৌদি। ইংরেজ, ক্যারিবীয়, অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটাররা একটা সময় যে দাপট দেখাতেন, সেই দাপটে থাবা বসাতে শুরু করে পটৌদির নেতৃত্বাধীন ভারতীয় দল।
তার পর এলেন সুনীল গাওস্কর, কপিল দেবরা। ভারত ক্রিকেট বিশ্বকাপ জিতল। রাতারাতি পরিচিতি পেয়ে গেল ক্রিকেটবিশ্বে অনেকটা পিছিয়ে থাকা ভারত। গাওস্কর এবং কপিল বাকিদের ছাপিয়ে নিজেদের অনেকটাই উঁচুতে নিয়ে গেলেন। হিসেবের বাইরে থাকা একটা দলকে বিশ্বকাপে ক্যারিবীয়, অস্ট্রেলীয়দের চোখে চোখ রেখে লড়াই করতে শিখিয়েছিলেন কপিল। আর সেই লড়াই মাঠে নেমে কী করে করতে হয়, সেটা দেখিয়ে দেন গাওস্কর। হেলমেট ছাড়াই কী ভাবে দাপুটে ক্যারিবীয় বোলারদের তিনি সামলেছেন, সেটা এখন রূপকথার পর্যায়ে।
ভারত যখন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে মোটামুটি প্রতিষ্ঠা পেয়ে গিয়েছে, তখনই আবির্ভাব সচিনের। প্রথমেই তাঁকে ফেলে দেওয়া হল কড়া পরীক্ষার সামনে। পাকিস্তানে গিয়ে সামলাতে হল ওয়াসিম আক্রম, ওয়াকার ইউনিসদের। সেই পরীক্ষায় সসম্মানে উত্তীর্ণ হলেন। সেই শুরু। এর পর গড়েছেন একের পর এক রেকর্ড। নামের পাশে বসেছে একের পর এক কীর্তি। খেলা যখন ছাড়লেন, তখন নিজেকে এমন উচ্চতায় তুলে নিয়ে গেলেন যেখানে হয়তো আর কারওর পক্ষেই পৌঁছনো সম্ভব হবে না।
বিরাট কোহলী আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রবেশ করেন ২০০৮ সালে। ভারতকে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ জেতানোর সময় থেকেই তাঁর সঙ্গে সচিনের তুলনা শুরু হয়ে গিয়েছিল। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে যত তিনি প্রভাব বিস্তার করতে থাকলেন, তত সেই তুলনা বাড়তে থাকল। এক সময় সত্যিই মনে হল, সচিনকে যদি কেউ টপকে যাওয়ার ক্ষমতা রাখেন, তা হলে তিনি বিরাট কোহলী। সেই ফুটওয়ার্ক, সেই শটের বৈচিত্র, সেই স্ট্রেট ড্রাইভ– কত সাদৃশ্য!
নিমেষের মধ্যেই কোহলীকে নিয়ে মানুষের আগ্রহ তৈরি হয়ে গেল। সচিন খেলা ছেড়ে দেওয়ার পর দুঃখে যাঁরা আর ক্রিকেট দেখবেনই না বলে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, তাঁরা আবার বসতে লাগলেন টিভির সামনে। চেষ্টা করলেন পুরনো দিনের স্মৃতি ফেরানোর। প্রথম দিকে সেই স্মৃতি ফিরেছিল অনেকটাই। খোদ সচিনও সেই সময় কোহলীর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। কিন্তু শুধু পরিসংখ্যান দিয়ে সচিনের উচ্চতায় নিজেকে তোলা যায় না। দেরিতে হলেও অচিরেই সেটা বুঝতে পারলেন সমর্থকরা।
মাঠে সচিন ছিলেন শান্ত, ধীরস্থির, নিজের কাজে মনোযোগী ক্রিকেটের এক ছাত্র। কোনও প্রতিপক্ষের সঙ্গে তিনি বাক্যুদ্ধে জড়িয়েছেন এমন দৃশ্য সম্ভবত কেউ মনে করতে পারবেন না। স্লেজিং নামক জিনিসটির থেকেও সচিন ছিলেন বহু যোজন দূরে। ফলে শুধু রান বা শতরানের বিচারে নয়, মাঠের বাইরে স্বভাবের দিক থেকেও বাকিদের তুলনায় অনেকটাই এগিয়েছিলেন সচিন। ঠিক তাঁর উল্টো আসনে অবস্থান করেন কোহলী। প্রতিপক্ষের চোখে চোখ রেখে কথা বলা, বিপক্ষের ক্রিকেটারদের সঙ্গে ঝামেলায় জড়ানো, সমর্থকদের উদ্দেশে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি, মাঠেই অশ্লীল শব্দপ্রয়োগ। সচিনের সঙ্গে তাঁর অমিল খুঁজতে বসলে এ রকম অনেক কারণই পাওয়া যাবে। ফলে পকেটে যতই রান থাকুক না কেন, ঠিক আক্ষরিক অর্থে সচিন হয়ে ওঠা এখনও হল না কোহলীর।
সচিন যে রকম ছিলেন, তাঁর সঙ্গে আর এক জনের অনেক মিল পাওয়া যাবে। আন্দাজ করার দরকার নেই। সেই ব্যক্তির নাম মহেন্দ্র সিংহ ধোনি। সেই ঠান্ডা মাথা। নম্র, ভদ্র ব্যবহার, প্রতিপক্ষকে শান্ত মাথায় জবাব দেওয়ার ক্ষমতা, সবই তাঁর ছিল। কিন্তু উইকেটরক্ষক বা মিডল অর্ডার ব্যাটার বলেই হয়তো রান বা পরিসংখ্যানের বিচারে সচিনের সমকক্ষ কোনও দিন হতে পারেননি তিনি। তবে ধোনি যে রকম মাটির কাছাকাছি থাকা মানুষ, তাতে কোনও দিন সচিনের সঙ্গে তুলনা হলে মানতেন কিনা সন্দেহ রয়েছে!
শুধু এই দু’জনই নন, পরেও সচিনের সঙ্গে তুলনা টানা হয়েছে এক জনের। তিনি পৃথ্বী শ। সঠিক সচিনের মতোই উচ্চতা, সচিনের মতো কপিবুক কভার ড্রাইভ বা স্ট্রেট ড্রাইভ। তা ছাড়াই দু’জনেই মুম্বইকর। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আবির্ভাবেই শতরান করে নজর কেড়েছিলেন পৃথ্বী। কিন্তু তিনিও সম্ভবত কালের গর্ভে হারিয়ে যেতে চলা আরও এক নাম। জাতীয় দল থেকে এখন অনেকটাই দূরে। নিজের জাত চেনানোর মঞ্চ বলতে তাঁর কাছে এখন শুধু আইপিএলই রয়েছে। সেখানেও তিনি ধারাবাহিক নন।
গাওস্কর, কপিল, পটৌদি, ধোনি, কোহলী— সচিনের সঙ্গে তুলনা করার জন্য ক্রিকেটারের কোনও কমতি নেই। বারে বারে উঠতি প্রতিভা দেখলেই তাঁকে নিয়ে শুরু হয়ে গিয়েছে সচিনের সঙ্গে তুলনা। কিন্তু সব দিক মাথায় রেখে এটা এখনও অন্তত বলা যায়, ভারতীয় ক্রিকেট এখনও কোনও সচিন খুঁজে পায়নি। কারণ সচিনের বিকল্প হয়নি। হয়তো হবেও না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy