‘দ্য টেলিগ্রাফ’ আয়োজিত ‘টাইগার পটৌডী মেমোরিয়াল লেকচার’ অনুষ্ঠানে কলকাতায় ব্রায়ান চার্লস লারা। —নিজস্ব চিত্র।
একাদশতম ‘টাইগার পটৌডী মেমোরিয়াল লেকচার’-এর মঞ্চে রোহিত শর্মাদের দলকে ক্লাইভ লয়েডদের ওয়েস্ট ইন্ডিজ়ের সঙ্গে তুলনা করলেন ব্রায়ান চার্লস লারা। একই সঙ্গে জানিয়ে দিলেন, লর্ডস নয়, ইডেনই এখন ‘ক্রিকেটের পীঠস্থান’।
প্রতি বছরের মতো এ বারও ‘দ্য টেলিগ্রাফ’ আয়োজিত ‘টাইগার পটৌডী মেমোরিয়াল লেকচার’ অনুষ্ঠিত হল কলকাতায়। অনুষ্ঠানের প্রধান বক্তা ছিলেন লারা। পটৌডীর স্ত্রী শর্মিলা ঠাকুর বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠানে আসতে পারেননি। লারা দ্বিতীয় ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটার যিনি এই অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখলেন। ২০২১ সালে ক্লাইভ লয়েড এসেছিলেন। লারা জানিয়েছেন কলকাতায় এই অনুষ্ঠানে আসার আগে তিনি লয়েডের সঙ্গে কথা বলেন। সেই লয়েডের দলের সঙ্গেই রোহিতদের তুলনা করলেন ‘প্রিন্স অফ পোর্ট অফ স্পেন’। লারা বলেন, “এ বারের বিশ্বকাপে খেলা ভারতীয় দল আমাকে ৭০-এর দশকের ক্যারিবিয়ান দলের কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। যে দেশেই ৭০-এর দল খেলতে যেত, সেখানে ভালবাসা পেত। সব দেশের সমর্থকেরাই তাঁদের নিজেদের দেশকে সমর্থন করত। কিন্তু পছন্দের তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে থাকত ওয়েস্ট ইন্ডিজ়। ভারতীয় দলও এখন সেরকম। আমাদের দেশ এ বারে বিশ্বকাপ খেলার যোগ্যতা অর্জন করেনি। কিন্তু আমি জানি ফাইনালের দিন আমাদের দেশের মানুষ বসেছিলেন ভারতের জয় দেখবার জন্য। শেষ পর্যন্ত যদিও আশানুরূপ ফল হয়নি।”
কলকাতার ইডেনে লারা কখনও টেস্ট ক্রিকেট খেলেননি। কিন্তু এই শহরের ক্রিকেটপ্রেম ছুঁয়ে গিয়েছে তাঁকে। লারা বলেন, “কলকাতায় এসে ভাল লাগছে। এখানে কাটানো প্রতিটা মুহূর্ত উপভোগ করি। আমার মতে লর্ডস এখন আর ক্রিকেটের পীঠস্থান নয়। সেটা ইডেন গার্ডেন্স, সেটা কলকাতা।”
‘টাইগার পটৌডী মেমোরিয়াল লেকচার’ প্রথম বার আয়োজিত হয়েছিল ২০১২ সালে। সে বার প্রধান বক্তা ছিলেন ইমরান খান। এর পর একে একে গ্রেগ চ্যাপেল (২০১৩), সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় (২০১৪), কপিল দেব (২০১৫), মাইক ব্রিয়ারলি (২০১৬), বীষেণ সিংহ বেদী (২০১৭), কোর্টনি ওয়ালস (২০১৮), ডেভিড গাওয়ার (২০১৯), মহম্মদ আজহারউদ্দিনের (২০২০) মতো ব্যক্তিত্বেরা এসেছিলেন। ২০২১ সালে এসেছিলেন লয়েড। এই তালিকায় তাঁর নাম যোগ হওয়ায় সম্মানিত লারা। তিনি মজা করে বলেন, “আমার এখন গলফ খেলা ছাড়া কোনও কাজ নেই। তাই কলকাতায় এসে এই অনুষ্ঠানে যোগ দিতে হবে শুনে আমি ‘হ্যাঁ’ বলে দিয়েছিলাম। কিন্তু এখানে এসে আমার আগে বক্তব্য রেখে যাওয়া ব্যক্তিত্বদের নাম শুনে আমি সম্মানিত। সেই সঙ্গে চিন্তাও হচ্ছে, মনে হচ্ছে পালিয়ে যাই।”
ব্যাট হাতে যিনি এক সময় বিশ্ব শাসন করেছেন, তিনি যে পালিয়ে যাওয়ার লোক নন তা সহজেই বোঝা যায়। লারা তাঁর ৩৮ মিনিটের বক্তব্যে ভারতীয় ক্রিকেটকে প্রশংসায় ভরিয়ে দিলেন। তাঁর মতে ভারতীয় ক্রিকেট এবং ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটের মধ্যে মিল রয়েছে। লারা বলেন, “ভারত স্বাধীন হয় ১৯৪৭ সালে। ক্যারিবিয়ান দ্বীপগুলি তার পরে একে একে স্বাধীনতা পায়। ইংরেজদের শাসন থেকে মুক্তি পাওয়ার পর ক্রিকেটই হয়ে উঠেছিল জবাব দেওয়ার অস্ত্র। ইংরেজদের শিখিয়ে যাওয়া ক্রিকেট যে আমরাও খেলতে পারি সেটা দেখিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন ছিল। পরবর্তী সময় শুধু খেলা নয়, আমরা হারিয়েছি ওদের।”
ভারতীয় ক্রিকেটের কথা বলতে গিয়ে লারা বেছে নেন পাঁচ জন ক্রিকেটারকে। তাঁর মতে ভারতীয় ক্রিকেটের সর্বকালের সেরা পাঁচ হলেন নবাব মনসুর আলি খান পটৌডী, সুনীল গাওস্কর, কপিল দেব, সচিন তেন্ডুলকর এবং বিরাট কোহলি। এঁদের প্রত্যেকের সম্পর্কে নানা ধরনের তথ্য তুলে ধরেছেন লারা।
বিরাটের কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, “আমার ছেলে যদি কোনও খেলার সঙ্গে যুক্ত হয়, আমি বলব বিরাটের থেকে অনুপ্রেরণা নাও। খেলার প্রতি যে দায়বদ্ধতা বিরাট দেখায় সেটা অভাবনীয়। বিরাট সব সময় সেরা হতে চায়।” লারা মনে করিয়ে দেন বিরাটের কাছে অনুপ্রেরণা ছিলেন সচিন। ভারতীয় ক্রিকেটের অন্যতম সেরা ব্যাটার প্রসঙ্গে লারা বলেন, “মাত্র ১৬ বছর বয়সে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে খেলতে নেমে নাকে বল লেগে রক্ত বার হলে অনেকেই ক্রিকেট খেলা ছেড়ে দিত। কিন্তু সচিন তার পরেও খেলা চালিয়ে যায় এবং সেই টেস্ট বাঁচায়। আমার ক্রিকেট জীবন ছিল যেন সচিনকে তাড়া করা।” টেস্টে এক ইনিংসে ৪০০ রানের মালিক মজা করে বলেন, “সচিন আমার আগে আগে চলত, আমি ওর পিছু পিছু। তবে সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডে আমাদের দু’জনের নামে একটা দরজা আছে। সেখানে আমার নাম আগে লেখা হয়েছে।”
পটৌডীকে সম্মান জানানোর মঞ্চে লারা তাঁর সম্পর্কে বলেন, “আমি পটৌডী সম্পর্কে খুব বেশি জানি না। শুনেছি তিনি ছিলেন নবাব, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক, ভারতের ক্রিকেট অধিনায়ক। এক দুর্ঘটনায় তাঁর চোখ নষ্ট হয়ে যায়। আমি অবাক হয়ে ভাবি যদি উনি সব ইন্দ্রিয়ের সাহায্য পেতেন তাহলে আরও কী কী করতে পারতেন।”
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ২২,৩৫৮ রানের মালিক লারা। ক্রিকেট বিশ্বে সেরা বাঁহাতি ব্যাটারদের তালিকায় উপরের দিকেই থাকবেন। অনুষ্ঠানে লারাকে নিয়ে দেখানো তথ্যচিত্রে বলা হয়, “১০০ করলে ২০০ করার কথা ভাবতেন। ২০০ করলে ভাবতেন ৩০০ করবেন। ৩০০ করলে ভাবতেন ৪০০ করবেন।” সত্যি লারা এমনটাই ছিলেন। জীবনের প্রথম টেস্ট শতরান করেছিলেন অস্ট্রেলিয়ায়। ২৭৭ রানের ইনিংস ছিল সেটি। সেই ইনিংসের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে এক মজার কাহিনি। লারা বলেন, “টেস্টের দ্বিতীয় দিনের শেষে অস্ট্রেলিয়া বিরাট রানে এগিয়ে গিয়েছিল। সে দিন রাতে আমার রুমমেট ডেসমন্ড হেনস নৈশভোজের আমন্ত্রণ করে। হেনস সহজে কাউকে খাওয়াত না। আমি অবাক হয়ে যাই। পরে জানতে পারি অস্ট্রেলিয়ার এক পরিবার আমাদের নৈশভোজে ডেকেছে। সেখানে আমি ক্রিসপি ডাক খেতে চেয়েছিলাম। হেনস কিছুতেই আমাকে খেতে দেবে না। ও বলে পরের দিন আমাকে ব্যাট করতে হবে। তার আগে হাঁস খাওয়া চলবে না। (ক্রিকেটে শূন্য রানে আউট হওয়াকে ডাক বলা হয়।) কিন্তু আমার ইচ্ছা হাঁসের মাংস খাওয়ার। শেষ পর্যন্ত আমি ক্রিসপি ডাক খাই। হেনস আমার দিকে পিছন করে নৈশভোজ করেছিল। পরের দিন যখন ২২ রান করে হেনস আউট হয়ে ফিরছে, তখন আমি মাঠে ঢুকছি ব্যাট করতে। হেনস আমায় বলে, “আগের রাতে হাঁস খাওয়ার জন্য শুভেচ্ছা।” সেই ইনিংসে আমি ২৭৭ রান করি।”
ক্রিকেট লারাকে অনেক কিছু দিয়েছে। তাঁর ১৭ বছরের আন্তর্জাতিক কেরিয়ারে টেস্টে ৩৪টি এবং এক দিনের ক্রিকেটে ১৯টি শতরান করেছেন। কিন্তু লারার একটি বিষয়ে আফসোস থেকে গিয়েছে। লারা বলেন, “আমার কেরিয়ারে যদি একটি জিনিস বদলাতে পারতাম, তাহলে আমি চাইতাম আমার বাবা ওয়েস্ট ইন্ডিজ়ের হয়ে আমাকে টেস্ট খেলতে দেখে যাক। আমার প্রথম টেস্ট খেলার আগেই বাবা মারা যান। এই আফসোস আমার সারা জীবন থাকবে। আমাকে ক্রিকেটার তৈরি করার পিছনে বাবার অবদান অনেক। কিন্তু বাবা আমাকে টেস্ট খেলতে দেখে যেতে পারল না।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy