আশাবাদী: চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের ধন্যবাদ জানাতে বার্সেলোনায় হাততালি দুই নাগরিকের। গেটি ইমেজেস
দিনটা এখনও মনে করতে পারছি। সেটাই ছিল লা লিগায় রিয়াল মাদ্রিদের শেষ ম্যাচ। তারিখটা ৯ মার্চ। সে-দিন রিয়াল বেতিসের কাছে হেরে গিয়েছিল রিয়াল মাদ্রিদ। বরাবরের মতোই মাদ্রিদে আমাদের এলাকার সব বার, পাবে লোক ভর্তি। সকলের চোখ টিভি-র জায়ান্ট স্ক্রিনে। তুমুল চর্চা চলছে, ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো চলে যাওয়ার পরে সত্যি রিয়ালের কী হাল!
জ়িনেদিন জ়িদান এমনিতে মাদ্রিদে খুবই জনপ্রিয় চরিত্র। প্রচুর ভক্ত আছে। কিন্তু জ়িজ়ুও সমালোচনায় দগ্ধ এ বছরে। তিনি নিজেও তো বলে বসে আছেন, লিগায় রিয়ালের ভবিষ্যৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন। সেটা ছিল ৯ মার্চ। বিশ্বে করোনার প্রকোপ ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। কিন্তু স্পেন তখনও বুঝতে পারেনি, এ বার তার পালা। বুঝতে পারেনি, ভয়ানক দানব দুয়ারে উপস্থিত। স্পেন, তখনও ফুটবলের স্পেন।
এর চার দিন পরে সরকার ‘লকডাউন’ ঘোষণা করল। ভারতের মতোই রাতারাতি এল সেই ঘোষণা। আমি তখন কাজে। টিভি দেখে বুঝলাম, দ্রুত দোকানে ছুটতে হবে। সুপারমার্কেটে গিয়ে যতটা পারলাম, খাদ্যসামগ্রী তুলে রেখেছিলাম। তার পর থেকে মোটামুটি বাড়িতেই বন্দি। জানি না, কবে মুক্তি পাব। পরিবার থেকে এক জন কেউ বেরিয়ে প্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রী সংগ্রহ করে আনি। তা-ও খুব ভেবেচিন্তে যেতে হয়। কারণ, এখানে ‘লকডাউন’ অমান্য করে বিনা প্রয়োজনে রাস্তায় বেরোলে ৬০০ ইউরো জরিমানা। আজকের দিনে ৬০০ ইউরো মানে ভারতীয় মুদ্রায় ৫০ হাজার টাকা।
বাড়িতে বসেই স্পেনে করোনাভাইরাসের প্রকোপের ‘আপডেট’ দেখছি সরকারি ওয়েবসাইটে। আর ভাবছি, কত দ্রুত আমাদের ফুটবলের দেশ পাল্টে গিয়েছে আতঙ্কের দেশে। রোজ দুপুর ১২টা নাগাদ নতুন খবর দেওয়া হয় সরকারি ওয়েবসাইটে। শুক্রবার আনন্দবাজারের জন্য এই লেখাটা যখন ফোনে দিচ্ছি, এখানে বেলা আড়াইটে বাজে। ভারতে সন্ধে। ওয়েবসাইটে দেখছি, শুধু মাদ্রিদেই করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৯,২৯৩। তা-ও এই সংখ্যাটা যাঁদের করোনার পরীক্ষা হয়েছে, শুধু তাঁদের ধরে। অসংখ্য মানুষের পরীক্ষাই হচ্ছে না। মেডিক্যাল টিম পেরে উঠছে না। এমনই চেহারা নিয়েছে অতিমারি।
বিপন্ন: মেসি, জাভি, ইনিয়েস্তাদের শৈল্পিক ফুটবলও থমকে। ফাইল চিত্র
মাদ্রিদে আমি বাস করছি ১৮ বছর হয়ে গেল। কী অসাধারণ সব মুহূর্ত দেখেছি স্প্যানিশ ফুটবলের। ২০১০ সালে বিশ্বকাপ জয়। ২০১২-য় ইউরো জয়। জাভি, ইনিয়েস্তা, দাভিদ ভিয়া, পুয়োল, ক্যাসিয়াস, পিকে, ফাব্রেগাস। স্বপ্নের সেই টিম। যারা ফুটবলবিশ্বকে সম্মোহিত করে দিয়েছিল তাদের তিকিতাকা পাসিং ফুটবলে। বিশ্ব জয় করা নায়কদের জনজোয়ারে বরণ করা। আরও একটা কথা। স্পেন মানে তো শুধুই জাভি-ইনিয়েস্তা-দাভিদ ভিয়াদের শিল্প নয়। স্পেনে বিশ্বের সব চেয়ে আকর্ষক লা লিগাও যে হয়। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ হয়তো জনপ্রিয়তায় এগিয়ে কিন্তু বিশ্বের সর্বসেরা ফুটবলারেরা খেলেন স্পেনেই। লিয়োনেল মেসি এবং ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো যেমন। মেসি এখনও বার্সেলোনায় খেলে চলেছেন, রোনাল্ডো যদিও চলে গিয়েছেন জুভেন্টাসে। সেরা চাণক্যেরা এখানে কোচের কাজ করে গিয়েছেন। পেপ গুয়ার্দিওলা থেকে জোসে মোরিনহো সকলে। স্পেন মানে লা মাসিয়া। বার্সেলোনার সেই ফুটবল আশ্রম, যেখান থেকে বেরিয়েছে মেসি, ইনিয়েস্তার মতো জাদুকরেরা। স্পেন মানে য়োহান ক্রুয়েফের ফুটবল দর্শন। সুন্দর ফুটবলের দেশ। পাসিং ফুটবলের দেশ। পেপ গুয়ার্দিওলার হাতে ফোটা ফুটবলের সূর্যমুখী ফুল।
স্বপ্নের সেই স্পেনেই এখন করোনা-হানায় চলছে মৃত্যুমিছিল। এমনই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি যে, ইমার্জেন্সিতে ফোন করলে প্রথমে জিজ্ঞেস করছে, কতটা গুরুতর আপনার অবস্থা? যদি হালকা উপসর্গ হয়, তা হলে হাসপাতালে আসতে বারণ করে দিচ্ছে। বাড়িতে থাকুন, যদি দেখেন অবস্থার অবনতি হয়েছে, তখন আবার ফোন করবেন। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষই বা কী করবেন? কত লোকের চিকিৎসা করানো সম্ভব? প্রতি ঘণ্টায় লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা! টিভিতে ফুটবল তারকারা বার বার ঘোষণা করছেন, সাবধানে থাকুন। ঘরে থাকুন। নির্দেশ মেনে চলুন। ফুটবল উধাও। চার দিকে শুধু আর্তি। মৃত্যুমিছিলের মধ্যে দাঁড়িয়ে চলছে শুধু প্রাণের প্রার্থনা।
মাত্র সপ্তাহ দুয়েক আগেও কেউ ভাবতে পেরেছিল, এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে? তখনও তো স্পেন ডুবে ছিল ফুটবলে। তখনও মাদ্রিদে আমি কিশোর, তরুণদের দেখেছি ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর সেই বিখ্যাত ৭ নম্বর রিয়াল মাদ্রিদ জার্সি পরে এস্তাদিয়ো স্যান্তিয়াগো বের্নাবাউয়ের দিকে রওনা হতে। দেখতে দেখতে ভেবেছি, রোনাল্ডো রিয়াল মাদ্রিদ ছেড়ে জুভেন্টাসে চলে গিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু এখানকার ফুটবলভক্তদের হৃদয়ে থেকে গিয়েছেন। সেই বের্নাবাউয়ে এখন অস্থায়ী করোনা-শিবির বসেছে।
স্পেন মানে লিয়োনেল মেসি বনাম রোনাল্ডো দ্বৈরথ। দিয়েগো মারাদোনা-পরবর্তী যুগে বিশ্বের সেরা দুই ফুটবলার তাঁরা। কে শ্রেষ্ঠ, তা নিয়ে তর্ক অব্যাহত। মেসি বনাম রোনাল্ডো নিয়ে প্রতিটি এল ক্লাসিকোয় বার্সেলোনা, মাদ্রিদ এবং স্পেনের অন্যান্য অঞ্চলকে যে ভাবে ভেসে যেতে দেখেছি, সেই উন্মাদনার সঙ্গে পৃথিবীর আর কোনও শহরের তুলনা হয় কি না, সন্দেহ। এখন আবার মাদ্রিদের প্রিয় তারকা হচ্ছেন মোরাতা। আতলেতিকো দে মাদ্রিদে খেলেন। স্পেনের ভবিষ্যৎ বলা হচ্ছে তাঁকে। স্পেনের সব দলের মধ্যে আতলেতিকো দর্শকেরা বেশ কট্টর। বার্সেলোনা তবু হাততালি দিত রোনাল্ডোর উৎকর্ষ দেখে। মাদ্রিদ কুর্নিশ করেছে মেসির জাদুকে। কিন্তু আতলেতিকো শুধু চেঁচিয়ে যাবে তাদের টিম, তাদের তারকার জন্য।
এখন কোথায় সেই জয়ধ্বনি, কোথায় সেই গলা ফাটানো। শোনা যায় শুধু অ্যাম্বুল্যান্সের শব্দ আর সাইরেন। ১৪ মার্চ লকডাউনের পর থেকে আমার চেনা মাদ্রিদ দ্রুত পাল্টে গিয়েছে। এখন বাড়ির মধ্যে বসে জানলার পর্দা সরিয়েই শুধু বাইরেটা দেখতে পারি। স্বজন হারানোর পরে তাঁকে শেষ দেখার উপায়টুকুও নেই। সংক্রমণ যাতে না-ছড়ায় মৃতদেহ দেওয়া হচ্ছে না পরিবারকে। দাহ করার দৃশ্য ভিডিয়ো কল করে দেখানো হচ্ছে। চিরবিদায় নেওয়া প্রিয়জনকে সেটাই তাঁর পরিবারের শেষ দেখা। স্পেনে এমনিতেই বয়স্ক মানুষের সংখ্যা খুব বেশি। যত দূর মনে হয়, সম্ভবত গড় বয়সে জাপানের পরেই স্পেন। আমার আশেপাশেই অনেক অ্যাপার্টমেন্টে দেখেছি, সত্তরোর্ধ্বেরা স্বামী-স্ত্রী একাই থাকেন। সন্তানেরা থাকে অন্য জায়গায়। আন্দাজই করা যায়, কী রকম নিশি-আতঙ্ক চলছে।
তার উপরে শুরুতে করোনার প্রকোপকে গুরুত্ব দিতে না-চাওয়াটা স্প্যানিশ ফুটবলের বহু চর্চিত দুর্বল রক্ষণের চেয়েও বড় বিপর্যয় ডেকে এনেছে। ৯ মার্চ মাদ্রিদে বিরাট রাজনৈতিক জনসমাবেশ হয়েছে। তখন কিন্তু করোনা চিন, ইটালি হয়ে ছোবল মারতে শুরু করে দিয়েছে স্পেনে। ইউরোপ আক্রান্ত হচ্ছে। কিন্তু ইটালির মতোই সাবধান হয়নি স্পেন।
মেডিক্যাল সিস্টেমের দিক থেকে বিশ্বের প্রথম দশ দেশের মধ্যে রয়েছে স্পেন। কিন্তু এখন এমনই লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে মৃত আর আক্রান্তের সংখ্যা যে, সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। মাদ্রিদ থেকে বার্সেলোনা-সহ স্পেনের অন্যান্য জায়গায় ছড়িয়ে পড়ছে করোনার হানা। মৃতদেহের স্তূপ বাড়ছে। সমাধিস্থলে আর জায়গা করে ওঠা যাচ্ছে না। স্বাস্থ্যকেন্দ্রের কর্মীরা কঠিনতম আপস করতে শুরু করেছেন। ভেন্টিলেটর শুধু তাঁদেরই দেবেন, যাঁদের বাঁচার আশা আছে।
সন্ধেবেলায় এখনও ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে যদিও সকলে হাততালি দিচ্ছেন, গান গাইছেন, গিটার বা অন্য বাদ্যযন্ত্র বাজাচ্ছেন। ডাক্তার, নার্সেরা যে দিনরাত এক করে পরিশ্রম করে যাচ্ছেন, তাঁদের সেই প্রয়াসের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে। স্পেনের ফুটবল মাঠে করতালি থেমে গিয়েছে, বেঁচে আছে শুধু ব্যালকনিগুলোতে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy