আদর্শ সিংহ। —ফাইল চিত্র।
অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচেই নজর কেড়েছেন ভারতীয় দলের ওপেনার আদর্শ সিংহ। বাংলাদেশের বোলারেরা প্রথম থেকেই ভারতের দুই ওপেনারকে স্লেজিং শুরু করেছিলেন। সেই ফাঁদে পা না দিয়ে ঠান্ডা মাথায় খেলেন আদর্শ। তাঁর ৭৬ রানের ইনিংস দলকে নির্ভরতা দিয়েছিল। শনিবারের ম্যাচের পর থেকে আলোচনায় উঠে এসেছেন আদর্শ। তরুণ ওপেনারের মানসিকতার প্রশংসা করেছেন ক্রিকেট বিশেষজ্ঞেরা। আদর্শের ইনিংস দেখে অনেকে বিস্মিত হলেও এমনই প্রত্যাশা করেছিলেন তাঁর দাদা অঙ্কিত সিংহ।
অঙ্কিত জানিয়েছেন, কোভিডকালে পরিবারের আর্থিক সঙ্কটই ভাইকে মানসিক ভাবে পরিণত করেছে। তাই বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের টানা স্লেজিং তাঁকে উদ্বিগ্ন করেনি। ভাইয়ের উপর আস্থা ছিল তাঁর। অঙ্কিত বলেছেন, ‘‘খুব খারাপ সময়ের মধ্যে গিয়েছি আমরা। আমাদের বাবা একটি গয়না তৈরির কারখানায় কাজ করতেন। মাসে ২৫ হাজার টাকা বেতন পেলেন। লকডাউনের সময় বাবার কারখানা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। প্রায় একই সময় কাজ চলে যায় আমারও। পরিবারে তখন একমাত্র উপার্জনকারী ছিলেন আমাদের মা। তিনি অঙ্গনওয়ারি কর্মী। তাঁর আয়ই ছিল আমাদের একমাত্র ভরসা।’’
অঙ্কিত জানিয়েছেন, সে সময় তাঁদের দু’বেলা খাবার জুটত না ঠিক মতো। তবু ছোট ছেলের বড় ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্নে ধাক্কা লাগতে দেননি নরেন্দ্র কুমার সিংহ। আদর্শ যাতে ক্রিকেট চালিয়ে যেতে পারেন, তাই জমি বিক্রি করে দেন তিনি। জমি বিক্রির টাকা আদর্শের নামে ব্যাঙ্কে রেখে দিয়েছিলেন। অর্থকষ্ট সত্ত্বেও সেই টাকায় হাত দেননি। এ জন্য আত্মীয়, প্রতিবেশীদের সমালোচনাও শুনতে হয়েছিল তাঁর বাবাকে।
অঙ্কিত বলেছেন, ‘‘পরিস্থিতি সামলাতে কানপুরে টিউশন পড়াতে শুরু করি। তাতে কোনও রকমে প্রয়োজনীয় খরচ চলছিল। জমি বিক্রির সিদ্ধান্তটা সম্পূর্ণ বাবার ছিল। সব জমি বিক্রি করে আদর্শের জন্য টাকা রেখে দিয়েছিলেন। বাবা নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন, ভাইয়ের ক্রিকেটের যেন কোনও ক্ষতি না হয়। পরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে ক্রিকেট শুরু হয়। খেলে আবার টাকা পেতে শুরু করে আদর্শ। পরিস্থিতি কিছুটা সহজ হয়।’’ কেন সমালোচনা করেছিলেন আত্মীয়, প্রতিবেশীরা? অঙ্কিত বলেছেন, ‘‘রাজপুতানার মানুষের কাছে আত্মসম্মান খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের সমাজে কেউ সাধারণত জমি বিক্রি করে না। এটা খারাপ চোখে দেখা হয়। সন্তানের পড়াশোনা বা মেয়ের বিয়ের জন্যও জমি বিক্রি করে না কেউ। আর বাবা আদর্শের ক্রিকেটের জন্য জমি বিক্রি করেছিলেন। তাই সমালোচনা হয়েছিল।’’
নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের আদর্শ ক্রিকেট খেলুক প্রথমে চাননি তাঁর বাবা। তিনি চাইতেন, ছোট ছেলে পড়াশোনা করে ভাল চাকরি করুক। বাবাকে রাজি করাতে শর্ত দিয়ে ক্রিকেট শুরু করেছিলেন ১৮ বছরের ব্যাটার। অঙ্কিত বলেছেন, ‘‘প্রথমে ভাইয়ের ক্রিকেট খেলায় বাবার মত ছিল না। বাবা মনে করতেন পড়াশোনা না করলে ভবিষ্যত তৈরি হবে না। অঙ্কিত এক বছর সময় চেয়ে নিয়েছিল বাবার কাছে। বলেছিল, এক বছরের মধ্যে তেমন কিছু করতে না পারলে ক্রিকেট ছেড়ে পড়াশোনায় মন দেবে। কিন্তু সেই এক বছরের মধ্যেই আদর্শ উত্তরপ্রদেশের অনূর্ধ্ব-১৪ দলে জায়গা করে নেয়। পরের বছর নেতৃত্বও পায়। আর ওকে পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।’’
আদর্শদের বাড়ি উত্তরপ্রেশের জৌনপুর জেলার নেওয়াদা ঈশ্বরী গ্রামে। ছেলেদের পড়াশোনার জন্যই গ্রামের বাড়ি ছেড়ে কানপুরে ভাড়া উঠে এসেছিলেন নরেন্দ্র। অঙ্কিত বলেছেন, ‘‘বাবা কানপুরে চাকরি করতেন। আমাদেরও গ্রামের বাড়ি থেকে নিয়ে চলে এসেছিলেন। পরে তিনি মুম্বইয়ে চলে যান চাকরি করতে। মা অঙ্গনওয়ারি কর্মীর কাজ পান। বাবা মুম্বই চলে যাওয়ার পর মা আবার গ্রামের বাড়িতে ফিরে গিয়েছিলেন ভাইকে নিয়ে। আমি কানপুরে থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া শেষ করে চাকরি পাই। তখন আবার ভাইকে নিয়ে এসেছিলাম। তার পর থেকে ও ক্রিকেটে ধারাবাহিক ভাবে উন্নতি করেছে।’’
এক সময় যাঁরা সমালোচনা করতেন, এখন তাঁরাই আবার সিংহ পরিবারের সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরির চেষ্টা করছেন। হাসতে হাসতে অঙ্কিত বলেছেন, ‘‘আদর্শ ভারতীয় দলে ডাক পাওয়ার পর হঠাৎ করে সব কিছু বদলাতে শুরু করেছে। যাঁরা সমালোচনা করেছিলেন জমি বিক্রির সময়, তাঁরাই এখন ভাইয়ের প্রশংসা করছেন। আমাকে যে কত লোক সারা দিন মেসেজ আর ফোন করেন! আসলে সময় সব বদলে দেয়। সবাই এখন ইতিবাচক কথা বলেন। সবাই আদর্শের সাফল্য উপভোগ করছেন। আমরা কিন্তু এ সব নিয়ে এখনই ভাবতে চাইছি না। কারণ জীবনের কঠিন দিকটা আমরা আগেই দেখে নিয়েছি।’’
অঙ্কিত বলেছেন, আদর্শ উত্তরপ্রদেশের অনূর্ধ্ব-১৪ দলের অধিনায়ক হওয়ার পর থেকে বাড়ির সকলের মধ্যে একটা আশা তৈরি হয়। আদর্শের সঙ্গে তাঁরাও একই স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। নরেন্দ্রও ছোট ছেলের স্বপ্ন আগলাতে সমালোচনায় কান দেননি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy