Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Pooja Vastrakar

Pooja Vastrakar: বিশ্বকাপের মঞ্চে পাক সংহারের নায়িকা ‘ছোটা হার্দিক’ পাড়ায় খেলেই নজর কাড়েন

অনূর্ধ্ব ১৯ পর্যায়ের ক্রিকেট খেলে ১৫ হাজার টাকা পান পূজা। সাড়ে চার হাজার টাকায় নিজের প্রথম ইং‌লিশ উইলো ব্যাট কেনেন। খেলার জুতোও কেনেন।

পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আগ্রাসী মেজাজে পূজা বস্ত্রকার।

পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আগ্রাসী মেজাজে পূজা বস্ত্রকার। ছবি: এএফপি

নিজস্ব প্রতিবেদন
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৬ মার্চ ২০২২ ১৬:৪৬
Share: Save:

বিশ্বকাপে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের জয়ের অন্যতম কারিগর পূজা বস্ত্রকার। আটটি চারের সাহায্যে ৫৯ বলে ৬৭ রানের দুরন্ত ইনিংস খেললেন তিনি। ষষ্ঠ উইকেটের জুটি স্নেহ রাণার (৪৮ বলে অপরাজিত ৫৩) সঙ্গে যোগ করলেন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ১২২ রান। এই জুটিই ভারতের জয়ের ভিত গড়ে দেয়। আট নম্বরে ব্যাট করতে নেমে পূজার আক্রমণাত্মক ব্যাটিং নজর কেড়েছে ক্রিকেট বিশেষজ্ঞদেরও। ভারতীয় মহিলা দলের প্রিয় ‘ছোটা হার্দিক’-এর পারফরম্যান্সে উচ্ছ্বসিত তাঁর সতীর্থরাও।

কে এই পূজা বস্ত্রকার? ২০১৮ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে ভারতের হয়ে অভিষেক পূজার। এক দিনের ম্যাচ দিয়েই আন্তর্জাতিক মঞ্চে যাত্রা শুরু তাঁর।

এখনও পর্যন্ত দেশের হয়ে পূজা খেলেছেন ১৪টি এক দিনের ম্যাচ। ১৯.৭৬ গড়ে করেছেন ২৫৭ রান। অর্ধশতরান দু’টি। সর্বোচ্চ রবিবার পাকিস্তানের বিরুদ্ধে করা ৬৭। অলরাউন্ডার পূজা ডান হাতে ফাস্ট বোলিংও করেন। এক দিনের আন্তর্জাতিকে ছয়টি উইকেট রয়েছে তাঁর। দেশের হয়ে দু’টি টেস্ট এবং ২৪টি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলার অভিজ্ঞতা রয়েছে পূজার। ২০২১ সালের ১৬ জুন ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে টেস্ট অভিষেক হয়েছে ভারতীয় দলের এই অলরাউন্ডারের। মহিলাদের ঘরোয়া ক্রিকেটে জাতীয় পর্যায়ে খেলছেন ২০১৩ সাল থেকে।

ঘরোয়া ক্রিকেটে মধ্যপ্রদেশ দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য পূজার বাড়ি সে রাজ্যের ছোট শহর শাহদলে। বাবুলাল বা বাবলু নামেই তিনি পরিচিত ঘনিষ্ঠ এবং বন্ধু মহলে। মাত্র ৪ বছর বয়সেই পূজার ক্রিকেটে হাতেখড়ি পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে। তখন থেকেই ক্রিকেটের প্রতি ভালবাসা। পূজা এক বার বলেছিলেন, ‘‘আমাদের কলোনিতে আমরা ২২ জন বাচ্চা ছিলাম। ১১ জন করে দু’টো দল করে ক্রিকেট খেলতাম। তাছাড়া খো-খো, কবাডি, লুকোচুরিও খেলতাম আমরা। বাবা কষ্ট করে আমাদের সাত ভাই-বোনকে বড় করেছেন। আর্থিক স্বচ্ছলতা তেমন ছিল না। তবু আমার ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্নে কখনও বাধা দেননি।’’

প্রথাগত ক্রিকেট শেখা শুরু কয়েক বছর পর। স্থানীয় স্টেডিয়ামে আশুতোষ শ্রীবাস্তবের কাছে শুরু করেন ক্রিকেট শেখা। তিনিই পূজার প্রথম কোচ। আশুতোষ কয়েক দিন নেটে দেখার পর বুঝতে পারেন বড় ক্রিকেটার হওয়ার মশলা রয়েছে পূজার মধ্যে। তার পর থেকেই পূজার দিকে সব সময় বাড়তি নজর রাখতেন আশুতোষ।

মাত্র ১০ বছর বয়সে মাকে হারান পূজা। তাঁর বাবা চাকরি করতেন ভারত সঞ্চার নিগম লিমিটেডে। সাত ভাইবোনের মধ্যে সব থেকে ছোট পূজা। সীমিত আর্থিক সঙ্গতি এবং সাত সন্তানকে বড় করার সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর বাবা কনিষ্ঠ সন্তানের ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্নকে উৎসাহ দিয়েছেন সব সময়। তিনি নিজেও যে ক্রিকেট পাগল মানুষ। নিজে না খেললেও টিভিতে কোনও ক্রিকেট খেলাই বাদ দিতেন না।

পূজাকে খেলাধূলায় উৎসাহ দিয়েছেন তাঁর বড় দিদিও। তিনি নিজে এক সময় জাতীয় স্তরের অ্যাথলিট ছিলেন। পূজার মা হঠাৎ মারা যাওয়ার পর তাঁর দিদি অ্যাথলেটিক্স ছেড়ে দেন। তাঁদের বাবা কাজে চলে গেলে ছোটদের বাড়িতে একা রাখা সমস্যা হত।

অনুশীলনের জন্য দীর্ঘক্ষণ দিদির পক্ষে বাইরে থাকা সম্ভব হচ্ছিল না। অথচ ওঁর যথেষ্ট সম্ভাবনা ছিল আন্তর্জাতিক স্তরে ভাল কিছু করার। সংবাদপত্রে ওঁর ছবি দেখে গর্ব বোধ করতেন স্থানীয়রাও। কিন্তু পূজাকে ক্রিকেটার তৈরি করতে নিজের স্বপ্ন জলাঞ্জলি দেন বড় দিদি। ছোট ভাই বোনেদের তিনি বুঝতে দিতেন না মায়ের অভাব। তাঁর এই আত্মত্যাগও পূজার ক্রিকেটার হয়ে ওঠার পিছনে গুরুত্বপূর্ণ।

ছোট বয়সে ক্রিকেট খেলার সময় তাঁরা পাড়ার বহু বাড়ির কাচ ভেঙেছেন। কোনও বাড়িতে বল ঢুকে গেলে তা ফেরত পাওয়া যেত না। নিজেরাই দু’টাকা করে চাঁদা তুলে কিনতেন নতুন টেনিস বল। পাড়ার বড়দের বকাঝকা পাত্তা দিতেন না পূজা ও তাঁর বন্ধুরা। পাড়া ক্রিকেটে পূজার আদর্শ ছিলেন বিক্রান্ত সিংহ নামে এক যুবক। খুব জোরে বল মারতে পারতেন বিক্রান্ত। মূলত তাঁর পরামর্শেই প্রথাগত ক্রিকেট প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করেন পূজা।

ছোটবেলার কোচ আশুতোষ শ্রীবাস্তবের সঙ্গে পূজা।

ছোটবেলার কোচ আশুতোষ শ্রীবাস্তবের সঙ্গে পূজা। ছবি: টুইটার থেকে

সেও এক মজার গল্প। পাড়ায় ক্রিকেট খেলার সমস্যার জন্য মাঠের খোঁজ শুরু করেন পূজারা। বাড়ির কিছু দূরে স্থানীয় স্টেডিয়ামে দেখেন বেশ কিছু ছেলে ক্রিকেট খেলছে। সেখানেই বন্ধুদের সঙ্গে খেলতে শুরু করেন পূজা। ওই স্টেডিয়ামেই প্রশিক্ষণ দিতেন আশুতোষ। প্রথমে গুরুত্ব না দিলেও পরে পূজার ব্যাটিং নজর কাড়ে তাঁর। আশুতোষ নিজের অ্যাকাডেমিতে নিয়ে নেন পূজাকে। শুরু হয় প্রথাগত ক্রিকেট শেখা। প্রতিদিন বিকালে অনুশীলন।

ব্যাটার হিসেবে ক্রিকেট জীবন শুরু করলেও রাজ্য দলের হয়ে খেলার সময় শুরু করেন বোলিং। মধ্যপ্রদেশ মহিলা দলের তৎকালীন কোচ রেখা পুনেকর তাঁকে বোলিং করার পরামর্শ দেন। তিনিই অলরাউন্ডার হিসেবে গড়ে তোলেন পূজাকে। মাত্র ১৩ বছর বয়সেই সুযোগ পান মধ্যপ্রদেশের অনূর্ধ্ব ১৬ দলে। ১৫ বছর বয়সে জাতীয় স্তরে নজর কাড়েন তিনি। ২০১৬ সালে সুযোগ পান ভারতের মহিলাদের সবুজ দলে। একটি ম্যাচে ফিল্ডিং করার সময় হাঁটুতে গুরুতর চোট পান পূজা। জখম হয় তাঁর লিগামেন্ট। জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়ার স্বপ্ন ধাক্কা খায় তাঁর।

চোট ছিল বেশ মারাত্মক। ক্রিকেট জীবন শেষও হয়ে যেতে পারত। হাঁটুতে অস্ত্রোপচারের আট মাস পর মনের জোর সম্বল করে ফেরেন বাইশ গজের লড়াইয়ে। চোটের কাছে হারতে দেননি নিজের ভাসবাসাকে। আরও একবার আঁকড়ে ধরেন দেশের প্রতিনিধিত্ব করার স্বপ্ন। ২০১৮ সালে চ্যালেঞ্জার্স ট্রফিতে ভাল পারফরম্যান্স দরজা খুলে দেয় জাতীয় দলের। সুযোগ পান দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের জন্য ভারতীয় দলে। সে বছরই মহিলাদের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের দলেও সুযোগ পান পূজা।

ক্রিকেট সরঞ্জাম কেনার জন্য কখনও বাবার উপর চাপ দেননি। খেলে যা টাকা পেতেন তা দিয়েই কিনতেন। না পারলে সতীর্থদের সরঞ্জাম ব্যবহার করতেন। অনূর্ধ্ব ১৯ পর্যায়ের ক্রিকেট খেলে ১৫ হাজার টাকা পান। তা থেকে সাড়ে চার হাজার টাকা দিয়ে নিজের প্রথম ইং‌লিশ উইলো ব্যাট কেনেন। বারশো টাকা দিয়ে কেনেন খেলার জুতো।

বীরেন্দ্র সহবাগকে আদর্শ করে ক্রিকেট জীবন এগিয়ে নিয়ে চলেছেন পূজা। ভারতের প্রাক্তন ব্যাটারের আগ্রাসী ব্যাটিংয়ের ভক্ত তিনি। মহিলা ক্রিকেটে তাঁর আদর্শ ঝুলন গোস্বামী, মিতালি রাজ এবং অঞ্জুম চোপড়া। তাঁদের সঙ্গে এক সাজ ঘরে থাকার সুয়োগ পাওয়াই বিশেষ প্রাপ্তি বলে মনে করেন। বিশ্বের প্রথম মহিলা ক্রিকেটার হিসেবে লোয়ার অর্ডারে (নয়) ব্যাট করতে নেমে অর্ধশতরান করার কৃতিত্বও রয়েছে পূজার ঝুলিতে।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy