তিন প্রজন্ম: ছেলে এবং নাতি রাচিনকে (মাঝখানে) ঠাকুর্দা আদিগা। —নিজস্ব চিত্র।
নিউ জ়িল্যান্ডের টিম হোটেল থেকে বেঙ্গালুরুর উইলসন গার্ডেনের ওই বাড়িটার দূরত্ব ৫-৬ কিলোমিটারের মধ্যেই হবে। দিন দু’য়েক আগে এক জন বিশেষ অতিথি সেখানকার বাসিন্দা, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ড. টি এ বালাকৃষ্ণ আদিগার বাড়িতে পা রেখেছিলেন। সেই অতিথির জন্য দক্ষিণ ভারতীয় খাদ্যও বানিয়ে রেখেছিলেন বাড়ির কর্ত্রী।
অতিথি আর কেউ নন। এই মুহূর্তে বিশ্বকাপের তৃতীয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রহকারী, নিউ জ়িল্যান্ডের ওপেনার রাচিন রবীন্দ্র। আগামী বুধবার, বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে যাঁর বিরুদ্ধে লড়াই ভারতীয় বোলারদের।
অতিথি বলা বোধ হয় ঠিক হল না। নিজের বাড়িতে কি কেউ অতিথি হয়! ওই বাড়ি যে রাচিনের ঠাকুর্দারই বাড়ি। আর ড. আদিগা হলেন এই বিশ্বকাপের চমক, রাচিনের ঠাকুর্দা।
‘‘আমার নাতি দক্ষিণ ভারতীয় খাবার খুব পছন্দ করে। যে কারণে ওর জন্য দোসা, ইডলি, উত্তাপাম, এই সব তৈরি করে রাখা হয়েছিল,’’ নিজের বাড়ি থেকে বলছিলেন ড. আদিগা। কিন্তু দুঃখের বিষয় হল সেই সব খাবার নাতিকে খাওয়াতে পারেননি ঠাকুর্দা-ঠাকুমা। ঠাকুর্দার আক্ষেপ, ‘‘ইডলি-দোসা রাচিনের খুব প্রিয় খাবার। কিন্তু আমাদের কাছে এসেও খেতে পারল না। টিম ম্যানেজমেন্টের কঠোর নিয়মের মধ্যে রয়েছে ও। এই সব খাবার খেতে পারবে না। আমরাও আর জোর করিনি।’’
আগেও অনেক বার নাতি এসেছিল তাঁর বাড়িতে। কিন্তু এ বার যে পরিস্থিতিটা সম্পূর্ণ আলাদা। এ বার যে তাঁর নাতি তারকা হয়ে গিয়েছে। গর্বিত ঠাকুর্দা বলছিলেন, ‘‘এর আগে অনেক বারই রাচিন এসেছে আমাদের বাড়িতে। কিন্তু সেগুলোর সঙ্গে এই বারের আসাটার কোনও তুলনা হয় না। এ বার ও এসেছে অসাধারণ পারফরম্যান্স করে। সবাই ওর নাম জানে এখন। নাতির জন্য আমরা ভীষণই গর্বিত।’’
বিশ্বকাপে অবিশ্বাস্য ছন্দে ব্যাট করছেন ২৩ বছর বয়সি এই তরুণ। ৯ ম্যাচে তিনটি শতরান-সহ রাচিনের সংগ্রহ ৫৬৫ রান। তাঁর আগে আছেন বিরাট কোহলি এবং কুইন্টন ডি’কক। রাচিনের দু’টো ম্যাচ চিন্নাস্বামী স্টেডিয়ামে বসে দেখেছেন ঠাকুর্দা। এ বার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লড়াই। ওয়াংখেড়েতে ভারতের বিরুদ্ধে সেমিফাইনাল। সেই ম্যাচ দেখতে মুম্বই যাবেন না? ড. আদিগা জবাব দিলেন, ‘‘আমার শরীরটা একদম ভাল নেই। এখানে দু’টো খেলা দেখেছি। সেমিফাইনালটা বাড়িতে বসেই দেখব।’’
বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে ভারতকে সমস্যায় ফেলতে পারেন এক জন ভারতীয় বংশোদ্ভূত তরুণই। ওপেন করতে নেমে ধারাবাহিক ঝড় তুলছেন এই বাঁ-হাতি ব্যাটসম্যান। ১৫ নভেম্বর যখন টিভির সামনে বসবেন তিনি, তখন প্রায় ধর্মসঙ্কটে পড়ে যাবেন আদিগা। এক দিকে নাতি, অন্য দিকে দেশ। কোন দিকে ঝুঁকবেন তিনি? ঠাকুর্দা হেসে ফেললেন। ‘‘খুবই কঠিন পরিস্থিতি সন্দেহ নেই,’’ বলছিলেন তিনি, ‘‘আমি রাচিনকেও সমর্থন করি, ভারতকে তো করিই।’’ নাতির সাফল্য যেমন চান তিনি, সে রকমই নিজের দেশকে বিশ্বকাপ ফাইনালেও দেখতে চান। পরিষ্কার বললেন, ‘‘রাচিনের প্রতি শুভকামনা রইল। প্রার্থনা করি, ও সাফল্য পাক। কিন্তু পাশাপাশি চাইব, নিউ জ়িল্যান্ডকে হারিয়ে ভারত ফাইনালে উঠুক।’’
বিশ্বকাপের মতো বিশাল মঞ্চে রাচিনের এই রকম ব্যাটিংয়ের রহস্য কী? এই চাপ এত ঠান্ডা মাথায় সামলাচ্ছেনই বা কী করে? যে লোকটি খুব ছোট থেকে দেখেছেন রাচিনকে, তাঁর জবাব, ‘‘ওর মানসিকতার কোনও তুলনা নেই। এমনিতে শান্ত, নরম স্বভাবের ছেলে। কোনও রকম অহঙ্কার নেই। কিন্তু কঠিন ধাতুতে তৈরি। কোনও কিছুতেই ঘাবড়ায় না।’’ যোগ করেন, ‘‘তা ছাড়া ও যখন মাঠে নামে, ক্রিকেট ছাড়া অন্য কিছু ভাবে না। এতটাই ওর মনঃসংযোগের মাত্রা যে, বাইরের কোনও কিছুই ওকে টলাতে পারে না।’’
গত শুক্রবার রাচিন বেশ কয়েক ঘণ্টা কাটিয়ে গিয়েছিলেন উইলসন গার্ডেনের বাড়িতে। কী কথা হয়েছিল দু’জনের? আদিগা বলেন, ‘‘ও বেশি কথা বলে না। তবে একটু স্বস্তিতে ছিল। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এই রকম সাফল্য তো সহজে আসে না। আমরা ওর ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলেছি, ও কী করতে চায়, এই সব নিয়ে আলোচনা করেছি।’’
আর ঠাকুর্দা কী মন্ত্র দিলেন নাতিকে? ‘‘যে ভাবে খেলছ, খেলে যাও। নিজেকে উজাড় করে দাও। আর যত পারো রেকর্ড ভাঙো,’’ প্রচ্ছন্ন গর্ব ধরা পড়ছিল ঠাকুর্দার গলায়।
রাচিনের জন্ম নিউ জ়িল্যান্ডের ওয়েলিংটনে। তাঁর বাবা রবি কৃষ্ণমূর্তির প্রথম প্রেম ক্রিকেট। ছেলেকেও হাতে ধরে তৈরি করেছেন তিনি। আদিগা বলছিলেন, ‘‘রাচিনের এই সাফল্যের নেপথ্যে যদি কাউকে কৃতিত্ব দিতে হয়, সেটা ওর বাবাকেই দিতে হবে। নিজে বেঙ্গালুরুতে ক্লাব ক্রিকেট খেলেছে। তার পরে পরিবার নিয়ে নিউ জ়িল্যান্ড চলে যায়। আমার যত দূর মনে পড়ছে, ছ’বছর বয়স থেকেই রাচিনের হাতে ব্যাট তুলে দিয়েছিল ওর বাবা।’’
একটু বড় হওয়ার পরে নিয়মিত ভারতে আসা শুরু করেন রাচিন। চলে প্রশিক্ষণ পর্ব। বাবার ক্রিকেটপ্রেম কতটা, তা বোঝা যায় ছেলের নামকরণ থেকে। রাহুল দ্রাবিড় এবং সচিন তেন্ডুলকরের নামের অক্ষর নিয়ে ছেলের নাম দেন রাচিন!
সেই রাহুল দ্রাবিড় এ বার প্রতিপক্ষ কোচ। আর লড়াই হবে সচিনের আঁতুড়ঘর ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে। রাচিন রবীন্দ্র সত্যিই স্বার্থকনামা!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy