গত আইপিএলে গুজরাত টাইটান্সের অধিনায়ক ছিলেন হার্দিক পাণ্ড্য। পাশে মুম্বই ইন্ডিয়ান্সের অধিনায়ক রোহিত শর্মা। —ফাইল চিত্র।
কিছু দিন আগেই হয়ে গিয়েছে আইপিএলের নিলাম। তার আগে শেষ হয়েছে এক দিনের বিশ্বকাপ। ভারতের ক্রিকেটপ্রেমীরা যখন এ সব নিয়ে মেতে, তখন আসল ‘খেলা’ দেখাচ্ছিল মুম্বই ইন্ডিয়ান্স। রোহিত শর্মাকে অধিনায়কত্ব থেকে সরিয়ে হার্দিক পাণ্ড্যকে কেনার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গিয়েছিল জুন থেকেই। নভেম্বরে তা প্রকাশ্যে আসে। ডিসেম্বর সরকারি ভাবে ঘোষণা হয়। তার মাঝে জল্পনা, অস্বীকার, হৃদয়ভঙ্গ, উত্তেজনা সবই রয়েছে। আইপিএলের এ রকমই বেশ কিছু অঙ্ক রয়েছে যা সাধারণ মানুষের বোঝার বাইরে। কী ভাবে কাজ করে আইপিএলের অঙ্ক?
বিশ্বকাপে ভারতকে এত ভাল নেতৃত্ব দেওয়া রোহিতকে কী ভাবে সরিয়ে দেওয়ার কথা ভাবল মুম্বই? কী ভাবেই বা গুজরাত টাইটান্স ভারতের ভবিষ্যৎ অধিনায়ক এবং দলের সম্পদ হার্দিককে বিক্রি করে দিল? রোহিত-মুম্বই এবং হার্দিক-গুজরাত প্রেমের সম্পর্ক আরও দীর্ঘায়িত হল না কেন?
আসলে আইপিএলের ব্যবসা এবং নিলামের সমীকরণটাই এ রকম। ফ্র্যাঞ্চাইজ়ি ক্রিকেটে ব্যালান্স শিট এবং স্কোরশিটের গুরুত্ব সমান। এখানে অন্য ‘নিয়ম’ চলে। নিলাম এবং ‘রিটেনশন’-এর মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ ক্রিকেটীয় সিদ্ধান্ত হয়। আর ব্যালান্স শিট ঠিক রাখতে বরখাস্ত করা এবং নতুন কাউকে সই করানো হয়। ক্রিকেটপ্রেমীরা তো বটেই, ক্রিকেটারেরাও অনেক সময় দুটোকে গুলিয়ে ফেলেন। গুলিয়ে ফেলা আকস্মিক নয়। বরং এর নেপথ্যে যে সব মাথা কাজ করে, তাদের ভাবনাচিন্তার স্তরে পৌঁছনোটাই অনেক বড় ব্যাপার।
কেন হার্দিককে কিনল মুম্বই?
আইপিএলের ‘রিটেনশন নিয়ম’ এর নেপথ্যে রয়েছে। ২০২৪-এ শেষ বার মিনি নিলাম। ২০২৫-এ রয়েছে মেগা নিলাম, যেখানে প্রতিটি দল চার জনের বেশি ক্রিকেটার ধরে রাখতে পারবে না। ২০২০ সালে আইপিএল জেতার পর মুম্বইয়ের ফর্ম পড়তির দিকে। পরের তিনটি আইপিএলে তারা পঞ্চম, দশম এবং চতুর্থ স্থানে শেষ করে। ২০২৫-এর পর আরও তিন বছর অধিনায়ক হিসেবে রোহিতকে রেখে দেওয়া বেশ কষ্টকর। মুম্বইকে তাই একটা সিদ্ধান্ত নিতেই হত।
টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটার হিসেবে রোহিত শেষ হয়ে যাননি ঠিকই। তাঁর ব্যাটিং এবং বুদ্ধি এখনও দলের কাছে সম্পদ। কিন্তু দায়িত্ব অন্যের হাতে তুলে দেওয়ার আগে ‘ব্যাটন’ বদল গুরুত্বপূর্ণ। রোহিতকে এখন সেই কাজেই ব্যবহার করতে চায় মুম্বই। সেই দলের মাথারা একদম কর্পোরেট গোছের ভাবনাচিন্তায় অভ্যস্ত। মুম্বইয়ের সঙ্গে হার্দিকের যোগাযোগ আচমকা নয়। ৩০ বছর বয়সি হার্দিক ক্রিকেটীয় দক্ষতা এবং বুদ্ধির শীর্ষে রয়েছেন। এ বছর তাঁকে সই করিয়ে মেগা নিলামের আগে ধরে রাখলে, হার্দিকের সেরা সময়ে তাঁকে পাবে মুম্বই। রোহিতের ক্ষেত্রেও তাই করা হয়েছিল। তাঁকে নেওয়া হয়েছিল ২৪ বছরে। অধিনায়ক করা হয় ২৬-এ। তার পরে পাঁচটি আইপিএল মুম্বইকে দিয়েছেন রোহিত।
কিন্তু হার্দিককে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় নেওয়ার আগে তাঁর চোটের ব্যাপারে ভাবল না মুম্বই?
এখানেও বুদ্ধির খেলা। ক্রিকেটারদের ফিট করতে মুম্বইয়ের জুড়ি নেই। অতীতে যশপ্রীত বুমরার ক্ষেত্রে তা দেখা গিয়েছে। তবে গোটা বিষয়টি যে সময়ে হয়েছে, তাকে ভাগ্যের পরিহাস বলা ছাড়া উপায় নেই। হার্দিকের ‘ঘরে ফেরা’ নিয়ে যখন তুমুল জল্পনা চলছে, তখন ভারতীয় দল বিশ্বকাপের মধ্যগগনে। হার্দিক তখন দল থেকে ছিটকে গিয়েছেন এবং রোহিত নিঃস্বার্থ ভাবে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। মুম্বইয়ের সিদ্ধান্তে রোহিত যে হতাশ হয়েছেন তা ইতিমধ্যেই জানা গিয়েছে। তার থেকেও বেশি হতাশ সূর্যকুমার যাদব এবং যশপ্রীত বুমরা। রোহিতের উত্তরসূরি হিসেবে এই দু’জনই ছিলেন দাবিদার। দু’জনেই জাতীয় দলকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তাই প্রত্যাশা থাকা স্বাভাবিক।
সূর্য বা বুমরা কি অন্য দলে যেতে পারেন না?
রোহিতকে নিয়ে জল্পনা চলার সময় দিল্লি ক্যাপিটালস তাঁকে নেওয়ার মরিয়া চেষ্টা করেছিল। রোহিত তাতে পাত্তাই দেননি। কিন্তু সূর্য বা বুমরার জন্য কোনও দলের তরফে এমন প্রস্তাবের খবর এখনও প্রকাশ্যে আসেনি। দলগুলির ধারণা, এই দুই ক্রিকেটারকে কোনও ভাবেই মুম্বই ছাড়বে না।
কেন মুম্বইয়ে খেলার জন্য ক্রিকেটারদের এত ইচ্ছা রয়েছে?
আসলে, আইপিএলে শুধু সাফল্য নয়, পরিচালনার ব্যাপারেও অন্যতম সেরা দল মুম্বই। ক্রিকেটার তুলে আনার ব্যাপারে তাদের জুড়ি নেই। পেশাদারিত্বও দেখার মতো। মুম্বইয়ের হয়ে খেলে জাতীয় দলের দরজা খুলে গিয়েছে অনেক ক্রিকেটারের। সূর্য, বুমরা, খোদ হার্দিকই তার উদাহরণ। ক্রিকেটারদের দেখাশোনার ক্ষেত্রেও মুম্বই অনুকরণযোগ্য। উন্নত পরিকাঠামো পাওয়া যায় সারা বছর। কোভিডের সময়ে তারাই প্রথম ক্রিকেটারদের সঙ্গে তাঁদের পরিবারকে রেখেছিল। অনেকেই বলেন, মুম্বই থেকে অন্য দলে যেতে পারেন। কিন্তু মুম্বই ছাড়তে পারবেন না।
গুজরাত কেন হার্দিককে বিক্রি করে দিল?
মুম্বইয়ের থেকে আমদাবাদের ফ্র্যাঞ্চাইজ়ি অনেক আলাদা। তাদের মালিক সিভিসি ক্যাপিটাল হল একটি বিনিয়োগকারী ফার্ম, যেখানে ৪০টি সংস্থা পরিচালনা করে। সেখানে মুম্বইয়ের মালিক এক ব্যবসায়ী পরিবার। সিভিসি-র ওয়েবসাইটে গুজরাতের পারফরম্যান্স অন্যতম সেরা সাফল্য হিসেবে বর্ণিত রয়েছে। হার্দিককে বিক্রি করে গুজরাত ১৫ কোটি টাকা তো পেয়েছেই। পাশাপাশি বিরাট অঙ্কের ট্রান্সফার ফি পেয়েছে, যা এখনও প্রকাশ্যে আসেনি। অনেকেই বলছেন, ১০০ কোটি টাকা ট্রান্সফার ফি পেয়েছে গুজরাত।
কেনাবেচা নিয়ে যাদের কারবার, সেই সিভিসি ক্যাপিটালের কাছে হার্দিকের পরিবর্তে এত টাকা পাওয়া আইপিএল জেতার মতোই ব্যাপার। আগামী বছরে কোনও দিন তারা দল বিক্রি করতে চাইলে এই ট্রেডিংকে সাফল্য হিসেবে দেখাতে পারবে। তা ছাড়া, নতুন অধিনায়ক শুভমন গিলও এখন আমদাবাদের সম্পদ। আগামী দিনে শুভমনকে নিয়েও এমন ট্রান্সফার ফি পেলে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
বিশ্বের বিভিন্ন নামী ফুটবল ক্লাবেরা এ ভাবেই অর্থ রোজগার করে থাকে। গত দশকে পর্তুগালের বেনফিকা এবং স্পেনের আতলেতিকো মাদ্রিদ ফুটবলার বেচে ৮,২৭৩ কোটি টাকা কামিয়েছে। আইপিএলে হয়তো সেই দৃষ্টান্ত তৈরি করছে গুজরাতও। তবে পরিকল্পনা এ ক্ষেত্রে অনেকটাই আলাদা।
ধোনিকে অধিনায়ক রেখে কি ঠিক করছে চেন্নাই?
মুম্বইয়ে এত বছরে একাধিক অধিনায়ক দেখা গিয়েছে। কিন্তু চেন্নাই ভরসা রেখেছে ধোনিতেই। আসলে, চেন্নাইয়ের অন্যতম মালিক এন শ্রীনিবাসনের কাছে ব্যবসার চেয়ে খেলার প্রতি ভালবাসাই বরাবর এগিয়ে থাকে। তিনি চেন্নাইয়ের স্থানীয় লিগে অনেক দল চালান। তাই জানেন, ক্রিকেটকে ভালবাসা বা দল চালানোর ক্ষেত্রে মাঝেমাঝেই সমাজসেবীর ভূমিকা নিতে হয়, যেখানে বিনিয়োগ এবং বার্ষিক লাভের থেকে বড় হয়ে দাঁড়ায় খেলাটাই।
রবীন্দ্র জাডেজাকে অধিনায়ক করে ধোনির উত্তরসূরি পাওয়ার একটা চেষ্টা করেছিল চেন্নাই। সফল হয়নি। ধোনির উত্তরসূরি কে হবেন, তা হয়তো ধোনিই ঠিক করবেন। কারণ ৪২ বছরে সব অধিনায়ক দলকে আইপিএল জেতাতে পারেন না। মুম্বই রোহিতকে সরিয়ে, গুজরাত হার্দিককে বিক্রি করেছে, কিন্তু চেন্নাই ভরসা রেখেছে ধোনিতেই। এমনি এমনি তো তিনি ‘থালা’ নন।
তাই, আইপিএলের ‘খেলা’ দেখলে বলতে বাধ্য হতে হয়, ‘বাবা অঙ্ক কী কঠিন।’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy