নিত্যযাত্রায় নিত্যসঙ্গী সেই সব কটাক্ষকেও বিশ্বকাপের মাঠে বাউন্ডারির বাইরে ফেলে দিলেন ঝুলন। তিনি নিজে শান্ত থাকলেও নীরব গর্জন আছড়ে পড়ছিল চাকদহ-শিয়ালদহ ট্রেনের কামরার মধ্যে— হ্যাঁ, খেলব।
শীর্ষে: বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি এখন ঝুলন। ছবি: টুইটার।
বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ উইকেটের শিখরে আরোহণের রাতে তাঁর বন্ধুমহল থেকে অদ্ভুত কথা শোনা গেল। তিনি নাকি কোনও বিজয়োৎসবই করেননি! আগামী কয়েক দিনে করবেন, এমন সম্ভাবনাও নেই।
ওয়েস্ট ইন্ডিজের আনিসা মহম্মদের উইকেট নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার লিন ফুলস্টনকে পেরিয়ে গেলেন। বিশ্বকাপে লিনের ছিল ৩৯ উইকেট, এতকালের রেকর্ড। তাঁর হল ৪০। পঞ্চম বিশ্বকাপ, ৩১তম ম্যাচ। অসামান্য প্রাপ্তি। কিন্তু রেকর্ড গড়েও যে কোনও উচ্ছ্বাস নেই, টিভিতেই দেখা গিয়েছে। তা বলে ড্রেসিংরুমে বা হোটেলে ফিরেও উৎসব, উল্লাস করেননি!
‘‘না, করেনি। ও বরং আফসোস করে যাচ্ছিল, ‘শুরুতে এত খারাপ বোলিং করলাম কী করে! ম্যাচটা খুলে দিয়েছিলাম প্রায়।’ বলেই দিল, বিজয়োৎসবের পরিকল্পনা নেই। বলল, মিশন বিশ্বকাপ নিয়েই ভাবছে, ব্যক্তিগত মাইলস্টোন নিয়ে নয়।’’ শনিবার রাতে যখন আবেগরুদ্ধ হয়ে বলছিলেন তাঁর বন্ধু, মনে হচ্ছিল শুধুই ক্রিকেটবিশ্ব দাপিয়ে বেড়ানো বাঘিনী বোলার কোথায়! তিনি— ঝুলন গোস্বামী যেন রাডইয়ার্ড কিপলিংয়ের সেই ‘ইফ’ কবিতাটা।
‘ইফ ইউ ক্যান মিট উইথ ট্রায়াম্ফ অ্যান্ড ডিজ়ার্স্টার্স/ অ্যান্ড ট্রিট দোজ় টু ইমপোস্টর্স জাস্ট দ্য সেম’।
(যদি সাফল্য আর ব্যর্থতায় একই রকম থাকতে পারো)
শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল, নিজের ক্রিকেটীয় জীবনের এমন এক পূর্ণিমার রাতে কোথায় বিশ্বরেকর্ডের জোৎস্নার আলোয় ভাসবেন! না, কয়েকটা বল বাজে করে ফেলে দলকে সাময়িক দুশ্চিন্তায় ফেলেছিলেন বলে অনুতপ্ত। কী অসম্ভব নিয়ন্ত্রণ আবেগের উপর! দলগত লক্ষ্য অধরা বিশ্বকাপ জেতা আর সেটাই পাখির চোখ। ব্যক্তিগত শৃঙ্গ জয়কে হেলায় বিসর্জন দেওয়া!
স্বামী বিবেকানন্দ পড়তে ভালবাসেন ঝুলন। নিউজ়িল্যান্ডেও হয়তো নিজেকে শান্ত, স্থিতধী রাখছেন বিবেকানন্দের বাণী পড়ে। হয়তো বা নিঃশব্দে প্রেরণা জুগিয়ে চলেছে প্রিয় অ্যাথলিট মারিয়ন জোন্সের আত্মজীবনী।
ভারতীয় ক্রিকেটের ইতিহাসে যত ব্যক্তিগত নৈপুণ্যের কোহিনুর রয়েছে, তার মধ্যে ঝুলনের এই কীর্তি অন্যতম সেরা। অনেক আগেই ওয়ান ডে ক্রিকেটে বিশ্বের সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি হয়েছেন। এ বার বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ উইকেটের শিখরে। সুনীল গাওস্করের প্রথম দশ হাজার রানের এভারেস্টে ওঠা, কপিল দেবের টেস্টে সর্বোচ্চ উইকেটে রিচার্ড হ্যাডলিকে টপকে যাওয়া বা সচিন তেন্ডুলকরের শত শতকের পাশে যা অনায়াসে স্থান করে নিতে পারে। আর বঙ্গ ক্রিকেটের জাদুঘরে জ্বলজ্বল করবে পঙ্কজ রায়ের সেই বিনু মাঁকড়ের সঙ্গে ৪১৩ রানের ওপেনিং পার্টনারশিপের অতীত বিশ্বরেকর্ডের পাশে।
চাকদহ থেকে চক দে— তাঁর এই রুদ্ধশ্বাস অভিযানের দিকে তাকিয়ে আবার মনে হচ্ছে, ঝুলন শুধু ক্রিকেটের রেকর্ড ভাঙলেন কোথায়? জীবনের বাইশ গজেও তো তিনি আগ্রাসী ফাস্ট বোলার হিসেবে উদয় হয়ে একের পর এক পাল্টা বাউন্সারে সামাজিক রক্ষণশীলতার বেড়া উপড়ে ফেলেছেন! বিশ্বকাপে ৪০ উইকেটের শুষ্ক পরিসংখ্যান দিয়ে যার বিচার করা যাবে না।
ওই তো সেই লোকগুলো। চাকদহ থেকে তিনি যখন কাঁধে কিটব্যাগ নিয়ে ভিড়ে ঠাসা ট্রেনে ঠাঁই খোঁজার চেষ্টা করছেন, ওরা কটাক্ষ ছুড়ে দিচ্ছে। তার সামনে শনিবারের বিশ্বকাপ ম্যাচে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ব্যাটারদের আক্রমণ অতি নগণ্য। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া দূরে থাক, উৎসাহ দেওয়ার প্রশ্ন নেই, ভারী ক্রিকেট ব্যাগ কাঁধে মেয়েটাকে জায়গা করে দেওয়ার লোকের দেখা পাওয়া যায়নি কখনও। বরং ভেসে এসেছে অপমানজনক উক্তি— ‘‘মেয়ে হয়ে আবার ক্রিকেট খেলবে! কেন যে সময় নষ্ট করছে!’’
কোচিং ক্যাম্পে দু’টো রুটি হাতে তুলে দেওয়া কর্তাকে কপিল দেব বলতে পেরেছিলেন, ‘‘আমি পেস বোলার হতে চাই। দু’টো রুটিতে আমার কী হবে? চারটে দাও।’’ ঝুলন কাকে কী উত্তর দেবেন? উল্টো দিকে যে এক-দু’জন ব্যক্তি নয়, কার্যত গোটা সমাজ। যারা মানতেই চায় না, মেয়েরা ক্রিকেট খেলবে। বিশ্বাসই করে না, ব্যাট-বল হাতে বিশ্বমঞ্চ দাপাতে পারে।
নিত্যযাত্রায় নিত্যসঙ্গী সেই সব কটাক্ষকেও বিশ্বকাপের মাঠে বাউন্ডারির বাইরে ফেলে দিলেন ঝুলন। তিনি নিজে শান্ত থাকলেও নীরব গর্জন আছড়ে পড়ছিল চাকদহ-শিয়ালদহ ট্রেনের কামরার মধ্যে— হ্যাঁ, খেলব। আমরা, মেয়েরা খেলব। বিশ্বমঞ্চে বল হাতে দাপাব। উইকেট নেব। বিশ্বকাপে রেকর্ড গড়ব! তোরা যে যা বলিস বল।
আবার কিপলিংয়ের সেই কবিতাটার লাইন— ‘ইফ ইউ ক্যান ট্রাস্ট ইয়োরসেল্ফ হোয়েন অল মেন ডাউট ইউ’ (যখন সবাই তোমার দক্ষতা নিয়ে সংশয়ে তখন যদি নিজের উপর আস্থা রাখতে পারো...)। কে জানত, শিয়ালদহ-চাকদহ ট্রেনের কামরায় অপমানিত, রক্তাক্ত হতে হতে একদিন সে নিজেই হয়ে উঠবে চাকদহ এক্সপ্রেস!
আর তাঁর বিশ্বরেকর্ডের উৎসব? সম্ভবত প্রধান বোলার হিসেবে বড় অবদান রেখে অধরা কাপ জেতার তৃষ্ণা মেটাতে পারলে সেদিনটাই হবে ব্যক্তিগত বিজয়োৎসবেরও সেরা মঞ্চ। ওই জেদটার নামই যে ঝুলন। সেই চাকদহ থেকে ট্রেন ধরে ক্রিকেট শিখতে আসার দিন থেকে।
স্কার্ট পরে খেলা নিয়ে মৌলবাদীদের ফতোয়াকে যেমন সানিয়া মির্জা পাল্টা ফোরহ্যান্ডে চাবুক মেরে গিয়েছেন বরাবর, তেমনই ক্রিকেট বল হাতে রক্ষণশীলতার বেড়া উপড়ে ফেলেছেন ঝুলন। তাঁর পরবর্তী প্রজন্ম কিটব্যাগ কাঁধে ট্রেনে উঠলে আর কেউ কটাক্ষ ছুড়ে দেওয়ার সাহস পায় না। আর কোনও খুদে মেয়ে ক্রিকেটারের মনে হয় না, কিটব্যাগ কাঁধে ট্রেনে উঠছি মানে আমি দুয়োরানির সংসারের সদস্য। সেই কাঁটাতার উপড়ে ফেলেছে ঝুলনের হাত থেকে বেরিয়ে আসা বলগুলো।
ও হ্যাঁ, চলার পথে তিনি কিছু উইকেটও কুড়িয়েছেন!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy