ভারতের অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপজয়ী দলের অধিনায়ক যশ ঢুল। ফাইল চিত্র
অপরাজিত থেকে বিশ্বকাপ চ্যম্পিয়ন হয়েছে ভারতের ছোটরা। ফাইনালে ইংল্যান্ড, সেমিফাইনালে অস্ট্রেলিয়া, কোয়ার্টারে গত বারের চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশকে হেলায় হারিয়েছে ভারতের অনূর্ধ্ব-১৯ দল। গ্রুপ পর্বের ম্যাচগুলিতে ভারতের জয়ের ব্যবধান ৪৫ রান, ১৭৪ রান, ৩২৬ রান। এগুলি পরিসংখ্যান। এর বাইরেও এ বারের বিশ্বকাপে ছোটরা জিতেছে আরও অনেক কিছু। সেগুলো সবই মাঠের বাইরের লড়াই।
ভারতের অনূর্ধ্ব-১৯ দলকে সবার আগে লড়তে হয়েছে কোভিডের সঙ্গে। একটা সময় দলে সম্পূর্ণ ফিট ক্রিকেটারের সংখ্যা দশে এসে ঠেকেছিল। সেই জন্যই চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর দলের জোরে বোলার রবি কুমার বলেন, ‘‘কঠিন পরিস্থিতিতে পর্দার আড়ালে থেকে যাঁরা কাজ করেছেন, বিশ্বকাপটা তাঁদেরও। কেউ কোনও খামতি রাখেননি।’’ ঠিকই। দলের ম্যানেজার কোভি়ড আক্রান্ত হওয়ার পর সম্পূর্ণ অন্য শহরে চলে গিয়েছিলেন। বিদেশ সফরে, বিশেষ করে ছোটদের ক্ষেত্রে দলের ম্যানেজারের ভূমিকা বিরাট। সেই কোভিড আক্রান্ত ম্যানেজার সবটাই সামলেছিলেন ফোনে। রবিরা তাঁর না থাকা টের পাননি। ফিজিয়ো ডাক্তারের কাজ সামলেছিলেন, ভিডিয়ো অ্যানালিস্ট হয়ে গিয়েছিলেন ম্যানেজার। নেপথ্যে থাকা এই মানুষগুলির জন্য রবিরা মনের আনন্দে খেলে গিয়েছেন।
প্রথম ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকাকে ৪৫ রানে হারিয়ে দেওয়ার পর থেকে ভারত প্রথম একাদশ নামাতে হিমশিম খেয়ে গিয়েছে। আয়ারল্যান্ডের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় ম্যাচের কয়েক ঘণ্টা আগে একাধিক ক্রিকেটারের কোভিড সংক্রমণ ধরা পড়ে। মাত্র দশজন ফিট ক্রিকেটার সেই সময় দলে ছিলেন। চোট থাকা ক্রিকেটারকে মাঠে নামাতে হয়।
কোভিড আক্রান্তদের মধ্যে অধিনায়ক যশ ঢুল ছিলেন। আয়ারল্যান্ড এবং তার পর উগান্ডা ম্যাচে খেলতে পারেননি ঢুল। তালিকায় যোগ হয় সহ-অধিনায়ক শাইক রশিদ, আরাধ্য যাদব, মানব পরখ এবং সিদ্ধার্থ যাদবের নাম। ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডকে দেশ থেকে বাড়তি ক্রিকেটার পাঠাতে হয়। বোলিং কোচ সাইরাজ বাহুতুলে, ফিল্ডিং কোচ মুনীশ বালিদের জল বয়ে নিয়ে যেতে হয়।
আয়ারল্যান্ডের বিরুদ্ধে ম্যাচ খেলতে যাওয়ার আধ ঘণ্টা আগে অলরাউন্ডার নিশান্ত সিন্ধু জানতে পারেন, তাঁকে ওই ম্যাচে অধিনায়কত্ব করতে হবে। তখন তিনি হোটেলের ঘরে হাতে টেপ ব্যান্ডেজ লাগাচ্ছিলেন। হঠাৎ দেখেন উইকেটরক্ষক দীনেশ বানা তাঁর ঘরের দিকে দৌড়ে আসছেন। ২০১১ বিশ্বকাপের ফাইনালে মহেন্দ্র সিংহ ধোনি যে রকম ছয় মেরে ভারতকে জিতিয়েছিলেন, গত শনিবার ফাইনালে সে রকমই ছক্কা মেরে দলকে চ্যাম্পিয়ন করা বানা হাঁপাতে হাঁপাতে সিন্ধুকে বলেন, ‘‘আজ তুই ক্যাপ্টন’’। সিন্ধু ভাবেন বানা মজা করছেন। হোটেলের লবিতে নামতে ভিভিএস লক্ষ্মণ এবং হৃষিকেশ কানিতকর তাঁকে বলেন, আয়ারল্যান্ড ম্যাচে তাঁকেই অধিনায়কত্ব করতে হবে।
শুধু আয়ারল্যান্ড নয়, পরের উগান্ডা ম্যাচেও তাঁকেই অধিনায়কত্ব করতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচের আগের দিন তিনিও কোভিড আক্রান্ত হন। সেই ম্যাচ খেলতে পারেননি। সুস্থ হয়ে সেমিফাইনাল, ফাইনালে মাঠে নামেন। তত দিনে ঢুলও সুস্থ হয়ে যান। অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ম্যাচ জেতানো শতরান করেন।
কোভিড হওয়ার পর ভেঙে পড়েছিলেন রশিদ। ব্যক্তিগত কোচ জে কৃষ্ণ রাওকে বলেন, তাঁর বিশ্বকাপটাই বোধ হয় শেষ হয়ে গেল। রাও তাঁকে উদ্বুদ্ধ করেন তাঁর বাবার কথা বলে। মনে করিয়ে দেন, তাঁর খেলা যাতে বন্ধ না হয় তার জন্য বাবা বালিশাভল্লিকে দু’বার চাকরি খোয়াতে হয়েছিল। রশিদ সেমিফাইনালে ৯৪ এবং ফাইনালে ৫০ রানের ইনিংস খেলেন।
মোট ১২টি উইকেট নিয়ে দলের সফলতম বোলার ভিকি অস্তবালেরও আসল সাফল্য মাঠের বাইরে। বাবা কানহাইয়ার সঙ্গে রোজ প্রায় পৌনে দু’ঘণ্টার সফর করে লোনাভালা থেকে ন’বছরের ভিকিকে মুম্বই আসতে হত অনুশীলন করতে। ছোটবেলার কোচ মোহন যাদব বলেন, ‘‘ওকে কিন্তু কখনও ক্লান্ত হতে দেখিনি।’’
যাদবের আর এক ছাত্র রাজবর্ধন হাঙ্গারগেকার এ বারের বিশ্বকাপে সব থেকে দ্রুত গতির বোলার ছিলেন। সঙ্গে ছিল ব্যাট হাতে বিশাল সব ছক্কা। ২০২০ সালে কোভিড কেড়ে নেয় তাঁর বাবাকে। ভেবেছিলেন, বিশ্বকাপ তো দূরের কথা, ক্রিকেটটাই হয়ত আর খেলা হবে না। বুঝিয়েছিলেন যাদব।
ফাইনালে ৩১ রানে পাঁচ উইকেট নিয়ে ম্যাচের সেরা হওয়া জোরে বোলার রাজ অঙ্গদ বাওয়ার লড়াইটা একটু অন্য ছিল। পাঁচ বছর বল করা নিষেধ ছিল রাজের। নিষেধ করেছিলেন তাঁর বাবা সুখবিন্দর বাওয়া। সুখবিন্দর নিজেও ক্রিকেটার ছিলেন। পরে কোচ হন। অনূর্ধ্ব-১৯ স্তরে যুবরাজ সিংহকেও কোচিং করানো সুখবিন্দর দেখেছিলেন তাঁর ছেলে ব্যাট-বল দুটোই করতে পারে। কিন্তু তিনি চেয়েছিলেন ছেলে ব্যাটার হোক। তাই পাঁচ বছর বল ছেড়ে শুধু মাত্র ব্যাটিংয়ে রাজকে মন দিতে বলেন তিনি। লুকিয়ে নেটে হাত ঘোরাতেন রাজ। বাবার কাছে তা গোপন থাকেনি। ব্যাটে রান আসায় ছেলেকে কিছু বলেননি তিনি। বিশ্বকাপে ব্যাট-বল সবেতেই ভাল করেছেন রাজ। ব্যাট হাতে তিনি করেছেন ২৫২ রান। ভারতীয়দের মধ্যে অঙ্গকৃষ রঘুবংশীর পরেই তিনি। গ্রুপের শেষ ম্যাচে উগান্ডার বিরুদ্ধে ১৪টি চার এবং ৮টি ছক্কার সাহায্যে ১০৮ বলে ১৬২ রানের ইনিংস খেলেন। অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে ভারতের এখনও পর্যন্ত সর্বোচ্চ রান এটাই। ভেঙে দেন শিখর ধবনের ১৫৫ রানের রেকর্ড।
দিল্লির ১৭ বছরের অঙ্গকৃষ রঘুবংশী দলের কনিষ্ঠতম সদস্য ছিলেন। ভাই কৃষ্ণাঙ্গের ব্লাড ক্যান্সার ধরা পড়ে। বাবা অবনীশ গুরগাঁও ছেড়ে মুম্বইয়ে চলে আসেন। ভাই যখন হাসপাতালে ছিল, অঙ্গকৃষকেও মায়ের সঙ্গে সেখানেই থাকতে হয়। ভাইয়ের সেই লড়াই অঙ্গকৃষকেও মানসিক ভাবে শক্ত করে তোলে। তিনি এ বারের বিশ্বকাপে ভারতের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক। আর ভাই এখন সুস্থ হয়ে স্পেনে চুটিয়ে জুনিয়র টেনিস খেলছে।
দক্ষিণ আফ্রিকা, ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়ার মতো দলগুলিতে অনেক ক্রিকেটারের সঙ্গেই তাঁদের বাবা-মা এসেছেন। কোভিডের কারণে যশ, রবি, অঙ্গকৃষদের সেই সুযোগ হয়নি। হয়ত তার দরকার ছিল না। মা-বাবা, কোচেরা এঁদের তৈরি করেই পাঠিয়েছিলেন বিশ্বজয় করতে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy