দু’জনের চলাফেরা, কথাবার্তা থেকে কাজের ধরন, সবেতেই আকাশ-পাতাল তফাত। এক জন ক্রিকেটারদের বড় দাদা। তাঁদের কথা শোনেন। আগলে রাখেন। ভুল করলে ঢাল হয়ে দাঁড়ান। সফল হলে কৃতিত্বের ছিটেফোঁটা নেন না। তবে ব্যর্থ হলে সব দায় ঘাড় পেতে নেন। পিছনে থেকেই কাজ করতে ভালবাসেন তিনি। অপর জন ঠিক উল্টো। ঠোঁটকাটা। স্পষ্টবাদী। সাফল্যের জন্য কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে দু’বার ভাবেন না। কেউ ভুল করলে প্রকাশ্যে সমালোচনা করেন। বার বার বুঝিয়ে দেন, তিনিই বস্। প্রথম জন রাহুল দ্রাবিড়। ভারতের প্রাক্তন কোচ। দ্বিতীয় জন গৌতম গম্ভীর। ভারতের বর্তমান কোচ। গত বছর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জেতার পর দ্রাবিড়ের কাছ থেকেই কোচের ব্যাটন নিয়েছেন গম্ভীর। পরের ১০ মাসে ভারতীয় ক্রিকেটে ক্রমশ দাপট বেড়েছে গম্ভীরের। তিনিই দলের শেষ কথা। সম্প্রতি ভারতীয় দলের দুই সহকারী কোচের ছাঁটাইয়ে গম্ভীরের প্রভাব আরও বেশি বোঝা গিয়েছে।
পছন্দের কোচিং দল ও টি দিলীপ
কলকাতা নাইট রাইডার্সের মেন্টরের দায়িত্ব থেকে গম্ভীর যখন ভারতীয় দলের কোচ হচ্ছেন, তখন সহকারী কোচ হিসাবে তিন জনকে চেয়েছিলেন তিনি। অভিষেক নায়ার, মর্নি মর্কেল ও রায়ান টেন দুশখাতে। তিন জনের নামেই সিলমোহর দিয়েছিল ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড। এই তিন জনের সঙ্গে কেকেআরে সময় কাটিয়েছেন গম্ভীর। তাই তাঁদের ভাল ভাবে চেনেন তিনি। দ্রাবিড় জমানার বাকি সহকারী কোচদের চাকরি গেলেও এক জন থেকে গিয়েছিলেন। টি দিলীপ। দলের ফিল্ডিং কোচ। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ বা তার আগে এক দিনের বিশ্বকাপে ভারতের ফিল্ডিংয়ের মান ভাল ছিল। যে ভাবে তিনি প্রতিটি ম্যাচের পর সেরা ফিল্ডারকে পুরস্কার দেন, সে ভাবেই তাঁকে পুরস্কার দিয়েছিল বোর্ড। একমাত্র দিলীপই ছিলেন গম্ভীরের অপরিচিত। ১০ মাস পরে সেই দিলীপের চাকরি থাকল না। তাঁকে যে গম্ভীর চাইছিলেন না, তা বোর্ডের এই সিদ্ধান্ত থেকে পরিষ্কার। কিন্তু যে নায়ারকে তিনি নিজে চেয়েছিলেন, সেই নায়ারের চাকরি কেন গেল? তাঁকে কেন রাখলেন না গৌতি?
রোহিত শর্মার ঘনিষ্ঠ হওয়ার খেসারত দিলেন নায়ার, দিলীপ
নায়ারকে গম্ভীর চাইলেও তাঁর কাজ নিয়ে খুব একটা সন্তুষ্ট ছিলেন না গম্ভীর। বিশেষ করে দেশের মাটিতে নিউ জ়িল্যান্ডের কাছে চুনকাম ও পরে অস্ট্রেলিয়ার কাছে সিরিজ় হারের দায় ছিল ব্যাটারদের কাঁধে। সহকারী কোচ হিসাবে ব্যাটিংয়ের দিকে নজর রাখার দায়িত্ব ছিল নায়ারের। সেই দায়িত্বে তিনি ব্যর্থ। অস্ট্রেলিয়া সিরিজ়ের পরেই হয়তো চাকরি যেত নায়ারের। কিন্তু সেই চাকরি বাঁচিয়ে দেন রোহিত শর্মা। ভারত অধিনায়কের মতো নায়ারও মুম্বইয়ের ক্রিকেটার। আগে রোহিত অনেক বার নিজের ফিটনেস ও ব্যাটিংয়ের জন্য নায়ারের শরণাপন্ন হয়েছেন।
দিলীপ আবার দ্রাবিড়ের সময় থেকে রয়েছেন। রোহিতের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কও বেশ ভাল। অস্ট্রেলিয়া সফরের পর জানা গিয়েছিল, রোহিতের কারণেই তাঁদের চাকরি রয়েছে। কারণ, বোর্ডের কাছে রোহিত তাঁদের হয়ে কথা বলেছেন। কিন্তু গম্ভীর কোচ হওয়ার পর থেকে রোহিতের প্রভাব কিছুটা হলেও কমেছে। সেই জায়গা নিয়েছেন গম্ভীর। অস্ট্রেলিয়া সফরের সময় ভারতের সাজঘরের অনেক গোপন কথা বাইরে এসেছিল। সেগুলি বেশির ভাগই গম্ভীরকে নিয়ে। এমনও শোনা গিয়েছিল, অনেক ক্রিকেটার গম্ভীরকে পছন্দ করছেন না। এই ঘটনা পছন্দ করেননি গম্ভীর। প্রকাশ্যে জানিয়েছিলেন, সাজঘরের খবর বাইরে যাওয়ায় দলেরই ক্ষতি হয়েছে। জানা গিয়েছে, নায়ার ও দিলীপের মাধ্যমেই সেই সব খবর বাইরে গিয়েছিল। রোহিতের ঘনিষ্ঠ হওয়ার কারণেই চাকরি দিয়েছে দু’জনের।
রোহিত, কোহলিরা আবার ঘরোয়া ক্রিকেটে
প্রায় এক যুগ পরে আবার ঘরোয়া ক্রিকেট খেলেছেন বিরাট কোহলি। রোহিতও অনেক বছর পর মুম্বইয়ের হয়ে খেলেছেন। তাঁরা বাদে লোকেশ রাহুল, রবীন্দ্র জাডেজা, শুভমন গিল, যশস্বী জয়সওয়ালের মতো জাতীয় দলের ক্রিকেটারেরাও রঞ্জি খেলেছেন। তার নেপথ্যে সেই গম্ভীর। অস্ট্রেলিয়া সিরিজ়ের পর তিনি স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন, জাতীয় দলের হয়ে খেলা না থাকলে ক্রিকেটারদের ঘরোয়া ক্রিকেট খেলতে হবে। রোহিত, কোহলিরা বাধ্য হয়েছেন সেই কথা শুনতে।
তারকা সংস্কৃতির অপসারণ
ভারতীয় ক্রিকেটে তারকা সংস্কৃতির অপসারণ করেছেন গম্ভীর। জাতীয় দলের কোচ হওয়ার পরে তিনি দেখেছেন, সিনিয়র ক্রিকেটারেরা অনেকে বাসে না গিয়ে আলাদা গাড়িতে মাঠে যান। দলের সকলের সঙ্গে না খেয়ে ব্যক্তিগত রাঁধুনির রান্না খান তাঁরা। এই তারকা সংস্কৃতির অপসারণ করেছেন গম্ভীর। অস্ট্রেলিয়া সিরিজ়ের পর বোর্ড নির্দেশ দিয়েছে, কেউ ব্যক্তিগত রাঁধুনি নিয়ে যেতে পারবেন না। বাসে চেপে সকলকে হোটেল ও স্টেডিয়ামে যেতে হবে। আলাদা গাড়ি ব্যবহার করা যাবে না। বিদেশ সফরে স্ত্রী, সন্তানদের নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রেও নির্দেশিকা রয়েছে। সেই নির্দেশ মানতে হয়েছে সকলকে।
রোহিত-গম্ভীর সম্পর্ক
রোহিতের সঙ্গে গম্ভীরের সম্পর্ক মধুর নয়। তুলনায় দ্রাবিড়ের সঙ্গে রোহিতের সম্পর্ক বেশি ভাল ছিল। কোচ হওয়ার পরে গম্ভীর স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন, তিনি যেমন চাইবেন সে ভাবেই দল চলবে। দল নির্বাচন থেকে শুরু করে প্রথম একাদশ, সবেতেই গম্ভীরের প্রভাব দেখা গিয়েছে। অস্ট্রেলিয়া সফরের শেষ টেস্টে রোহিতের প্রথম একাদশের বাইরে থাকার ক্ষেত্রেও গম্ভীরের বড় ভূমিকা ছিল। ফর্মে না থাকা অধিনায়ককে বাদ দিতেও দু’বার ভাবেননি তিনি। এই ১০ মাসে গম্ভীর যত বার সাংবাদিক বৈঠক করেছেন, দ্রাবিড় হয়তো তাঁর পুরো কার্যকালে করেননি। রোহিতের বদলেও অনেক সময় সাংবাদিক বৈঠক করতে এসেছেন তিনি। কাউকে বাঁচানোর চেষ্টা করেননি। অধিনায়ক হলেও তাঁর ভুল স্পষ্ট করে দিয়েছেন।
গম্ভীরই বস্
গত ১০ মাসে ভারতীয় ক্রিকেটে অনেক বদল হয়েছে। দ্রাবিড়ের সময় যে ক্রিকেটারেরা সুযোগ পেতেন না (সঞ্জু স্যামসন বড় উদাহরণ) তাঁরা নিয়মিত খেলছেন। সিনিয়র ক্রিকেটারদেরও কোচের কথা মেনে চলতে হচ্ছে। কোচ যেমন চাইছেন তেমন ভাবেই দল চলছে। গম্ভীরের সঙ্গে জুটি বেঁধেছেন নির্বাচক প্রধান অজিত আগরকরও। দল নির্বাচনে দু’জনে বড় ভূমিকা নিচ্ছেন। যাঁরা তাঁদের চোখে সফল হতে পারছেন না, তাঁদের সরে যেতে হচ্ছে। নায়ার, দিলীপ তাঁর সর্বশেষ উদাহরণ। ১০ মাসের মধ্যে গম্ভীর বুঝিয়ে দিয়েছেন, যত দিন তিনি থাকবেন, তাঁর অঙ্গুলিহেলনেই দল চলবে। তিনিই শেষ কথা। তিনিই বস্।