পরীক্ষা: বল হাতে আগের সেই শিল্প ধরে রাখতে মরিয়া শামি। ফাইল চিত্র
গত কয়েক বছর ধরে তিনি বিশ্বের সব তাবড় ব্যাটসম্যানের মধ্যে থরহরিকম্প ঘটিয়েছেন। তাঁকে বলা হয় আধুনিক ক্রিকেটে সুইংয়ের সুলতান। ফাস্ট বোলিংয়ে তাঁর সিম ব্যবহার দেখে মুগ্ধ সুনীল গাওস্কর থেকে রিচার্ড হ্যাডলি। সেই তিনিও আর সকলের মতো করোনা ত্রাসের সময় গৃহবন্দি। বাড়িতে বসে কী ভাবে নিজেকে ফিট রাখছেন? বোলারের নৈপুণ্য ধরে রাখার কৌশল কী? মানবজাতির সামনে উপস্থিত হওয়া কঠিন এই সময় নিয়ে আনন্দবাজারের সঙ্গে একান্ত আলপচারিতায় মজলেন মহম্মদ শামি। উত্তর প্রদেশের বাড়ি থেকে ফোনে করোনা ও ক্রিকেট নিয়ে দিলেন নানা প্রশ্নের উত্তর...
প্রশ্ন: লকডাউনের মধ্যে কী ভাবে নিজেকে ফিট রাখছেন?
মহম্মদ শামি: ট্রেনিং করছি আগের মতোই। ফিট থাকার জন্য নিজস্ব জিমন্যাসিয়াম আগেই করেছিলাম। সেটা এখন খুবই কাজে দিচ্ছে। প্রায় দেড় ঘণ্টা ট্রেনিং করি বাড়িতে।
প্র: ক্রিকেটার হিসেবে আর কী কী অনুশীলন করা যেতে পারে ঘরে বসে?
শামি: ব্যাট নিয়ে নকিং করছি। আমি বাড়িতে ক্যাচ প্র্যাক্টিসও করছি।
প্র: কিন্তু বোলারের আসল যে অনুশীলন— মাঠে নেমে দৌড়ে এসে নেট প্র্যাক্টিসে বল করা, সেটা তো পুরোপুরি বন্ধ। এর কী প্রভাব পড়তে পারে এক জন বোলারের উপরে?
শামি: এই পরিস্থিতি সকলের জন্যই তো কঠিন। শুধু ক্রিকেটার বা বোলার বলে তো নয়, সকলেই খুব অসুবিধার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। তবে হ্যাঁ, ক্রিকেটীয় দিক থেকে যদি বলেন, এক জন বোলারের জন্য হয়তো আরওই কঠিন। বাড়িতে বসে তো আর ছুটে এসে বল করা যায় না। ক্রিকেটীয় নৈপুণ্যে ধার দেওয়া সম্ভব নয়। স্কিল ধরে রাখার বা বাড়ানোর যে দৈনন্দিন অভ্যেস, তা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তার প্রভাব দক্ষতায় পড়ার সম্ভাবনা থাকছেই। কিন্তু কিছু করারও তো নেই। পরিস্থিতিটাই এমন। সকলেরই তো কাজ বন্ধ। ঘরে থাকা ছাড়া উপায় নেই। যখন আবার সব ঠিক হবে, দেখতে হবে কী ভাবে সব কিছু ফেরত আনা যায়। এক জন পেশাদার খেলোয়াড় হিসেবে সেই চ্যালেঞ্জটা নিতেই হবে।
প্র: এই পরিস্থিতিতে এক জন বোলার কি বাড়ির মধ্যে থেকেও নিজের স্কিল ধরে রাখার চেষ্টা করতে পারেন?
শামি: খুব সহজ কাজ নয়। ব্যাটসম্যান তা-ও ব্যাট হাতে নকিং করতে পারে, শ্যাডো প্র্যাক্টিসের নানা ফর্মুলা আছে। সেগুলো করতে পারে। কিন্তু বোলারদের অনুশীলন মানেই তো বড় জায়গা লাগবে। ছুটে আসার জায়গা চাই। না হলে বোলিং অনুশীলন হবে কী করে? তবে আমি বলব, ক্রিকেটীয় উদাহরণ দিয়েই বোলাররা পরিস্থিতিটা ভাবতে পারে। বোলিংয়ে একটা কথা আছে। পরিবেশ বুঝে বোলিং করো। এখন গোটা পৃথিবী লকডাউনে। করোনাভাইরাস থেকে রক্ষা পেতে এটাই একমাত্র পথ। আমরা শিখছি, জীবনের পিচেও পরিবেশ অনুযায়ী বল করতে হয়। পাশাপাশি, মাথা থেকে কিছু না কিছু টোটকা বার করতে হবে নিজেদের স্কিল বাঁচিয়ে রাখার জন্য।
আরও পড়ুন: সৌরভের মতো ধোনিও সমর্থন করেছে: জাহির
প্র: আপনি কী কী করছেন ক্রিকেটীয় স্কিল বাঁচিয়ে রাখার জন্য?
শামি: বাড়িতেই বোলিং শ্যাডো করছি। আমি সিম ব্যবহার করে বোলিং করি। তাই যত পারছি আঙুলে সিম (বলের সেলাই) ধরে বল উপরে ছুড়ে লোফালুফি করছি। এর ফলে সিম সোজা রাখার অনুশীলনটা হয়। আমার জন্য এটা খুবই জরুরি একটা অনুশীলন। আগেও বাড়ি বসে, হোটেলের ঘরে আমি এটা করেছি। এখন যে-হেতু বাইরে অনুশীলনের উপায় নেই, আরও বেশি করে করছি। ভিজ্যুয়ালাইজেশন প্র্যাক্টিস করছি যে, অমুক ব্যাটসম্যানকে এই ভাবে আউট করছি। এটাই ওকে ফেরানোর নকশা। এতে মস্তিষ্ক কাজে লাগিয়ে বোলিংয়ের অভ্যেসটা বাড়বে।
প্র: করোনাভাইরাস যে-হেতু খুব ছোঁয়াচে এবং দ্রুত সংক্রমিত হয়, বল পালিশ করার প্রক্রিয়াতেও কি পরিবর্তন আসতে পারে? মানে এই যে ধরুন ক্রিকেটারেরা বলে থুতু লাগিয়ে চকচকে করেন, তাতে তো মুখের সঙ্গে বহু জনের ব্যবহৃত বলটির সংযোগের রাস্তা খোলা থাকছে। তাতে সংক্রমণের ভয় থাকতেই পারে। ধরুন, করোনার প্রকোপ কেটে গেল। তার পরেও কি সব কিছু স্বাভাবিক হবে? আগের মতো ক্রিকেটারেরা বল পালিশ করবে? আপনার কী মনে হয়?
শামি: এটা কিন্তু ভেবে দেখার মতোই বিষয়। আমার মনে হয়, করোনা অনেক কিছুকেই পাল্টে দিয়ে যাবে। যখন সব কিছু ঠিকঠাকও হয়ে যাবে, তখনও হয়তো আগের কোনও কোনও অভ্যেস আমরা চালিয়ে যেতে ভয় পাব। তাই হয়তো সেগুলো বাদই যাবে। যেমন আপনার এই প্রশ্ন নিয়ে আমার মনে হচ্ছে, করোনা ত্রাস থেমে গিয়ে যখনই খেলার মাঠে আমরা ফিরি না কেন, শুরুর দিকে বল পালিশ করার দৃশ্য হয়তো দেখা যাবে না। মনে হয়, বলে থুতু লাগানোর বিষয়টি বিপজ্জনক বলেই ধরা হবে, তাই কেউ করার ঝুঁকি নেবে না। বহু দিনের একটা অভ্যেস হয়তো আমাদের ছাড়তে হবে। যা কেউ আমরা কখনও আগে ভাবিনি।
আরও পড়ুন: ‘দলে আসুক ধোনি, ব্যাকআপ কিপার হিসাবে থাকুক রাহুল’
প্র: তা হলে বলের পালিশ রাখার নতুন কোনও উপায় বেরোবে?
শামি: এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে বলা কঠিন। বলে থুতু লাগাতে না-পারলে শুধু ঘাম দিয়েই হয়তো ঘষে যতটা সম্ভব পালিশ রাখার চেষ্টা করতে হবে। তার পর আস্তে আস্তে ভয় কেটে সব কিছু স্বাভাবিক হয়ে উঠলে তখন পুরনো অভ্যেসে হয়তো ফেরা যাবে।
প্র: নকিং করছেন বললেন। করোনা-পরবর্তী পর্বে কি ব্যাটসম্যান শামিকেও দেখতে পাব আমরা?
শামি: না, না (হাসি) সে রকম কিছু নয়। আসলে ক্রিকেট পাল্টে গিয়েছে। বোলারদেরও তো এখন ব্যাট করতে হয়। আমার ভালও লাগে ব্যাট করতে। তা ছাড়া বাড়িতে থেকেও ক্রিকেটের সঙ্গে যত রকম ভাবে যুক্ত থাকা যায়, তা করার চেষ্টা চালাচ্ছি। আমার ফার্ম হাউজে সম্পূর্ণ ক্রিকেট অনুশীলনের ব্যবস্থা আছে। পিচও আছে, সেখানে বোলিংও অনুশীলন করা যায়। কিন্তু লকডাউন হয়ে যাওয়ায় ফার্ম হাউজে যেতে পারিনি।
প্র: বাড়িতে বসে আরও অনেক কিছু করছেন। যেমন ছবি আঁকা।
শামি: বাড়িতে বাচ্চাদের সঙ্গে সময় কাটাচ্ছি। ওরা ছবি আঁকছিল। আমিও চেষ্টা করে দেখলাম। সবাই বলল, ভালই হয়েছে। তাই মাঝেমধ্যে আরও আঁকার চেষ্টা করছি।
প্র: আর কী করছেন?
শামি: (হাসি) এটা খুবই প্রাথমিক স্তরে রয়েছে, তবু আপনাকে বলছি। সাহস করে রান্নাঘরে যাচ্ছি।
প্র: তাই নাকি? কী খাবার তৈরি করলেন?
শামি: এখনই বেশি স্টেপ আউট করতে চাই না (হাসি)। সবে আগ্রহ দেখাতে শুরু করেছি। এখন সাহায্যই করছি বেশি। আর একটু শিখে নিই। তার পরে বলব।
প্র: আপনার ক্রিকেট সংসারের পার্টনারেরা জানেন? ক্যাপ্টেন কোহালি? বুমরা, ইশান্তরা জানেন?
শামি: ওদের সঙ্গে কথা হয়েছে। তবে একটু চুপচাপ এগোতে চাইছি। আগে একটু হাত পাকিয়ে নিই।
প্র: সতীর্থদের সঙ্গে কী তা হলে বোলিং নিয়েই আলোচনা করছেন?
শামি: না, অন্যান্য অনেক কিছু নিয়েই কথা হচ্ছে। ইনস্টাগ্রামে ‘চ্যাট’-ও করছি আমরা। কে কী ভাবে বাড়িতে সময় কাটাচ্ছে, সে সব নিয়েও কথা হচ্ছে। তবে আমরা সকলেই ট্রেনিং চালিয়ে যাচ্ছি। নিজেকে ফিট তো রাখতেই হবে। একটা ব্যাপারে আমরা সকলে একমত। লকডাউন চলছে বলে চার দিন ট্রেনিং করে দু’দিন বাড়িতে শুয়ে কাটালাম, সেটা করা যাবে না। তা হলেই ওজন বেড়ে যাবে, মেদ ধরে যাবে শরীরে। এই সময়টায় সব খেলোয়াড়, অ্যাথলিটের সব চেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ, নিজেকে ফিট রাখা। আমরা তাই ট্রেনিংয়ে কোনও ফাঁক রাখছি না।
প্র: নতুন কোনও ট্রেনিং করছেন কি?
শামি: আমাদের ভারতীয় দলের যে ট্রেনিং সূচি, তা অনুসরণ করছি। সেটাই প্রধান। তার সঙ্গে আমি যোগব্যায়াম শুরু করেছি। আমার মনে হচ্ছে, যোগাভ্যাসে ভাল ফল পাওয়া যেতে পারে। সবে শুরু করেছি। অল্প অল্প করে এগোচ্ছি। ভালই লাগছে।
প্র: এক পথচারীর পাশে আপনি যে ভাবে দাঁড়িয়েছেন, তা সকলের হৃদয় জিতে নিয়েছে। আপনার বাড়ির সামনে পড়ে ছিলেন সেই ব্যক্তি। কী ভাবে দেখলেন?
শামি: বাড়ির সিসিটিভি-তে দেখেছিলাম। এতটাই ক্ষুধার্ত ছিলেন যে, আর সহ্য করতে না-পেরে মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলেন। কী বলব বলুন? কত মানুষ কত কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, ভাবুন। ওই ভদ্রলোক রাজস্থান থেকে আসছিলেন, যাবেন বিহার। কোথায় উত্তর প্রদেশ আর কোথায় বিহার! কত দূরে যেতে হবে! আমাদের তো উচিত এমন মানুষের পাশে দাঁড়ানো। অনেক মানুষ নিজেদের ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্য রাজ্যে গিয়ে কাজ করেন। তাঁরা এখন খুব অসহায় হয়ে পড়েছেন কারণ কাজ বন্ধ। যতটা পারছি, সেই সব মানুষদের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছি এবং করে যাব।
প্র: বাড়িতে বসে ভারতীয় পেস ব্যাটারির সংহার দেখার উপায়ও নেই। গোটা দুনিয়া স্তব্ধ। এই অবস্থায় আপনার ভক্তদের, ক্রীড়াপ্রেমীদের উদ্দেশে কী বলবেন?
শামি: বলব, জীবনে কখনওসখনও ধৈর্যের পরীক্ষাও দিতে হয়। এটা সে রকমই চরম পরীক্ষা। কিন্তু নিজেদের রক্ষা করার জন্য এটাই একমাত্র পথ। লকডাউন মেনে চলুন, বাড়িতে থাকুন, পরিবারের সঙ্গে সময় কাটান। জীবনের সব চেয়ে কঠিন এই ম্যাচটায় সকলে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে করোনা নামক প্রতিপক্ষকে কিন্তু আমাদের হারাতেই হবে!
(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy