Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
SUBHMAN GILL

কৃষক পরিবারে সোনার ফসল

পরের দিনই শুভমন চলে আসেন কোচ ঘাউড়ির পরিচালনায় চলতে থাকা বোলিং শিবিরে। সেখানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাঁকে ব্যাট করে যেতে হয়।

কীর্তি: দ্বিশত রান গিলের। পঞ্চম ভারতীয় হিসেবে। পিটিআই

কীর্তি: দ্বিশত রান গিলের। পঞ্চম ভারতীয় হিসেবে। পিটিআই

সুমিত ঘোষ
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৯ জানুয়ারি ২০২৩ ০৮:৩০
Share: Save:

মোহালিতে আয়োজিত এক বোলারদের শিবির। কে জানত, সেখান থেকেই বেরিয়ে আসবে ভবিষ্যতের ব্যাটিং তারকা!

ষিনি এক দিন অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ জয়ী ভারতীয় দলের প্রধান তারকা হয়ে উঠবেন। মেলবোর্ন, ব্রিসবেনে স্ট্রোকের তুবড়ি জ্বালাবেন। আইপিএল ফ্র্যাঞ্চাইজিরা কোষাগার ভাঙবে! আর বুধবার হায়দরাবাদে দ্বিশতরানে পৌঁছবেন তিন ছক্কা মেরে। একদিনের ক্রিকেটে ভারতের সপ্তম দ্বিশত রান (এর আগের ছটি যথাক্রমে সচিন, সহবাগ, রোহিত, রোহিত, রোহিত এবং ঈশান কিশানের)।

তিনি শুভমন গিল— আজও নিশ্চয়ই মনে রেখেছেন কিশোর বয়সের সেই শিবিরকে। তাঁর পরিবার যে ভোলেনি, তা তো তাঁর তিন ছক্কা আছড়ে পড়ার পর-পরই জেনে নেওয়া গেল। দ্রুত গিলের আবিষ্কর্তার মোবাইলে পৌঁছে গেল নায়কের বাবার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা বার্তা— ‘আবারও অনেক ধন্যবাদ জানাই। অনেক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি। সে দিন আপনি ওকে খুঁজে না পেলে এই দিনটাও হয়তো আসত না।’’ নতুন কিছু নয়। ছেলে ভাল কিছু করলেই এই বার্তা পৌঁছে যায় আবিষ্কর্তার ফোনে।

যাঁর মোবাইল এই বার্তা গেল, তিনি এক সময় এডি হেমিংসকে চার ছক্কায় ফলো-অন বাঁচানো কপিল দেবের বোলিং সতীর্থ ছিলেন। বুধবার গিল যখন অনুচ্চারিত ঔদ্ধত্য আর দুরন্ত সময়জ্ঞানে দুশো পেরোচ্ছেন, আবিষ্কর্তা রাস্তায় ছিলেন। তাই দেখতে পাননি এমন ঝকমকে একটা ইনিংস। গিলের বাবার বার্তা পেয়ে জানতে পারেন, মোহালির সেই শিবিরে বোলার খুঁজতে এসে আবিষ্কার করা কুঁড়ি ফুল হয়ে ফুটেছে হায়দরাবাদের উপলে।

তিনি কর্সন ঘাউড়ি কলকাতা থেকে ফোন পেয়ে বেশ উত্তেজিত। এক সময় বাংলায় কোচিং করিয়ে যাওয়া প্রাক্তন বাঁ হাতি পেসারের গলায় আবেগ, ‘‘সত্যিই কী অভাবনীয় ঘটনা! মোহালিতে গিয়েছিলাম বোলার তৈরির শিবির করতে। আমার সঙ্গে সহকারী কোচ যোগী পুরী। বৃষ্টি হচ্ছিল বলে শিবির বন্ধ করতে হয়েছিল। দু’জনে মিলে গিয়েছিলাম বাইরেটা ঘুরে দেখতে।’’ তার পরের কাহিনি বুধবারের ম্যাচের মতোই রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনায় ভরা। ঘাউড়ি দেখেন পাশের মাঠে বৃষ্টির মধ্যেও খেলা চলছে আর সেখানে দারুণ ব্যাট করছে একটি ছেলে। ব্যাটিংয়ের রাজকীয় ভঙ্গি, নিখুঁত স্টান্স নজর কেড়ে নেয় তাঁর। কে এই ছেলেটা? কাউকে যে জিজ্ঞেস করবেন, সে উপায়ও নেই কারণ আশেপাশে কোনও লোকজন নেই। শেষে ঘাউড়ি এবং তাঁর সতীর্থ দেখলেন, গাছের তলায় দাঁড়িয়ে মন দিয়ে খেলা দেখছেন এক মধ্যবয়স্ক ব্যক্তি। তাঁর কাছে গিয়েই তাঁরা জানতে চান, ছেলেটি কে? উত্তর আসে, ‘‘ও আমার ছেলে। ওর নাম শুভমন গিল।’’ এর পরে ঘাউড়ির কথায়, ‘‘তক্ষুনি আমি ওর বাবাকে বলি, পরের দিনই যেন ছেলেকে আমাদের ক্যাম্পে পাঠায়। শিবিরে যথেষ্ট ব্যাটসম্যান ছিল না। বোলারদের খেলার মতোও তো কাউকে লাগবে। প্রথম দর্শনেই আমার মনে হয়েছিল, এ ছেলে অনেক লম্বা দৌড়ের ঘোড়া।’’

পরের দিনই শুভমন চলে আসেন কোচ ঘাউড়ির পরিচালনায় চলতে থাকা বোলিং শিবিরে। সেখানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাঁকে ব্যাট করে যেতে হয়। যে-হেতু বোলারদের খেলার জন্য আর কোনও ব্যাটসম্যান ছিল না। আর তখনই ঘাউড়ি আরও নিশ্চিত হয়ে যান, সোনা চিনতে ভুল হয়নি তাঁর। বুধবার সন্ধ্যায় বলছিলেন, ‘‘প্রায় দুই সপ্তাহ শিবিরে ব্যাট করেছিল শুভমন। তখন ওর বয়স ১২। আর শিবিরটা হচ্ছিল অনূর্ধ্ব-১৯ ছেলেদের। তখনই বড় বড় ছেলেদের বোলিং অনায়াসে খেলে যাচ্ছিল ও।’’ এখানেই শেষ নয়। ঘাউড়ি এর পরে পঞ্জাব ক্রিকেট সংস্থার প্রধান মোহিন্দর পাণ্ডবকে বলেন, ‘‘এখনই অনূর্ধ্ব-১৪ রাজ্য দলে এই ছেলেটিকে নিন।’’ পাণ্ডবদের কৃতিত্ব, তাঁরা কোচ ঘাউড়ির বক্তব্যকে সম্মান জানিয়েছিলেন। এর পরে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি গিলকে।

সেই বোলারদের শিবিরে ঘাউড়ি বারবার একটা কথা বলতেন গিলকে। ‘‘আগে রক্ষণ ঠিক করো। মনঃসংযোগ করো। ভাল রক্ষণ না থাকলে আক্রমণ করা যায় না। রাহুল দ্রাবিড়কে দ্যাখো, দুর্ভেদ্য প্রাচীর। অটল মনঃসংযোগ।’’ কে জানত, ছোটবেলায় শোনা সেই নাম একদিন তাঁর কোচ হয়ে দেখা দেবেন। যুব দলে গুরু রাহুলকে পাওয়া তাঁর ব্যাটিংকে আরও মজবুত করে তোলে। ছোটবেলায় সিমেন্টের পিচে ব্যাটিং অনুশীলন দারুণ ব্যাকফুট তৈরি করে দিয়েছে। ঘাউড়ি মনে করেন, ‘‘ওর স্টান্স, স্ট্রোকের মধ্যে গ্রেগ চ্যাপেলের ছায়া খুঁজে পাই। দিলীপ বেঙ্গসরকরের কথাও মনে করায়।’’

ঘাউড়ি যদি ইউরেকা মুহূর্তের মালিক হন, ছেলের জন্য আত্মত্যাগ করার পুরস্কার প্রাপ্য লখবিন্দর সিংহের। যিনি সে দিন গাছতলায় বসে খেলা দেখছিলেন বলে ঘাউড়ি কাউকে পেয়েছিলেন, ছেলেটি সম্পর্কে খোঁজ নেওয়ার জন্য। এমনই সাধুর মতো ধ্যান করে গিয়েছেন লখবিন্দর। ছেলেকে ক্রিকেটার বানাবেন বলে। তাঁদের পরিবার কৃষকের পরিবার। আর্থিক স্বচ্ছলতা কোনও দিনই অন্তরায় ছিল না গিলের। কিন্তু নিজেদের জীবনের স্বার্থ-স্বাচ্ছন্দ্য ত্যাগ করার বিরাট সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল তাঁর বাবাকে। ভারত-পাকিস্তান সীমান্তের কাছাকাছি অবস্থিত ফাজ়িলকা নামে ছোট এক গ্রামে থাকতেন তাঁরা। সেখান থেকে চণ্ডীগড় চলে আসার সিদ্ধান্ত নেন ছেলের ক্রিকেট পৃথিবী গড়ে তুলবেন বলে। গ্রামের জীবন ছেড়ে মোহালির মতো বড় শহরে চলে আসা মোটেও সহজ ছিল না। কিন্তু গিলের পরিবারের চোখে স্বপ্ন ছিল— এক দিন সব ত্যাগ সার্থক করে ছেলে সারা দেশের গর্ব হয়ে উঠবে। সেই স্বপ্নপূরণের জন্য বাবা অক্লান্ত ভাবে বল ছুড়ে ছুড়ে ব্যাটিং তালিম দিয়ে গিয়েছেন ছেলেকে।

লখবিন্দরদের স্বপ্ন মিথ্যা হতে দেননি শুভমন গিল। ফাজ়িলকার কৃষক পরিবারে সোনার ফসল ফলেছে!

অন্য বিষয়গুলি:

SUBHMAN GILL India Cricket
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy