Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
প্রেরণা ছিল তিরাশি, স্বপ্নের মুহূর্ত ২০১১
India

India's 1000th ODI: ১০০০ ওয়ান ডে-র মাহেন্দ্রক্ষণ, বিস্ময় বালকের চোখে

কপিলের ১৯৮৩-র পরে ২০১১-র ২ এপ্রিল। মহেন্দ্র সিংহ ধোনির নেতৃত্বে দ্বিতীয় বার বিশ্বকাপ জয়। ভারতের হাজারতম ওয়ান ডে যাত্রায় সেরা দুই শৃঙ্গ জয়।

স্বপ্নপূরণ: ২ এপ্রিল, ২০১১-র সেই স্মরণীয় রাত। বিশ্বকাপ জয়ের পরে সতীর্থদের কাঁধে সচিন।

স্বপ্নপূরণ: ২ এপ্রিল, ২০১১-র সেই স্মরণীয় রাত। বিশ্বকাপ জয়ের পরে সতীর্থদের কাঁধে সচিন। ফাইল চিত্র।

সুমিত ঘোষ
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ০৬:১৯
Share: Save:

আমদাবাদে রবিবার ঐতিহাসিক হাজারতম ওয়ান ডে খেলতে নামছে ভারত। ১৯৭৪ সালে সীমিত ওভারের যাত্রা শুরু করা ভারতই বিশ্বের মধ্যে প্রথম দেশ, যারা এই মাইলফলকে পৌঁছচ্ছে। আর সচিন তেন্ডুলকর এমন এক কিংবদন্তি, যিনি এই যাত্রাপথে দেশের হয়ে সব চেয়ে বেশি ম্যাচ, সর্বাধিক রান, সব চেয়ে বেশি সেঞ্চুরির মালিক হওয়ার একচেটিয়া সব কৃতিত্বের অধিকারী।

ভারতীয় ক্রিকেটের এমন মাহেন্দ্রক্ষণ উপলক্ষে শুক্রবার একান্ত সাক্ষাৎকারে কথা বলতে গিয়ে সচিন জানিয়ে দিলেন, তিরাশির বিশ্বকাপ জয়ই তাঁর ক্রিকেটজীবনে সব চেয়ে বড় প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। তাঁর কথায়, ‘‘এর আগেও আমি ক্রিকেট খেলেছি। কিন্তু পাশাপাশি ফুটবল, টেবল টেনিস, ব্যাডমিন্টন, হকি সবই খেলতাম। কপিল দেবের ভারত যখন তিরাশি বিশ্বকাপ জিতল, তখন আমার মনের মধ্যেও গেঁথে গেল স্বপ্নটা যে, আমাকেও একদিন বিশ্বকাপ জিততে হবে।’’ ওয়ান ডে নিয়ে তাঁর মনে ভাবনা এল কবে থেকে? সচিনের জবাব, ‘‘এটা ঠিক যে, আমি টেস্ট ক্রিকেটই সব সময় বেশি করে খেলতে চেয়েছি। কিন্তু মনে হত, ওয়ান ডে-তে সুযোগ পাওয়াও কঠিন হবে না। কারণ আমি জোরে বল মারতে পারি।’’

বিস্ময় বালক হিসেবে পাকিস্তানে অভিষেক সফরের সেই বিখ্যাত ম্যাচের কথা টেনে আনেন সচিন। পেশোয়ারে আব্দুল কাদিরকে নিয়ে সে দিন রীতিমতো ছেলেখেলা করেন তিনি। ক্রিকেটবিশ্বের কাছে সেটাই ছিল তাঁর আবির্ভাব ঘোষণার লগ্ন। সচিন বলছেন, ‘‘পেশোয়ারের সেই ম্যাচটা ওয়ান ডে ছিল। কিন্তু বৃষ্টিতে ভেস্তে যায়। মাঠে প্রচুর দর্শক বসে রয়েছে খেলা দেখার অপেক্ষায়। তখন ঠিক হয় প্রীতি ম্যাচ হবে। বলা যায়, আমার জীবনের প্রথম বেসরকারি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ। ৫৩ রান করেছিলাম ১৮ বলে। কয়েকটা বড় ছক্কা মেরেছিলাম। উপভোগ করেছিলাম চ্যালেঞ্জটা।’’ বিস্ময় বালকের আগ্রাসনের সামনে প্রয়াত কিংবদন্তি লেগস্পিনার আব্দুল কাদিরের একটি ওভারের হিসাব ছিল এ রকম: ৬, ০, ৪, ৬, ৬, ৬। কাদিরের নাম তোলাতে অবশ্য মুহূর্তের জন্য বিষণ্ণ শোনাল তাঁকে, ‘‘দুর্ভাগ্যজনক ভাবে উনি আমাদের মধ্যে আর নেই।’’ সেই ম্যাচের স্মৃতিচারণে ফিরে যোগ করলেন, ‘‘টিমের সতীর্থরাও কেউ আমাকে ও ভাবে ব্যাট করতে দেখবে, ভাবেনি। আমরা তো তখন টেস্ট ম্যাচ ব্যাটিং ভঙ্গিতে ছিলাম। আমি যে উঁচুতে বল তুলে মারতে পারি, কেউ জানত না। ওই ইনিংসটা খেলেই কিন্তু আমার মনে হয়েছিল, ওয়ান ডে ক্রিকেটও খেলতে পারব।’’

ঐতিহাসিক: ২৫ জুন, ১৯৮৩। বিশ্বকাপ হাতে কপিল।

ঐতিহাসিক: ২৫ জুন, ১৯৮৩। বিশ্বকাপ হাতে কপিল। ফাইল চিত্র।

প্রথম দিকে মিডল অর্ডারে ব্যাট করতেন সচিন। ১৯৯৪-তে প্রথম ওপেন করেন নিউজ়িল্যান্ডে। নভজ্যোত সিংহ সিধু আহত থাকায়। তার পর থেকেই অন্য মুর্তির সচিন। সেই ম্যাচে ৪৯ বলে ৮২ পাল্টে দিয়ে যায় সচিন ও ভারতের ওয়ান ডে রূপরেখা। পরে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে জুটি বেঁধে ওয়ান ডে ক্রিকেটের সেরা ওপেনিং যুগলবন্দি তৈরি করেন তিনি। ওয়ান ডে-তে তাঁর ৪৯টি সেঞ্চুরির ৪৫টি ওপেনার হিসেবে। মোট ৪৬৩ ম্যাচে করেছেন ১৮,৪২৬ রান। যদিও মনে করিয়ে দিতে দেরি করছেন না, ‘‘এ সবই সম্ভব হয়েছে তিরাশি বিশ্বকাপের ওই মুহূর্তটার জন্য। লর্ডস ব্যালকনিতে কপিল দেবের হাতে বিশ্বকাপ উঠতে দেখাই সেরা প্রেরণা।’’

কপিলের ১৯৮৩-র পরে ২০১১-র ২ এপ্রিল। মহেন্দ্র সিংহ ধোনির নেতৃত্বে দ্বিতীয় বার বিশ্বকাপ জয়। ভারতের হাজারতম ওয়ান ডে যাত্রায় সেরা দুই শৃঙ্গ জয়। ১৯৮৩ যেমন সেরা প্রেরণা, ২০১১ তেমনই সর্বসেরা মুহূর্ত, একটুও না ভেবে বলে দিচ্ছেন সচিন। পাঁচ বারের ব্যর্থ চেষ্টার পরে অধরা বিশ্বকাপ জেতেন তিনি। মেরিন ড্রাইভে ট্র্যাফিক জ্যাম কখনও ভুলতে পারবেন না তিনি। ‘‘২০১১ বিশ্বকাপ জয় আমার জীবনের সর্বসেরা মুহর্ত কারণ প্রথম দিন থেকে এই স্বপ্নটাই যে দেখে এসেছি। আর অনেক অপেক্ষার পরে সেই লক্ষ্যে পৌঁছতে পেরেছিলাম।’’ কে ভুলতে পারবে বিরাট কোহলিদের কাঁধে চড়ে জাতীয় পতাকা দোলাতে দোলাতে তাঁর সেই ওয়াংখেড়েতে ভিকট্রি ল্যাপ দেওয়ার আবেগপূর্ণ ছবি!

এই যাত্রাপথে ওয়ান ডে ক্রিকেটের নানা বিবর্তনের সাক্ষী তিনি। বলছিলেন, ‘‘একটা সময় পূর্ব ভারতে, গুয়াহাটির মতো জায়গায় সকাল পৌনে ন’টায় ওয়ান ডে ম্যাচ শুরু হত। সকালের পিচ অনেক বেশি প্রাণবন্ত থাকে। বোলাররা অনেক বেশি সাহায্য পায়। সাদা পোশাকে লাল বলে এই সব জায়গায় তখন ওয়ান ডে খেলা ব্যাটসম্যানদের জন্য মোটেও সহজ ছিল না।’’ আরও পর্যবেক্ষণ, ‘‘খেলাটা অনেকটাই পাল্টেছে। ওয়ান ডে-তে রিভার্স সুইং হতে দেখি না। হলেও হয়তো শেষ চার-পাঁচ ওভারে গিয়ে হয়। আমাদের সময়ে একটা বলে যখন খেলা হত, ২০-২২ ওভারে গিয়ে রিভার্স শুরু হয়ে যেত। বলের রং পাল্টে যেত। নরম হয়ে যেত। সময় পাল্টেছে, নিয়ম পাল্টেছে খেলাটাও পাল্টেছে।’’ নিয়ম বদলের ফলে ব্যাটসম্যানদের কাজ যে আরও সহজ হয়ে গিয়েছে, সন্দেহ নেই। সচিনও মানছেন সে কথা, ‘‘এখন দু’টো বলে খেলা হয়, ফিল্ডিং বিধিনিষেধও অনেক শিথিল হয়েছে। ব্যাটসম্যানের স্ট্রাইক রেট বেড়েছে, বোলারদের ওভার প্রতি দেওয়া রানও বাড়ছে। নব্বইয়ের দশকে যে স্কোরটা নিরাপদ মনে হত, এখন সেটা উদ্বেগ ছড়ায় না। আমার মনে আছে, একটা ম্যাচে ৪৭তম ওভারে ওয়াসিম আক্রম স্লিপ রেখে বল করছিল। এখন সে রকম কিছু দেখার সম্ভাবনা কম।’’

হাজারতম ওয়ান ডে উপলক্ষে সচিন কৃতিত্ব দিচ্ছেন ভারতীয় ক্রিকেটের সঙ্গে যুক্ত সকলকে। তাঁর কথায়, ‘‘ক্রিকেটার থেকে শুরু করে বোর্ড প্রশাসক সকলের অবদান রয়েছে। সব চেয়ে বেশি অবদান সমর্থক, শুভানুধ্যায়ীদের। ওঁরা পাশে না থাকলে এই মাহেন্দ্রক্ষণে পৌঁছনো সম্ভব হত না।’’ করোনা অতিমারির আতঙ্কের মধ্যে পুরোপুরি সম্ভব না হলেও দেশবাসীর কাছে তাঁর আবেদন, ‘‘স্বাস্থ্যবিধি মেনে ভারতীয় ক্রিকেটের এই মাহেন্দ্রক্ষণ উদ্‌যাপন করুন।’’

ওয়ান ডে ক্রিকেটে দু’শো রানের সীমা প্রথম অতিক্রম করে দেখিয়েছিলেন তিনিই। ২০০৮-এর গোয়ালিয়রে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে সেই ধুন্ধুমার ইনিংসের দিকে ফিরে তাকাতে গিয়ে সচিনের মনে পড়ছে, ‘‘প্রথম বাউন্ডারিটা পেয়েছিলাম ওয়েন পার্নেলের বলে অফড্রাইভে। ব্যাটে লাগার পরে দারুণ টেক-অফ করল। খুব জোরে বলটা মারিনি। বুঝলাম, আজ ভাল ব্যাটে-বলে হওয়ার দিন।’’ বলে চলেন তিনি, ‘‘কেউ সেঞ্চুরি, ডাবল সেঞ্চুরি করব বলে মাঠে নামতে পারে না। খেলতে খেলতে এগুলো হয়ে যায়। সে দিন আমারও তাই হয়েছিল। একটা বল বাকি থাকতে ডাবল সেঞ্চুরি পূর্ণ হয়। তবে মনে আছে, সারা শরীরে ব্যথা নিয়ে ম্যাচটা খেলেছিলাম। আর ঠিক করেছিলাম জিতলে বোর্ডের কাছে বিশ্রামের আবেদন করব। ম্যাচটা জিতি, তারপর বাকি সিরিজ়ের জন্য ছুটি চেয়ে নিতে হয়েছিল।’’

শারজায় অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে তাঁর সেই পর-পর দু’টো মরুঝড়-ইনিংস এবং ২০০৩ বিশ্বকাপে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সেঞ্চুরিয়নে ৯৮। ভারতের ওয়ান ডে জাদুঘরে যা অমূল্য রত্ন হিসেবে থেকে যাবে। মরুঝড়ের সেই যমজ ইনিংস নিয়ে তিনি বলছেন, ‘‘অস্ট্রেলিয়া একেই বড় রান তুলেছিল। তার উপরে আমাদের ওভার সংখ্যা কমে গিয়েছিল। তাতে টার্গেট স্কোর কমেছিল দুই না তিন রান। জানি না, কী ধরনের হিসাব ছিল সেটা। আমাদের একটা নির্দিষ্ট স্কোর তুলতে হত ফাইনালে পৌঁছতে হলে। আমি কিন্তু পরিষ্কার বলেছিলাম, ম্যাচ জেতার লক্ষ্য নিয়ে নামব। অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়েই ফাইনালে যেতে হবে আমাদের। শেষ পর্যন্ত আমরা খুব অল্প রানে ম্যাচটা হেরে গিয়েছিলাম, কিন্তু ফাইনালের যোগ্যতা অর্জন করি।’’ বিতর্কিত এলবিডব্লিউ আউট না হলে সে দিন হয়তো ম্যাচ জিতিয়ে ফিরতে পারতেন সচিন। বলেও ফেললেন, ‘‘আহা, তখন যদি তৃতীয় আম্পায়ার এবং ডিআরএস থাকত! ওয়ান ডে বিবর্তনে এটাও কিন্তু বড় পরিবর্তন। তৃতীয় আম্পায়ার এবং ডিআরএস অনেক তফাত গড়ে দিয়েছে।’’ শারজায় ফিরলেন আবার, ‘‘ওই ম্যাচটার পরে বেশ বুঝতে পারছিলাম, অস্ট্রেলিয়ার মনোভাবও পাল্টে গিয়েছে। ওদের চোখেমুখে উদ্বেগ লক্ষ্য করেছিলাম। ফাইনাল আমরা কর্তৃত্ব নিয়েই জিতেছিলাম।’’

দক্ষিণ আফ্রিকায় ২০০৩ বিশ্বকাপে সেঞ্চুরিয়নে পাকিস্তান ম্যাচের আগে তিনি নিদ্রাহীন রাত কাটাচ্ছিলেন বলেও ফাঁস করলেন সচিন। ‘‘ম্যাচটা নিয়ে আমি খুব বেশি ভাবছিলাম। এমনিতেই পাকিস্তান ম্যাচ। উত্তেজনার মাত্রাই অন্য রকম। তার উপর বিশ্বকাপ। আমি খুব মরিয়া ছিলাম ভাল কিছু করার জন্য। সেই কারণেই বোধ হয় ম্যাচটার আগে রাতের ঘুম চলে গিয়েছিল।’’ মাঠে গিয়ে আবহ দেখে আরওই তিনি বুঝতে পারেন, সেরা থিয়েটার-মঞ্চ তৈরি। ‘‘পাকিস্তান বড় রান তুলেছিল। ওদের বোলিং আক্রমণ সেরা ছিল। কিন্তু আমরা শুরুতেই পাল্টা আক্রমণে ঝড় তুলে দিতে পেরেছিলাম। সেই ধাক্কা আর কাটিয়ে উঠতে পারেনি ওরা। এই ম্যাচটা নিয়ে এত ভেবেছিলাম যে, জিততে পেরে দারুণ খুশি ছিলাম।’’ এখনও সেই বিস্ময় ইনিংসের স্মৃতি এত টাটকা যে, মনে হবে, ওই তো সেঞ্চুরিয়ন মাঠের সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসছেন। আক্রম, ওয়াকার, শোয়েবদের ধ্বংস করে!

অন্য বিষয়গুলি:

India World Cup 2011 Kapil Dev Sachin Tendulkar
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy