ছেলের সঙ্গে অসি ক্রিকেটার সারা এলিয়ট। ছবি: টুইটার।
একটা সময় খেলার মাঝে বিশ্রাম নেওয়ার জো ছিল না সারা এলিয়টের। সতীর্থরা যখন বিশ্রাম নিতেন, তখনও ব্যস্ত থাকতে হত তাঁকে। কখনও কখনও প্যাড খোলার ফুরসতটুকুও পেতেন না। সারা যে সময়ের কথা বলেছেন, সে সময় অস্ট্রেলিয়ার মহিলা ক্রিকেট দলের ব্যাটারকে মাঠে লড়াই করতে হত প্রতিপক্ষের বোলারদের বিরুদ্ধে, আর মাঠের বাইরে সময়ের সঙ্গে। ঠিক লড়াই নয়। জীবনের সঙ্গে খেলার ভারসাম্য রক্ষা করে চলতে হত তাঁকে। ক্রিকেটার হিসাবে দায়িত্ব পালনের সঙ্গেই সমান তালে পালন করে গিয়েছেন মাতৃত্বের দায়িত্ব।
সন্তানের জন্য যেমন ক্রিকেটকে অবহেলা করেননি, তেমনই ক্রিকেটের জন্য সন্তানকেও অবহেলা করেননি। সারা অন্তঃসত্ত্বা অবস্থার প্রথম দিকেই ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার কাছ থেকে চুক্তির প্রস্তাব পেয়েছিলেন। প্রথমে সন্তানের কথা ভেবে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। কিন্তু ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মত বদল করে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার চুক্তির প্রস্তাবে সম্মতি জানিয়েছিলেন। নির্বাচক জুলি স্যাভেজকে ফোন করে জানান, চুক্তিতে সই করবেন। সে জন্য তাঁর মাতৃত্বকালীন সুবিধা পেতে সমস্যা হয়নি। পুত্র সন্তানের জন্ম দেওয়ার পর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফিরে শতরানও করেছিলেন অসি অলরাউন্ডার। সেই শতরানের দিনও সারার সঙ্গে ছিল কয়েক মাসের ছেলে সাম। খেলার ফাঁকে ফাঁকে যখনই সুযোগ পেয়েছিলেন, তখনই পুত্রকে স্তন্যপান করিয়েছিলেন।
২০১২ সালের অক্টোবরে জন্ম হয় সামের। ছেলের যখন ন’মাস বয়স, তখন মহিলাদের অ্যাশেজ সিরিজ়ে মুখোমুখি হয়েছিল অস্ট্রেলিয়া এবং ইংল্যান্ড। ২০১১ সালে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে টেস্ট অভিষেকে ৮১ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলেছিলেন সারা। তাই তাঁর উপর অনেকটা ভরসা ছিল অস্ট্রেলিয়ার। সেই অভিজ্ঞতা ক্রিকেটপ্রেমীদের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে ভাগ করে নিয়েছেন অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটিং অলরাউন্ডার। সারা বলেছেন, ‘‘অ্যাশেজের দলে থাকার জন্য ঘরোয়া মরসুমের অন্তত অর্ধেক খেলতে হবে জানতাম। তাই সামের জন্মের দু’সপ্তাহ পর থেকেই জিমে যেতে শুরু করেছিলাম। ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া সে সময় আমাকে ছ’সপ্তাহ প্রতিযোগিতামূলক ক্রিকেট খেলার অনুমতি দেয়নি। হয়তো আরও তাড়াতাড়ি মাঠে ফিরতে পারতাম। তবে বিশ্রাম পাওয়ায় খুশি হয়েছিলাম। মা হওয়ার পর প্রথম ক্লাবের হয়ে খেলতে নেমেই বুঝেছিলাম, ক্রিকেট কত কঠিন খেলা।’’
সে সময় ভিক্টোরিয়ায় ক্লাব ক্রিকেট খেলতেন সারা। তা নিয়ে বলেছেন, ‘‘একটা ম্যাচ খেলার সময় সারা খুব কাঁদছিল। আমি ফিল্ডিং করছিলাম। তখন প্রতিপক্ষ দলের এক জন আমার হয়ে ফিল্ডিং করতে নেমেছিল। আমি গিয়ে ছেলেকে দুধ খাইয়েছিলাম।’’
ক্লাব ক্রিকেটে ভাল পারফরম্যান্সের সুবাদে জাতীয় দলে ফিরে এসেছিলেন সারা। সুযোগ পেয়েছিলেন অ্যাশেজ সিরিজ়ের দলে। সন্তানের যাতে সমস্যা না হয়, সে জন্য সব ব্যবস্থা করতে হয়েছিল। সারা বলেছেন, ‘‘দলের বাসে যাতায়াত করতে সামের অসুবিধা হচ্ছিল। তাই ওর জন্য একটা গাড়ি ভাড়া করেছিলাম। সেই সিদ্ধান্তটা আমার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আগে কখনও দলকে ছাড়া আলাদা গাড়িতে যাতায়াত করিনি। সেটাও একটা নতুন অভিজ্ঞতা হয়েছিল।’’ ও ভাবে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে টেস্ট খেলতে সমস্যা হয়নি? অসি মহিলা ক্রিকেটার বলেছেন, ‘‘খুব ক্লান্ত লাগত তখন। তবু প্রথমে ব্যাট করতে যেতে ভালই লেগেছিল। দু’ইনিংসে ব্যাট করতেও সমস্যা হয়নি। শুধু মাথায় রেখেছিলাম, বল দেখব আর সেই মতো শট খেলব। নিজের দুটো চরিত্রের মধ্যে ভারসাম্য রেখে চলার চেষ্টা করতে হয়েছিল। ম্যাচের ক’দিন একটা সুইচ জ্বালাতাম, আর একটা নিভিয়ে দিতাম। সাম কী করছে খেয়াল রাখতেই হত। জানতাম হয় নিজের খেয়ালে খেলা করবে, নয় তো কারও কোলে চড়ে ঘুরবে। তখন আমার বাবা-মাও সঙ্গে ছিলেন। ইনিংসের বিরতিতে প্যাড খোলার সময়ও পাইনি। ছেলের দেখাশোনায় ব্যস্ত হয়ে যেতে হত। সাজঘরে ফিরে ছেলেকে দুধ খাওয়াতাম। তার পর আবার ব্যাট করতে নামতাম।’’
টেস্টের প্রথম দিনের শেষে সারা ৯৫ রানে অপরাজিত ছিলেন ছেলের দেখাশোনা করেও। তা নিয়ে বলেছেন, ‘‘সেই রাতে শতরান নিয়ে আর ভাবিনি। তখন সামকে খাওয়ানো, ঘুম পাড়ানোর চাপ ছিল। সারা রাত ভাল করে ঘুমও হয়নি। খুব কঠিন রাত ছিল সেটা।’’
পরের দিন মাঠে নেমে অ্যাশেজ সিরিজ়ে প্রথম শতরান পূর্ণ করেছিলেন সারা। ক্যাথেরিন সিভার ব্রান্ট, অ্যানি শ্রাবসোল, জেনি গান, লরা মার্শদের মতো বোলারদের সামলে সেই শতরান অন্য রকম তৃপ্তি দিয়েছিল সারাকে। ৪১ বছরের অসি ক্রিকেটার বলেছেন, ‘‘বলব না, সেই ইনিংসটা খুব ভাল ছিল। দারুণ ব্যাট করেছিলাম। তবে ওই অবস্থায় পারফর্ম এবং রান করতে পেরে ভাল লেগেছিল।’’
সন্তানকে স্তন্যপান করিয়েও তাঁর শতরান করার কথা পরে দিন অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন সংবাদপত্র গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করেছিল। তা নিয়ে বিশেষ উচ্ছ্বসিত নন সারা। তিনি বলেছেন, ‘‘আমি আমার কাজ করেছিলাম। যা অর্জন করতে চেয়েছিলাম, শুধু সেটাই মাথায় রেখেছিলাম। কে কী বলছে, না বলছে সে নিয়ে ভাবিনি। প্রথম টেস্ট শতরান করাই ছিল আমার এক মাত্র লক্ষ্য। মা হওয়ার পরও যে টেস্ট শতরান করা যায়, সেটা প্রমাণ করতে চেয়েছিলাম।’’ তিনি আরও বলেছেন, ‘‘অনেক প্রতিকূলতার মধ্যে দলে সুযোগ পেয়েছিলাম। তাই প্রথম টেস্ট শতরানের ইনিংসটা খুব তৃপ্তি দিয়েছিল। ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে টেস্ট খেলার দুর্দান্ত অভিজ্ঞতা বলে বোঝাতে পারব না।’’
২০১৭ সালে বিগ ব্যাশ লিগ খেলে পেশাদার ক্রিকেট থেকে অবসর নেন সারা। ক্রিকেটার মাকে নিয়ে গর্বিত ছেলে সামও। সারা বলেছেন, ‘‘সাম ক্রিকেট পছন্দ করে। আরও বেশি পছন্দ করে আমার ব্যাগি গ্রিন টুপিটা। টুপিটা স্কুলে নিয়ে গিয়ে সবাইকে দেখিয়েছে। ও আমাকে নিয়ে ভীষণ গর্বিত।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy