ইংল্যান্ডের অনুশীলনে ব্রডের সঙ্গে মতীন। ছবি: টুইটার
জায়গা হয়নি জম্মু-কাশ্মীর দলে। ট্রায়ালে ভাল বল করলেও নিজের রাজ্যের হয়ে খেলার সুযোগ পাননি। এমনকি বয়সভিত্তিক কোনও দলেও জায়গা হয়নি। সেই মতীন তেলী সুযোগ পেয়েছেন ইংল্যান্ড টেস্ট দলের নেট বোলার হিসেবে।
মতীন আদতে উত্তর কাশ্মীরের সাপোরের বাসিন্দা। পড়াশোনার জন্য ১০ বছর বয়স থেকেই তাঁর সাকিন দিল্লি। সেখানকার স্কুল-কলেজেই তাঁর পড়াশোনা। ছোট থেকেই ক্রিকেটের প্রতি আকর্ষণ। পড়াশোনার পাশাপাশি ক্রিকেটও খেলেছেন দিল্লির বিভিন্ন ক্লাবের হয়ে। ক্লাব ক্রিকেটে সাফল্যের জন্য জম্মু-কাশ্মীর দলের ট্রায়ালে একাধিক বার ডাক পান মতীন। ট্রায়ালে ভাল বল করার সুবাদে উপত্যকার একাধিক ক্লাব তাঁকে খেলার প্রস্তাব দেয়। কিন্তু ওই পর্যন্তই। রাজ্য দলে সুযোগ হয়নি কখনও।
ক্রিকেটের প্রতি আকর্ষণ থাকলেও পড়াশোনায় কখনও ফাঁকি দেননি মতীন। নয়ডার সারদা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস কমিউনিকেশনে স্নাতকোত্তর শেষ করার পর উচ্চতর পড়াশোনার জন্য ইংল্যান্ডের নটিংহ্যামে যান মতীন। গত চার বছর ধরে সেখানেই রয়েছেন ২৩ বছরের জোরে বোলার। বিলেতেও পড়াশোনার পাশাপাশি ক্রিকেট চালিয়ে গিয়েছেন। ইংল্যান্ডের ক্লাব ক্রিকেটে ধারাবাহিক ভাবে ভাল পারফরম্যান্সের জন্যই ডাক পেয়েছেন জাতীয় দলের নেটে। নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় টেস্টের প্রস্তুতির জন্য ইংল্যান্ড দলের তরফে নটিংহ্যাম কাউন্টি ক্লাবের কাছে কয়েক জন বোলার চাওয়া হয়। নটিংহ্যাম কর্তৃপক্ষ আরও কয়েক জনের সঙ্গে মতীনকেও পাঠায় ইংল্যান্ড দলকে সাহায্য করতে।
সুযোগ পাওয়া নিয়ে মতীন বলেছেন, ‘‘নটিংহ্যাম কাউন্টির সহকারী কোচ বিলাল সাফায়াত হঠাৎ আমাকে ফোন করেন। ওঁকে আগে থেকে চিনতাম। উনিই বলেন, ‘প্রস্তুতির জন্য ইংল্যান্ড দল কয়েক জন ভাল স্থানীয় বোলার চেয়েছে। আমি তোমার নাম প্রস্তাব করেছি। তুমি ইংল্যান্ডের নেটে বল করতে রাজি?’ সঙ্গে সঙ্গে সম্মতি জানাই। এমন সুযোগ হারাতে চাইনি। আমার ক্রিকেট-নায়কদের সঙ্গে সাজঘর ভাগ করে নেওয়া সুযোগ কি হারানো যায়?’’
ইংল্যান্ডের সেরা ব্যাটারদের নেটে বল করার অভিজ্ঞতা কেমন? মতীন বলেছেন, ‘‘ভালই বল করেছি। জনি বেয়ারস্টো, জ্যাক ক্রলি এবং অন্য ব্যাটারদের বল করেছি। কাউকেই তেমন আগ্রাসী হওয়ার সুযোগ দিইনি। বেয়ারস্টো, ক্রলিকে আউটও করেছি।’’ ইংল্যান্ডের নেটে জেমস অ্যান্ডারসন, স্টুয়ার্ট ব্রডদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বল করেছেন মতীন। কাশ্মীরি যুবকের সুইং বোলিং চমকে দিয়েছে ইংল্যান্ডের কোচ ব্রেন্ডন ম্যাকালাম, প্রাক্তন ক্রিকেটার পল কলিংউডকে।
জেমস অ্যান্ডারসনকে আদর্শ করেই জোরে বোলার হয়েছেন মতীন। সেই অ্যান্ডারসনের সঙ্গেই নেটে বল করেছেন। মতীনের যেন ঘোর কাটছে না। তিনি বলেছেন, ‘‘অ্যান্ডারসন আমার প্রিয় বোলার। উনি কিংবদন্তি। ব্রডও আমার অন্যতম প্রিয় বোলার। আগে ক্লাব পর্যায়ে অ্যালেক্স হেলসের সঙ্গে খেলেছি। কিন্তু অ্যান্ডারসন, ব্রডের সঙ্গে দেখা হওয়ার অভিজ্ঞতা বলে বোঝাতে পারব না। আমার স্বপ্নপূরণ হল। নিজেকে বিশ্বের সবথেকে ভাগ্যবান ক্রিকেটার মনে হচ্ছে।’’
গত মরসুমে মতীন ক্যাভালিয়র্স অ্যান্ড ক্যারিংটন ক্রিকেট ক্লাবের হয়ে ১৮.৬৪ গড়ে ২৫টি উইকেট নেন। তাঁর সেরা বোলিং ছিল ৩৫ রানে ৬ উইকেট। চলতি মরসুমে এখনও পর্যন্ত ১৮.২৭ গড়ে ১১টি উইকেট নিয়েছেন।
ইংল্যান্ড যাওয়ার আগে মতীন খেলতেন বারামুলার একটি ক্লাবে। সেখানে সব ম্যাচ খেলার সুযোগ পেতেন না। তরুণ ক্রিকেটার বলেছেন, ‘‘অন্যদের মতো সুযোগ পেতাম না। পড়াশোনার ক্ষতি করে কখনও খেলতাম না। সাপোরের একটা ক্রিকেট প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের দলে খেলতাম। নিয়মিত ছিলাম না বলে উঁচু পর্যায়ে খেলার সুযোগ হত না। ক্রিকেট নিয়ে আবেগ কখনই কমেনি। তাই নটিংহ্যামে এসেই আবার এখানকার ক্লাবের সঙ্গে যোগাযোগ করি।’’ সাবধানী মতীন মনে করিয়ে দিয়েছেন, ‘‘আমাকে কিন্তু ইংল্যান্ড ক্রিকেট বোর্ডের পক্ষ থেকে ডাকা হয়নি। স্থানীয় ভাবে ডাকা হয়েছে। এটা বড় কিছু নয়। আমার কাছে যদিও বিরাট সুযোগ।’’
মতীনের ইংল্যান্ড যাওয়ার পথ কিন্তু সহজ ছিল না। তাঁর দাদা বিলাল আহমেদ তেলী বলেছেন, ‘‘ভাইকে বিদেশে পড়তে পাঠানোর সামর্থ্য আমাদের নেই। বাবা ক্যান্সার আক্রান্ত। আমার একটা ছোট দোকান রয়েছে। সেই আয় থেকে বাবার চিকিৎসা, সংসার চালিয়ে বিশেষ কিছুই বাঁচে না। নিজের যোগ্যতাতেই মতীন আজকের জায়গায় পৌঁছেছে। নয়ডার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাল ফল করার সুবাদে স্কলারশিপ নিয়ে নটিংহ্যাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়েছে। ছোট থেকেই পড়াশোনা এবং ক্রিকেট সমান তালে চালিয়েছে মতীন। এত দিনে ও পরিশ্রমের মূল্য পেল।’’
ভাইয়ের জন্য দারুণ গর্বিত বিলাল। কিছুটা আফসোসও রয়েছে তাঁর। কারণ, একটা সময় পর্যন্ত ভাইকে বার বার ক্রিকেট খেলে সময় নষ্ট না করার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। বিলাল হাসতে হাসতে বলেছেন, ‘‘মতীন ভাগ্যিস আমার কথা শোনেনি।’’ এরপরেই তিনি বলেছেন, ‘‘কয়েক বছর আগে কায়ুম বাগে অনূর্ধ্ব ১৯ জম্মু-কাশ্মীর দলের জন্য ট্রায়াল হচ্ছিল। মতীন খুব ভাল বল করেছিল। পরে রঞ্জি ট্রফির ট্রায়ালেও ভাল করে। বেশ কিছু ক্লাব ওকে খেলার প্রস্তাব দেয়। সকলেই ওর প্রশংসা করেছিল। কিন্তু বার বার দলে সুযোগ না পেয়ে হতাশ হয়ে পড়েছিল মতীন।’’
ইংল্যান্ডের নেটে সুযোগ পাওয়ায় মতীনের বোলিংয়ের আরও উন্নতি হবে বলে মনে করছেন বিলাল। তাঁর মতে, পৃথিবীর অন্যতম সেরা কোচেদের সামনে বল করলে মতীন ভুল-ত্রুটি শোধরাতে পারবেন। গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শও পাবেন। নটিংহ্যামের ইশার গ্রোভ ক্লাবের হয়ে এখন নিয়মিত খেলেন মতীন।
পারভেজ রসুল কাশ্মীরের প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে দেশের হয়ে খেলেছেন। আইপিএলে চমকে দিয়েছে উমরান মালিকের গতি। তিনিও ডাক পেয়েছেন ভারতীয় দলে। চোটের জন্য ছিটকে গেলেও আইপিএলে কলকাতা নাইট রাইডার্সের হয়ে নজর কাড়েন রাসিখ সালামও। কাশ্মীর কি তবে ভারতীয় ক্রিকেটে জোরে বোলারদের আঁতুরঘর হয়ে উঠছে ক্রমশ? উমরান, রাসিখ, মতীনরাই যে স্বপ্ন উস্কে দিচ্ছেন।
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy