জুটি: ভারতকে সাফল্যের শিখরে নিয়ে যান বিরাট ও শাস্ত্রী। ফাইল চিত্র
আইপিএলে কমেন্ট্রি বক্সে প্রত্যাবর্তন এবং ভক্তদের মন জিতে নেওয়া। কেমন উপভোগ করছেন পুরনো ভূমিকা? কোন ক্রিকেটারকে তাঁর ভাল লাগল? বরাবর তরুণ রক্তের সমর্থক, তিনি কাকে ভবিষ্যতের বাজি হিসেবে বাছবেন? বিরাট কোহলির সমস্যা কোথায়? হার্দিক পাণ্ড্য কেমন অধিনায়ক? ফরাসি ওপেনে রাফায়েল নাদালের সেমিফাইনাল দেখতে দেখতে সব প্রশ্নের উত্তর নিয়ে একান্ত আলাপচারিতায় রবি শাস্ত্রী। যথারীতি সেই স্বভাবসিদ্ধ ‘ট্রেসার বুলেট’ মেজাজে!
প্রশ্ন: অধিনায়ক হার্দিক পাণ্ড্য কি আপনাকেও চমকে দিয়েছেন?
রবি শাস্ত্রী: একদমই তাই। হার্দিক সত্যিই যেন নতুন রূপে ফিরল। আমিও মুগ্ধ। সামনে থেকে দাঁড়িয়ে নেতৃত্ব দিল। আইপিএলের এই হার্দিক যেন নতুন এক তরতাজা বাতাস নিয়ে উপস্থিত হল।
প্র: আপনি ভারতীয় দলের কোচ থাকার সময়েই প্রবেশ হার্দিকের। বিতর্কও কম হয়নি। আপনি এবং অধিনায়ক বিরাট সমর্থন করে গিয়েছেন। কী দেখে প্রভাবিত হয়েছিলেন?
শাস্ত্রী: হার্দিকের প্রতিভা নিয়ে আমাদের কারও মনে কোনও সংশয় ছিল না। সেই কারণে দ্রুতই ওকে টেস্ট দলেও নিয়ে আসা হয়। নানা মুনির নানা মত তো থাকবেই। সারাজীবন ধরেই কত শুনলাম। কোনও দিনই সে সবে পাত্তা দিইনি। আমরা জানতাম, হার্দিকের মধ্যে দক্ষতা রয়েছে। ওকে মনঃসংযোগ ঠিক রাখতে হবে। ক্রিকেটের জন্য আত্মত্যাগ করতে হবে। এ সবই ওকে বোঝানো হয়েছিল। সেগুলো এক কান দিয়ে শুনে আর এক কান দিয়ে বার করে দেয়নি ও। তাই সমালোচকদেরও যোগ্য জবাব পেতে দেরি হয়নি।
প্র: কিন্তু মাঝে বড় চোট প্রশ্ন তুলে দিয়েছিল হার্দিকের ভবিষ্যৎ নিয়ে।
শাস্ত্রী: সুন্দর একটা কেরিয়ার এগোতে এগোতে হঠাৎই চোটের জন্য থমকে গিয়েছিল। কিন্তু চ্যাম্পিয়ন তো সে-ই যে বারবার পড়ে গিয়েও উঠে দাঁড়ায়। এই যে রাফায়েল নাদালকে দেখছি। কী সব ভয়ঙ্কর চোটের আঘাতে জর্জরিত হয়েছে ওর শরীরটা। তার পরেও কোর্টে সেই অদম্য, হার-না-মানা চ্যাম্পিয়ন। একটার পর একটা গ্র্যান্ড স্ল্যাম জিতে চলেছে এখনও। দারুণ একটা আইপিএল হার্দিককে নতুন জীবন ফিরিয়ে দিয়েছে। এই আইপিএলে হার্দিক ফের প্রমাণ করে দিয়েছে, ও এখনও ম্যাচউইনার। ব্যাটে-বলে তো ম্যাচ জিতিয়েইছে, অধিনায়ক হিসেবেও নজর কেড়েছে।
প্র: হার্দিককে কি আবার অলরাউন্ডার হিসেবে ভাবার মতো জায়গা তৈরি হয়েছে?
শাস্ত্রী: সাদা বলের ক্রিকেটে অবশ্যই ওকে অলরাউন্ডার হিসেবে ভাবা যেতে পারে। কিন্তু লাল বলের ক্রিকেটে এখনই ওর উপরে বেশি চাপ তৈরি করা বোধ হয় ঠিক হবে না। দু’টো বিশ্বকাপ রয়েছে সামনে। এ বছরে অস্ট্রেলিয়ায় টি-টোয়েন্টি, পরের বছর ভারতেই পঞ্চাশ ওভারের। মাথায় রাখতে হবে, এই দু’টো বিশ্বকাপে হার্দিককে সবচেয়ে বেশি কাজে লাগবে আমাদের।
প্র: আইপিএলে সফল নেতৃত্ব দেওয়ার পরে হার্দিককে কি সাদা বলে ভবিষ্যতের অধিনায়ক হিসেবেও ভাবা যেতে পারে?
শাস্ত্রী: কেন নয়? যে ভাবে ও আইপিএলে নেতৃত্ব দিয়েছে, তার পরে তো ওর নাম ভাবা যেতেই পারে।
প্র: দেশের অন্যতম সেরা মস্তিষ্ক ভাবা হয় আপনাকে। অধিনায়ক হার্দিকের কোন গুণটা আপনাকে সব চেয়ে আকৃষ্ট করেছে?
শাস্ত্রী: অধিনায়ক হিসেবে ওর নিয়ন্ত্রণ। কোনও পরিস্থিতিতেই ‘প্যানিক বাটন’-এ হাত গেল না। হার্দিককে দেখে কখনও আমার মনে হয়নি যে, পরিস্থিতির চাপ ওর ব্লাডপ্রেশার বাড়িয়ে দিয়েছে। চাপের মুখেও ধীরস্থির, ঠান্ডা। সঙ্গে দলের সব খেলোয়াড়কে বুঝতে পারা, তাদের সঙ্গে ঠিক মতো যোগাযোগের সেতু তৈরি করা। এটা কিন্তু সহজ ব্যাপার নয় আইপিএলে কারণ নানা দেশের সব খেলোয়াড় রয়েছে ড্রেসিংরুমে। আর একটা বড় ব্যাপার হচ্ছে, সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা। ফাইনালে ব্যাটে-বলে ওর দলের সেরা পারফর্মার। ফাইনালের মতো মঞ্চে যখন অধিনায়ক নিজে দায়িত্ব নিয়ে ম্যাচ জেতায়, সতীর্থদের কাছে অন্য রকম শ্রদ্ধা, সম্মানের জায়গা তৈরি করে নিতে পারে সে। আইপিএলের শুরু থেকেই দলের প্রয়োজনে দায়িত্ব নিতে এগিয়ে এসেছে হার্দিক। ব্যাটিং অর্ডারে নিজেকে চার নম্বরে তুলে এনেছে। যেটা ওর কাছে অপরিচিত জায়গা। ব্যর্থ হলে আরওই নিন্দা জুটত, কেরিয়ার নিয়ে আরও সংশয় তৈরি হতে পারত। কিন্তু সে সবে ভয় না পেয়ে চার নম্বরে নেমে সফল হয়েছে ও।
প্র: আইপিএলে যা দেখলেন, তার ভিত্তিতে ভারতের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ফল কেমন হতে পারে বলে মনে হচ্ছে?
শাস্ত্রী: এত তাড়াতাড়ি কোনও পূর্বাভাস দিতে যাওয়া ঠিক হবে না। আমার মনে হয়, প্রতিযোগিতার দু’মাস আগে থাকতে দলের ফর্ম গুরুত্বপূর্ণ হবে। অস্ট্রেলিয়ায় বিশ্বকাপ হবে। সেখানকার পরিবেশ, পিচ, সবই অন্য রকম। ঠিক মতো দল নির্বাচন দরকার। বিশ্বকাপের আগে-আগে ক্রিকেটারদের ফর্ম কেমন থাকে, সেটাই আসল।
প্র: আপনি ভারতীয় দলের কোচ থাকাকালীন বিরাট কোহলির উত্থান। এই দীর্ঘ অন্ধকার কেন চলছে তাঁর? আপনার পর্যবেক্ষণ কী?
শাস্ত্রী: এই মুহূর্তে বিরাট যেটা করছে, সেটাই সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ওর জন্য। সম্পূর্ণ ভাবে ক্রিকেট থেকে দূরে থাকা। ক্রিকেট পৃথিবী থেকেই সুইচ অফ করে থাকতে হবে অন্তত ১৫-২০ দিন। তার পরে আবার ভাবব। ক্রিকেটে ফেরার পরেও বলব, খুব বেশি চাপ দিয়ো না নিজের উপরে। এক-একটা করে সিঁড়ি অতিক্রম করো। মনে করো, নতুন ইনিংস শুরু করছ।
প্র: বিরাটের কি কোনও টেকনিক্যাল সমস্যা হচ্ছে? নাকি পুরোটাই মানসিক?
শাস্ত্রী: আমি টেকনিক্যাল দিকটায় ঢুকতে চাই না কারণ টি-টোয়েন্টি ব্যাটিং দেখে এক জন ক্রিকেটারকে বিচার করতে না যাওয়াই ভাল। আমি একটাই কথা বলব। বিশ্রামটা উপভোগ করো, তার পরে ইংল্যান্ডে গিয়ে দ্যাখো কী হয়।
প্র: ইংল্যান্ডে পুরনো মেজাজের বিরাটকে পাওয়ার প্রত্যাশা কি মিটবে ভক্তদের?
শাস্ত্রী: বিরাটের দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার মুর্খামিটা নিশ্চয়ই কেউ করবে না। ২০১৪-তে ইংল্যান্ডে ব্যর্থতার পরেই অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে মিচেল জনসনকে ঠেঙিয়ে চারটে সেঞ্চুরি করেছে। আর তখন জনসন সবে অ্যাশেজ়ে আগুন ঝরিয়ে এসেছে। তাই সমালোচক আর বিশেষজ্ঞদের কাছে বিনীত আবেদন, ভদ্রমহোদয়গণ, বিরাটের মতো গুণগত মানের ব্যাটসম্যানকে চট করে যেন বাতিলের খাতায় ফেলে দেবেন না!
প্র: আপনি বরাবর তরুণ রক্তের সমর্থক। আইপিএলে কোন তরুণকে ভাল লাগল?
শাস্ত্রী: শুভমন গিলের পরিণত ব্যাটিং খুব ভাল লেগেছে। যুজ়বেন্দ্র চহালের বোলিং ভাল লেগেছে। কুলদীপ যাদব আবার ভাল করছে। রাহুল ত্রিপাঠীকে দারুণ লেগেছে। ধারাবাহিক ভাবে ভাল খেলে যাচ্ছে আইপিএলে। আমি মনে করি, ওর কথা ভাবা উচিত ভারতীয় দলের জন্য। সূর্যকুমার যাদব রয়েছে। এ বারে চোটের জন্য খেলতে পারল না, কিন্তু ওকে যেন ভুলে না যাই। পেসারদের মধ্যে উমরান মালিকের দুর্দান্ত উত্থান হয়েছে। মহসিন খানও কিন্তু খুব প্রতিশ্রুতিমান। এদের সকলকে নিয়েই আমি উত্তেজিত, খুব আশাবাদী।
প্র: আপনাদের সময়ে ফাস্ট বোলারদের আগুনই শুধু সামলাতে হয়েছে। এখন কেমন লাগে দেখে যে, ভারতীয় পেসাররাও নিয়মিত ভাবে ঘণ্টায় ১৫০ কিলোমিটার গতিবেগে বল করছে? উমরানের সর্বোচ্চ গতি ছিল ১৫৭-এর উপরে!
শাস্ত্রী: খুবই উপভোগ করার মতো দৃশ্য কারণ পুরো ক্রিকেটজীবনে এই আগুনটা আমাদের সারাক্ষণ সামলাতে হয়েছে। ভাল লাগে দেখে যে, আমরাও ফেরত দিতে পারছি। তবে আসল কথা হচ্ছে, বোলিং গ্রুপ তৈরি করা। বুমরা রয়েছে, শামি রয়েছে। ওদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য বেশ কয়েক জন নতুন মুখ এসে গিয়েছে। সিরাজ রয়েছে, এ বারের আইপিএল থেকে উমরান মালিককে পাওয়া গেল। মহসিন খানও বেশ ভাল। আমি মনে করি, মহসিনকে দ্রুত ভারতীয় দলের স্রোতে নিয়ে আসা উচিত। কুলদীপ সেনও ভাল করেছে। অর্শদীপ সিংহ রয়েছে, যে ভাল টেস্ট বোলার হতে পারে। প্রতিভার অভাব নেই, তবে অপেক্ষা করে দেখতে হবে ওরা আন্তর্জাতিক স্তরে কেমন পারফর্ম করে।
প্র: উমরান মালিককে কি এখনই ভারতীয় দলে আনা যায়? উমরান কি তৈরি?
শাস্ত্রী: আমি মনে করি, সব ধরনের ক্রিকেটে, সব ভারতীয় দলের সদস্য হওয়া উচিত উমরান মালিকের। ব্যস, এ ছাড়া দ্বিতীয় কোনও ভাবনাই নেই আমার।
প্র: আপনি বলেছেন, টি-টোয়েন্টির দ্বিপাক্ষিক সিরিজ় অর্থহীন। তুলে দেওয়াই ভাল।
শাস্ত্রী: অবশ্যই বলেছি। কেউ মনে রাখে না, দ্বিপাক্ষিক টি-টোয়েন্টি সিরিজ়ে কী হয়েছে। শুধু শুধু সময় আর এনার্জি নষ্ট। তার চেয়ে আইপিএল বাড়িয়ে দিলে অনেক উপকার হবে ক্রিকেটের। হয়তো কিছু অর্থ আসে এই সিরিজ়গুলো থেকে। তা হলে তো বলতে হয়, আইপিএলের আরও ৭০টা ম্যাচ করলে আরও বেশি অর্থ আসবে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy