রবিবার ইডেনে মুখোমুখি হবেন রোহিত শর্মা এবং টেম্বা বাভুমা। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
এই বছর জুন মাসে ফরাসি ওপেনের সেমিফাইনালে মুখোমুখি হয়েছিলেন নোভাক জোকোভিচ এবং কার্লোস আলকারাজ়। সেই সময় আলকারাজ় ছিলেন বিশ্বের এক নম্বর। জোকোভিচ ক্রমতালিকায় সেই সময় তিন নম্বরে। তরুণ আলকারাজ় এবং অভিজ্ঞ জোকোভিচের সেই লড়াইকে অনেকেই ফরাসি ওপেনের ‘ফাইনাল’ বলেছিলেন। দুই খেলোয়াড় যে ফর্মে ছিলেন তাতে ওই ম্যাচই কার্যত ফাইনালের চেহারা নিয়েছিল। এই রবিবার ক্রীড়াবিশ্ব আবার তেমনই একটি মুহূর্তের সামনে দাঁড়িয়ে। খেলাটা এ বার ক্রিকেট। মঞ্চটা বিশ্বকাপ। আর দল দু’টি? ভারত এবং দক্ষিণ আফ্রিকা। দু’টি দল যে ফর্মে আছে, তাতে এই ম্যাচকেই সবাই বিশ্বকাপের ফাইনাল বলছেন।
ইডেনে রবিবার ভারত এবং দক্ষিণ আফ্রিকা ম্যাচ নিয়ে আগ্রহ তুঙ্গে। টিকিটের কালোবাজারি সেটা পরিষ্কার করে দিয়েছে। টিকিটের দাম চড়চড় করে বাড়ছে। কলকাতা পুলিশ ইতিমধ্যেই একাধিক জনকে গ্রেফতার করেছে। যাঁরা টিকিট পাননি, তাঁরা হাহাকার করছেন। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চেষ্টা করে চলেছেন কোনও ভাবে একটি টিকিট পাওয়ার। কিন্তু কেন এই ম্যাচ ঘিরে এত প্রত্যাশা? কারণ এটাই কার্যত বিশ্বকাপের ফাইনাল।
এ বারের বিশ্বকাপে ভারত এখনও পর্যন্ত কোনও ম্যাচে হারেনি। যে ফর্মে তারা রয়েছে, তাতে এক নম্বরে থেকে যেতে পারেন রোহিত শর্মারা। যদি ভারত দু’নম্বরে নেমে যায়, তা হলে এক নম্বর জায়গাটা দখল করার সুযোগ সব থেকে বেশি দক্ষিণ আফ্রিকার। অর্থাৎ এক বনাম চার এবং দুই বনাম তিন নম্বর দলের সেমিফাইনালের নিয়মে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে ভারত খেলতে পারে আবার ফাইনালেই। তার আগে রবিবারের ম্যাচেই হয়ে যাবে ‘স্টেজ রিহার্সাল’।
এ বারের বিশ্বকাপে ভারতকে প্রথম থেকেই ফাইনালে ওঠার দাবিদার বলা হচ্ছিল। অস্ট্রেলিয়াকে চেন্নাইয়ের মাঠে ৬ উইকেটে হারিয়ে শুরু করে সেই দাবি আরও জোরালো করে দিয়েছিলেন রোহিতেরা। ভারতীয় বোলিংয়ের সামনে ১৯৯ রানে শেষ হয়ে গিয়েছিল স্টিভ স্মিথ, মার্নাস লাবুশেন সমৃদ্ধ অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটিং। সেই ম্যাচে ৮৫ রান করেন বিরাট কোহলি। ৯৭ রানে অপরাজিত ছিলেন লোকেশ রাহুল। জয়ের সেই শুরু। যত ম্যাচ গড়িয়েছে, ভারতকে তত ভয়ঙ্কর দেখিয়েছে।
দিল্লিতে আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে ভারত জিতেছিল ৮ উইকেটে। রোহিত ১৩১ রানের ইনিংস খেলেন। তাঁর সেই বিধ্বংসী ইনিংস ভারতের আত্মবিশ্বাস তুঙ্গে তুলে দেয়। পরের ম্যাচই ছিল পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। যে ম্যাচ ঘিরে বিশ্বকাপ শুরুর আগে থেকে আগ্রহ ছিল। ভারত সেই ম্যাচে পাকিস্তানকে যে উড়িয়ে দেবে তা ভাবাই যায়নি। কিন্তু পাকিস্তানের ইনিংস শেষ হয়ে যায় মাত্র ১৯১ রানে। ভারতীয় বোলারেরা পাকিস্তানের ইনিংস শেষ করে দেন ৪২.৫ ওভারে। দলগত পারফরম্যান্সের নিদর্শন ছিল সেই ম্যাচ। এর পর বাংলাদেশ (৭ উইকেটে জয়), নিউ জ়িল্যান্ড (৪ উইকেটে জয়), ইংল্যান্ড (১০০ রানে জয়) এবং শ্রীলঙ্কাও (৩০২ রানে জয়) ভারতের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারেনি। এমনকি বিশ্বকাপের মাঝে হার্দিক পাণ্ড্য চোট পাওয়ার পরেও দলের কোনও বড় ক্ষতি হয়নি। কোনও এক জনের উপর নির্ভরশীল নয় এই ভারত। সব ব্যাটার রানের মধ্যে রয়েছেন, পেস এবং স্পিন বিভাগ সমান ভাবে সফল। ভারতকে কি আদৌ হারানো সম্ভব?
পারলেও পারতে পারে একমাত্র দক্ষিণ আফ্রিকা। কিন্তু যে দল নেদারল্যান্ডসের মতো দলের বিরুদ্ধে হেরে গিয়েছে, তারা কি ভারতের বিরুদ্ধে পারবে? পাল্টা প্রশ্ন আসতে পারে, যে দল এ বারের বিশ্বকাপে সাতটি ম্যাচের মধ্যে চার বার ৩৫০ রানের গণ্ডি পার করে, তার মধ্যে এক বার ৪২৮ রান করে, তারা তো যে কোনও দলকে হারানোর ক্ষমতা রাখে। নেদারল্যান্ডসের বিরুদ্ধে দক্ষিণ আফ্রিকার হার নেহাতই অঘটন। বাকি দলগুলির বিরুদ্ধে দক্ষিণ আফ্রিকার দাপট রোহিতদের চাপ তৈরি করার মতোই।
এ বারের বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম ম্যাচ ছিল শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে। সেই ম্যাচেই ৪২৮ রান তুলেছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। একই ম্যাচে শতরান করেছিলেন কুইন্টন ডি’কক, রসি ভান ডের ডুসেন এবং এডেন মার্করাম। পরের ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ৩১১ রান করে দক্ষিণ আফ্রিকা। অস্ট্রেলিয়া শেষ হয়ে যায় ১৭৭ রানে। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে দক্ষিণ আফ্রিকা তোলে ৩৯৯ রান। সেই ম্যাচটি প্রোটিয়াবাহিনী জেতে ২২৯ রানে। বাংলাদেশ (১৪৯ রানে জয়), পাকিস্তান (১ উইকেটে জয়) এবং নিউ জ়িল্যান্ডও (১৯০ রানে জয়) দাঁড়াতে পারেনি দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে।
ভারত এবং দক্ষিণ আফ্রিকার এই লড়াই এখন আর শুধু দু’টি দলের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। পৌঁছে গিয়েছে ব্যক্তিগত স্তরেও। এ বারের বিশ্বকাপে সব থেকে বেশি রানের তালিকায় এখন শীর্ষে ডি’কক। সাত ম্যাচে ৫৪৫ রান করেছেন। চারটি শতরান করে ফেলেছেন এ বারের প্রতিযোগিতায়। তাঁকে তাড়া করছেন বিরাট কোহলি। সাত ম্যাচে তিনি করেছেন ৪৪২ রান। বিরাটের শতরানের সংখ্যা একটি হলেও অর্ধশতরান চারটি। গড় ৮৮.৪০। তাঁর মতো ধারাবাহিক ব্যাটার এ বারের বিশ্বকাপে আর দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। রানের বিচারে খুব একটা পিছনে নেই ভারতের রোহিত (৪০২) এবং দক্ষিণ আফ্রিকার মার্করামও (৩৬২)।
ব্যাটিংয়ের মতো ব্যক্তিগত লড়াই দেখা যাচ্ছে বোলিংয়েও। দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে সব থেকে বেশি উইকেট নিয়েছেন মার্কো জানসেন। সাত ম্যাচে তিনি নিয়েছেন ১৬টি উইকেট। তাঁর থেকে এক উইকেট কম যশপ্রীত বুমরার। ভারতের অন্য পেসার মহম্মদ শামি নিয়েছেন ১৪টি উইকেট। দক্ষিণ আফ্রিকার পেসার জেরাল্ড কোয়েটজ়িও নিয়েছেন ১৪টি উইকেট। পিছিয়ে নেই কাগিসো রাবাডা (১১) এবং কুলদীপ যাদবও (১০)।
দলগত হোক বা ব্যক্তিগত, এক ইঞ্চিও জমি ছাড়ছে না কেউ। ভারত-দক্ষিণ আফ্রিকা লড়াইয়ের মাত্রা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে পয়েন্ট তালিকায় দুই দল এক এবং দুই নম্বর স্থানে থাকায়। ভারত সাতটি ম্যাচের সাতটিতেই জিতে ১৪ পয়েন্ট পেয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকা একটি ম্যাচ হারায় পেয়েছে ১২ পয়েন্ট। কিন্তু নেট রানরেটে তারা ভারতের থেকে এগিয়ে। ফলে ইডেনে যদি ভারতকে হারিয়ে দিতে পারেন ডি’ককেরা, তা হলে এক নম্বর হয়ে সেমিফাইনালে যাওয়ার সুযোগ পাবেন তাঁরা। অন্য দিকে, ভারত জিতলে এক নম্বর জায়গাটা কার্যত পাকা করে ফেলবে। কারণ রোহিতদের শেষ ম্যাচ দুর্বল নেদারল্যান্ডসের বিরুদ্ধে। দক্ষিণ আফ্রিকাকে সেখানে খেলতে হবে আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে। যারা এ বারের বিশ্বকাপে বেশ কিছু ম্যাচে বড় দলকে বেগ দিয়েছে।
বিশ্বকাপের ফাইনাল ১৯ নভেম্বর। আমদাবাদে হবে সেই ম্যাচ। কিন্তু ইডেন হয়তো তার আগেই ‘ফাইনাল’টা দেখে ফেলবে। এ বারের বিশ্বকাপের সেরা দুই দল মুখোমুখি হতে চলেছে রবিবার। কে বলতে পারে, ফাইনালটাও হয়তো এই দুই দলই খেলবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy