একটা সময় ছিল, যখন সংযুক্ত আরব আমিরশাহিতে ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার ছিল। দুই দেশ শারজায় কত স্মরণীয় ম্যাচ যে খেলেছে তার কোনও ইয়ত্তা নেই। দুই দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যেই ম্যাচগুলি হওয়ায় উত্তেজনা থাকত চূড়ান্ত। সমর্থক থেকে ক্রিকেটার, প্রত্যেকেই তেতে থাকতেন এই ম্যাচ নিয়ে।
সেই সোনালি সময় অনেক দিনই শেষ হয়ে গিয়েছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা আরও বেড়েছে। এখন দুই দেশ আর দ্বিপাক্ষিক সিরিজ় খেলে না। ক্রিকেটবিশ্বের অন্যতম সেরা ম্যাচ দেখার জন্য অপেক্ষা করে থাকতে হয় আইসিসি বা এশিয়া কাপের। সেই উত্তেজনাও আগের চেয়ে কম। তার একটা কারণ যদি হয় দু’দেশের নিয়মিত না খেলা, আর একটি নিঃসন্দেহে ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের টানা খারাপ পারফরম্যান্স।
১৯৫২ সালে আইসিসি-র (তৎকালীন ইম্পিরিয়াল ক্রিকেট কনফারেন্স) পূর্ণ সদস্য দেশ হলেও ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তান প্রথম এক দিনের ম্যাচ খেলেছিল অনেক পরে, ১৯৭৮ সালে। কোয়েট্টায় হওয়া সেই ম্যাচে ভারত জিতেছিল চার রানে। এখনও পর্যন্ত এই ফরম্যাটে দুই দেশ মুখোমুখি হয়েছে ১৩৫ বার। ভারত জিতেছে ৫৭ বার। পাকিস্তান ৭৩ বার। বাকি ম্যাচগুলি পরিত্যক্ত।
আশি এবং নব্বইয়ের দশকে শারজায় ভারত-পাকিস্তান মুখোমুখি হলে তা উৎসবের চেহারা নিত। সেই উৎসবের পুরোভাগে থাকতেন পাকিস্তানের সমর্থকেরাই। কারণ শারজায় পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের পরিসংখ্যান খুবই খারাপ। ওয়াকার ইউনিস, ওয়াসিম আক্রম, শোয়েব আখতার, সইদ আনোয়ার, ইমরান খান— কে ছিলেন না তখনকার পাকিস্তান দলে! রবি শাস্ত্রী, মহম্মদ আজহারউদ্দিন, বিনোদ কাম্বলি, সঞ্জয় মঞ্জরেকর থেকে শুরু করে সচিন তেন্ডুলকর, সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়, রাহুল দ্রাবিড়েরাও সেই পাকিস্তানের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারতেন না। শারজায় ২৮ বার সাক্ষাতে ১৯ বারই জিতেছে পাকিস্তান।
তবে পাকিস্তান ক্রিকেটের সেই সোনালি যুগ আর নেই। এখনকার দলে বিতর্ক ছায়ার মতো লেগে রয়েছে। দল নির্বাচন, অধিনায়ক নির্বাচন, নির্বাচকদের কাজিয়া, দলের অন্তর্কলহ পাকিস্তানের ক্রিকেটে রোজকার ব্যাপার। তার ছাপ পড়ছে পারফরম্যান্সেও। এই কারণেই রবিবার রোহিত শর্মাদের বিরুদ্ধে মরণ-বাঁচন ম্যাচে নামছে হচ্ছে পাকিস্তানকে। ২৯ বছর পর দেশের মাটিতে হওয়া প্রথম আইসিসি প্রতিযোগিতাতে নিউ জ়িল্যান্ডের কাছে প্রথম ম্যাচেই হেরে গিয়েছে তারা। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ফরম্যাট এমনই যে, একটি ম্যাচে হারলেই বিদায়ঘণ্টা বেজে যেতে পারে।
দেশে যতই সমস্যা থাকুক, অতীতে পাকিস্তানের প্রশাসন বার বার গুরুত্ব দিয়ে এসেছে ক্রিকেটকে। যুদ্ধক্ষেত্রে না হলেও, ক্রীড়া ময়দানে ভারতকে শাসন করার জন্য একটি অস্ত্রই ছিল তাদের কাছে— ক্রিকেট। সে কারণেই পাকিস্তান থেকে কালজয়ী সব পেসারেরা উঠে এসেছেন। এখন যেমন পাকিস্তানে বিরাট কোহলি, রোহিত শর্মার ভক্ত প্রচুর পাওয়া যাবে, তেমনই তখনকার সময়ে ভারতে ঘরে ঘরে ছিল আক্রম, ইউনিস, শোয়েবদের ভক্ত। ক্রিকেটীয় শত্রুতা থাকত মাঠেই। খেলা শেষ হলে আবার বন্ধুত্ব। পাকিস্তানের সেই গৌরবও এখন অতীত। যে কারণে এখন দল বাছতে গেলে নির্বাচকদের বিস্তর মাথা চুলকোতে হয়। একজন ক্রিকেটার চোট পেয়ে ছিটকে গেলে এমন ক্রিকেটারকে দলে নিতে হয়, যিনি দু’বছর জাতীয় দলে খেলেনইনি! আইপিএল থেকে যেখানে প্রতি বছর একাধিক প্রতিভা উঠে আসছেন, সেখানে পাকিস্তান সুপার লিগ থেকে কাউকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ভরসা করতে হচ্ছে ক্রিকেটজীবনের সায়াহ্নে থাকা বাবর আজম, মহম্মদ রিজওয়ানদের উপরেই। ঘরোয়া ক্রিকেটের অবস্থা আরও শোচনীয়।

গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।
গত এক দশক ধরে পাকিস্তানের ঠিক উল্টো পথে হাঁটছে ভারত। এমনিতেই এ দেশের ঘরোয়া ক্রিকেটের সুনাম রয়েছে বিশ্ব জুড়ে। পাশাপাশি আইপিএল ক্রিকেটারদের উঠে আসার জন্য নতুন মঞ্চ তৈরি করে দিয়েছে। জসপ্রীত বুমরাহ, হার্দিক পাণ্ড্য, শুভমন গিল থেকে হর্ষিত রানা, অর্শদীপ সিংহেরা উঠে এসেছেন আইপিএলে ভাল খেলেই। ঠাসা স্টেডিয়ামে খেলার কারণে এঁরা আগে থেকেই চাপ নেওয়ার জন্য তৈরি হয়ে যাচ্ছেন। তাই জাতীয় দলে খেলতে এসে চাপে পড়তে হচ্ছে না। রবিবারের ম্যাচে দু’দেশের প্রতিভাই পার্থক্য গড়ে দিতে পারে।
এই মুহূর্তে দু’দেশের ফারাক কোথায় সেটা একটা পরিসংখ্যানেই স্পষ্ট হয়ে যেতে পারে। এক দিনের ক্রিকেটে শেষ ১০টি ম্যাচে সাতটি জিতেছে ভারত। দু’টি পাকিস্তান। তার মধ্যে ২০১৯, ২০২৩ এক দিনের বিশ্বকাপ হেসেখেলে জিতেছে ভারত। তবে দু’টি পরিসংখ্যান হালকা হলেও চিন্তায় রাখতে পারে ভারতকে। প্রথমত, চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে মুখোমুখি সাক্ষাতে ৩-২ এগিয়ে রয়েছে পাকিস্তান। দ্বিতীয়ত, শেষ বার চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির মোকাবিলায় শেষ হাসি হেসেছিলেন বাবর আজমেরাই।
আরও পড়ুন:
এটাও ঠিক, ক্রিকেট ম্যাচের ফলাফল পরিসংখ্যান দিয়ে হয় না। ম্যাচের দিনে যে দল চাপ সামলাতে পারবে, যে দল পরিস্থিতির সঙ্গে বেশি মানিয়ে নিতে পারবে এবং ব্যক্তিগত নৈপুণ্য কাজে লাগাতে পারবে সেই জিতবে। আর এখানেই কয়েক যোজন এগিয়ে রয়েছে ভারত। রোহিত, কোহলি তো রয়েছেনই। পাশাপাশি শুভমন গিল, শ্রেয়স আয়ার, কেএল রাহুল, রবীন্দ্র জাডেজারা নিজের দিনে প্রতিপক্ষকে একাই শেষ করে দিতে পারেন।
এই ম্যাচে বরাবরই ভারতের ব্যাটিংয়ের সঙ্গে পাকিস্তানের বোলিংয়ের লড়াই হয়। সেটাও রবিবার উপভোগ্য হবে কি না বলা মুশকিল। কারণ শাহিন আফ্রিদি, নাসিম শাহ, হ্যারিস রউফ কারওরই সাম্প্রতিক পারফরম্যান্স উল্লেখ করার মতো নয়। খুবই গড়পড়তা বোলিং বিভাগ নিয়ে খেলতে নামবে পাকিস্তান। সেখানে ভারতের শুভমন, রোহিত, শ্রেয়স ছন্দে রয়েছেন। তাঁরা ক্রিজ়ে টিকে গেলে পাকিস্তানের চাপ বাড়বে।
আরও পড়ুন:
ভারতের বোলিংয়ে জসপ্রীত বুমরাহ না থাকলেও রয়েছেন মহম্মদ শামি। প্রতিভার ঝলক দেখা যাচ্ছে হর্ষিত রানার মধ্যেও। এঁরা কেউ ব্যর্থ হলে স্পিনারেরা রয়েছেন। অক্ষর, জাডেজা, কুলদীপ ত্রয়ীর আক্রমণ কী ভাবে পাকিস্তান সামলায় তার দিকে নজর থাকবে।
তবে খাতায়-কলমে যতই ভারত এগিয়ে থাকুক, ম্যাচটা যে হেতু পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তাই আগে থাকতে কিছুতেই বলা যায় না। মাঠের লড়াই-ই সেখানে শেষ কথা বলে। তাই রবিবারের ম্যাচের গুরুত্ব এবং উত্তেজনা কোনও মতেই কম হবে না।