রোহিতদের আগেকার জার্সি (বাঁ দিকে) এবং রোহিতদের এখনকার জার্সি। — ফাইল চিত্র
টেস্ট ক্রিকেট শুরু হয়েছে ১৮৭৭ সাল থেকে। তার পর থেকে ১৪৬ বছর কেটে গিয়েছে। দীর্ঘ এই সময়টায় অনেক কিছুই বদলেছে। ক্রিকেটের আকার সে ভাবে না বাড়লেও এই খেলা ক্রমশ ধনী হয়েছে। সারা দিনের ঠুকঠুকানি ক্রিকেট ম্যাচ থেকে ১০ ওভারের মশালাদার ক্রিকেট চালু হয়ে গিয়েছে। বদলায়নি একটা জিনিসই। তা হল টেস্ট ক্রিকেটের মহিমা এবং তার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িত সাদা জার্সি। ক্রিকেটের বয়স প্রায় দেড়শো বছর হতে চললেও টেস্ট ম্যাচ এখনও সাদা জার্সিতেই খেলা হয়। সীমিত ওভারের ক্রিকেটে জার্সিতে আমূল বদল এসেছে। কিন্তু টেস্টে সাদা জার্সিতে খেলার ব্যাপারে আপত্তি জানায়নি পৃথিবীর কোনও দেশই। আর এখানেই ভারতের সাম্প্রতিকতম টেস্ট জার্সি হঠাৎই বিতর্কের মুখে। এই জার্সিতে রঙের প্রভাব এতটাই যে ক্রিকেটের সনাতনী জার্সি নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন অনেকেই।
২০১৯ সালের আগে পর্যন্ত টেস্ট ক্রিকেটে ধবধবে সাদা জার্সি পরে নামতেন ক্রিকেটাররা। সেই জার্সিতে বুকের বাঁ দিকে সংশ্লিষ্ট দেশের লোগো থাকত। রং বলতে শুধু ওটুকুই। সময়ের দাবি মেনে চার বছর আগে, অর্থাৎ ২০১৯ সালে সেই প্রথা থেকে কিছুটা সরে আসে আইসিসি। ঠিক হয়, সীমিত ওভারের ক্রিকেটের মতো টেস্টের জার্সিতেও সংশ্লিষ্ট ক্রিকেটারের নাম এবং নম্বর থাকবে।
প্রতিটি দেশই সেই থেকে এই নিয়ম অনুসরণ করছে। রঙের ক্ষেত্রে কিছুটা ফারাক থাকছেই। কারও জার্সির পিঠে নাম এবং সংখ্যার রং কালো, কারও ক্ষেত্রে মেরুন, কারও আবার হালকা সবুজ। শুধু অস্ট্রেলিয়া এবং ইংল্যান্ডের ক্ষেত্রে বছরে এক বার জার্সির রং বদলায়। সেটা অস্ট্রেলিয়ার প্রাক্তন জোরে বোলার গ্লেন ম্যাকগ্রা এবং ইংল্যান্ডের প্রাক্তন অধিনায়ক অ্যান্ড্রু স্ট্রসের ক্যানসার সচেতনার প্রচারের জন্য।
ভারত এত দিন গা়ঢ নীল রঙের নাম ও নম্বর লেখা জার্সি পরেই নামত। হঠাৎই পুরো বিষয়টা বদলে গিয়েছে চলতি ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরের আগে। আমেরিকার একটি সংস্থা এখন ভারতীয় দলের কিট স্পনসর। তারাই জার্সি তৈরির বরাত পেয়েছে। তাদের লোগোর রং অনুযায়ী ভারতের জার্সিতে এখন দেখা যাচ্ছে হালকা নীল রঙের আধিক্য। নাম এবং নম্বর তো বটেই, কাঁধের কাছে তিনটি ‘স্ট্রাইপ’ এবং কলারেও হালকা নীল রং দেখা যাচ্ছে।
তবে সমস্যা সেটা নিয়ে নয়। আসল যেটা নজর কেড়েছে, তা হল জার্সির মূল স্পনসরের লোগো। এই মুহূর্তে ভারতীয় দলের জার্সির স্পনসর জুয়া সংস্থা ‘ড্রিম ইলেভেন’। সেই সংস্থার নাম রোহিত শর্মা, বিরাট কোহলির জার্সির বুকে টকটকে লাল রঙে জ্বলজ্বল করছে। জার্সির বাকি অংশে যেখানে নীল রঙের আধিক্য, সেখানে বুকের কাছে এই লাল রং নিতান্তই বেমানান বলে মনে হচ্ছে অনেকের। রঙের মধ্যেই বৈপরীত্য রয়েছে। অতীতে ভারতের জার্সির স্পনসর যারা ছিল, তাদের নামও বুকের কাছে বড় করে লেখা থাকত। কিন্তু জার্সির বাকি রঙের সঙ্গে সেটা মানানসই ছিল। এখনকার মতো দুটো বিপরীত রং ছিল না। ফলে জার্সি প্রকাশের পর থেকেই ক্রিকেটপ্রেমীরা ক্ষুব্ধ। অনেকেই একে ভারতের ‘কুৎসিততম’ জার্সি বলছেন। অনেকের মতে, আইপিএলের প্রভাব পড়ছে টেস্টের জার্সিতেও। আইপিএলের জার্সি তৈরির সময় যে রকম রঙের আধিক্য রাখা হয়, সেটা টেস্ট দলের জার্সিতেও রয়েছে বলে মনে করছেন অনেকে।
বাংলার অধিনায়ক তথা রাজ্যের ক্রীড়া রাষ্ট্রমন্ত্রী মনোজ তিওয়ারি স্পষ্ট ভাষায় এই জার্সির বিরোধিতা করলেন। আনন্দবাজার অনলাইনকে বললেন, “এই জার্সিটা দেখে আমার একদম ভাল লাগেনি। আগেকার দিনে পুরো ধবধবে সাদা জার্সি দেখে মনে হত সত্যিকারের টেস্ট খেলার জার্সি। একটা আলাদা ঐতিহ্য ছিল ওই জার্সিতে। সেটা এই জার্সিতে নেই। বড্ড বেশি রঙের আধিক্য।” ভারতের হয়ে সীমিত ওভারের ক্রিকেটে রঙিন জার্সি পরে মনোজ খেলেছেন। তবে ঘরোয়া ক্রিকেটে বাংলাকে নেতৃত্ব দেওয়ার সময় সাদা জার্সিতেই নামতে হয় তাঁকে। সেই রংটাই ভারতীয় দলের জার্সিতে থাকলে ভাল হয় বলে মনে করছেন মনোজ।
আইসিসির প্রতিযোগিতায় খেলতে নামলে সামনে স্পনসরের লোগো লাগানো যায় না। সেখানে থাকে দেশের নাম। এই নিয়ম সব প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। ফলে গত মাসে ভারত যখন বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনাল খেলতে নেমেছিল, তখন বুকের কাছে স্পনসরের নামের বদলে দেশের নামটাই বড় করে লেখা ছিল। কিন্তু সেই নামটি বাকি জার্সির রঙের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে তৈরি করা হয়েছিল। এ ক্ষেত্রে ভারতীয় জার্সিতে দুটো বিপরীতধর্মী রং দৃষ্টিকটুই লাগছে বলে অনেকের মত।
কেউ কেউ বলছেন, স্রেফ টাকার জন্য বোর্ড এটা করেছে। স্পনসরদের গুরুত্ব না দিলে এই টাকাটা আসবে না। বাংলা ক্রিকেট দলের সহকারী কোচ সৌরাশিস লাহিড়ি বললেন, ‘‘টাকার জন্যই তো করা হয়েছে। এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু এর মধ্যে অন্যায়টা কী আছে। সংস্থা ভারতীয় দলের জার্সি বানিয়েছে, যারা প্রধান স্পনসর তারা তো চাইবেই নিজের বিজ্ঞাপন করতে।”
কিছু সমর্থক জার্সির নকশা বদলের বিষয়টিকে সমর্থন করছেন অন্য একটি দিক থেকে। তাঁদের বক্তব্য, টেস্ট ক্রিকেটকে জনপ্রিয় করতে গেলে গোড়ার দিকের জিনিসগুলিতে আগে নজর দিতে হবে। তার মধ্যে প্রধান হল দলের জার্সি। আকর্ষণীয় জার্সি পরে নামলে দর্শকেরা আকৃষ্ট হয়ে আরও বেশি করে খেলা দেখতে আসবেন। কেউ কেউ এগিয়ে গিয়ে এটাও বলে দিচ্ছেন, অনেক তো হল সাদা রঙের ছোঁয়া। ক্রিকেটের সবচেয়ে পুরনো ফরম্যাটে যদি এ বার একটু বদল আসে, ক্ষতি কী!
সেই সুরেই কথা বললেন সম্বরণ বন্দ্যোপাধ্যায়। বাংলার প্রাক্তন অধিনায়ক বললেন, “জার্সিটা দেখে খুব তরতাজা লাগছে। বেশ নতুনত্ব আছে জার্সির মধ্যে। আমার তো বেশ ভাল লেগেছে জার্সিটা। এখনকার সময়ে দাঁড়িয়ে আমরা এটা প্রত্যাশা করতে পারি না যে সুনীল গাওস্কর যে জার্সি পরতেন, বিরাট কোহলিও সেই একই জার্সি পরবে।”
টেস্ট দলের জার্সিতে কি সত্যিই রয়েছে আইপিএলের প্রভাব? তাতে কি আদৌ ক্রিকেটের ক্ষতি হতে পারে? মানতে রাজি নন সৌরাশিস। তাঁর মতে, পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মেলাতেই হবে। না হলে আখেরে ক্ষতি হবে খেলাটারই। বলেছেন, “আইপিএলের প্রভাব যে জার্সিটায় রয়েছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। অনেক দিন ধরেই আইসিসি চেষ্টা করছে জার্সিতে পরিবর্তন আনতে। জার্সিতে সংখ্যা এসেছে। রংও এল। নতুন কিছু এলে একটু সময় লাগে মেনে নিতে। কিন্তু পরিবর্তন তো হবেই। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক কিছুই পাল্টায়। ক্রিকেট খেলাটাও অনেক পাল্টে গিয়েছে।’’
অর্থাৎ জার্সির বিরোধিতা যেমন রয়েছে, তেমনই পক্ষেও মুখ খুলেছেন বিশেষজ্ঞেরা। জার্সি যেমনই হোক না কেন, কোহলি, রোহিত থেকে তরুণ যশস্বী জয়সওয়াল, প্রত্যেকেই জার্সির ছবি পরে ক্যামেরার সামনে ‘পোজ়’ দিয়েছেন। এখনও পর্যন্ত কোনও ক্রিকেটারই জার্সি সম্পর্কে মুখ খোলেননি। আগামী দিনেও তাঁরা এ নিয়ে কোনও মন্তব্য করবেন বলে মনে হয় না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy