সাধক: কঠোর পরিশ্রম এবং অধ্যবসায় পারে সাফল্যের শীর্ষে পৌঁছে দিতে। এখনও সেই মন্ত্রেই বিশ্বাস করেন সচিন তেন্ডুলকর। ট্রু ব্লু
রোহিত শর্মাকে দেখে কি বীরেন্দ্র সহবাগের কথা মনে পড়ে যায়? পারবেন কি রোহিত ওপেনার হিসেবে সফল হতে? পুরনো সেই ‘স-চি-ন, স-চি-ন’ ধ্বনি নিয়ে এখনও কী মনে হয়? ভারতীয় দলের এখনকার ব্যাটিং নিয়ে মূল্যায়ন কী? পুত্র অর্জুনের জন্য পরামর্শ কী? অবসরের পরে এই প্রথম এত অন্তরঙ্গ, খোলামেলা ভঙ্গিতে সচিন তেন্ডুলকর। বান্দ্রায় নিজের বাড়িতে বসে আনন্দবাজারকে দেওয়া দেড় ঘণ্টার দীর্ঘ, একান্ত সাক্ষাৎকারে মুখ খুললেন নানা বিষয় নিয়ে। যেন এক অনাবিষ্কৃত সচিন। সাক্ষাৎকারের আজ চতুর্থ তথা শেষ পর্ব...
প্রশ্ন: এই যে এত বছর ধরে দেশের প্রিয়তম তারকা খেলোয়াড় থেকে যাওয়া— এটা দেখে কী অনুভূতি হয়? এখনও স্টেডিয়ামে ভারত খেললে হঠাৎই দর্শকেরা ধ্বনি তোলেন ‘স-চি-ন, স-চি-ন’!
সচিন তেন্ডুলকর: আশীর্বাদ! আমি অসম্ভব ভাগ্যবান যে, মানুষের এই আশীর্বাদ সব সময় পেয়েছি। এ ছাড়া আমি আর কী-ই বা বলতে পারি! রঞ্জি ট্রফি বা ঘরোয়া ক্রিকেটের কোনও ম্যাচ হোক বা দেশের হয়ে খেলা— যখনই আমি মাঠে নেমেছি, সকলে এসেছেন। আমাকে সমর্থন করে গিয়েছেন। এর জন্য আমি সারা জীবন সকলের কাছে কৃতজ্ঞ থেকে যাব। এত মানুষের ভালবাসা আমি পেয়েছি যে, নিজেকে সত্যিই খুব ভাগ্যবান মনে হয়। বরাবরই এই একটা ব্যাপারে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে আমার গলা ধরে এসেছে। আমি সব চেয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে উঠি, যখন এটা নিয়ে আমাকে কেউ জিজ্ঞেস করে। কথা হারিয়ে যায় আমার। মনে হয়, মানুষের ভালবাসার দিকটা এত সুবিশাল যে, আমি সেটা নিয়ে যা-ই বলি না কেন, খুব সামান্য প্রতিক্রিয়া হয়ে যাবে। শুধু হাত জোড় করেই বোধ হয় বলতে পারি, আমি চিরকৃতজ্ঞ। কী জানেন তো, এই জিনিসগুলো কখনও কেনা যায় না। এই ভালবাসা অমূল্য। আমি কখনও কথায় বলে ঠিকঠাক ভাবে বুঝিয়ে উঠতে পারব না যে, মানুষের ভালবাসা আমাকে কতটা উদ্বুদ্ধ করত। ব্যাট হাতে যখন মাঠের দিকে এগিয়ে যেতাম, ভিতরে ভিতরে একটা শক্তি অনুভব করতাম। আর সেই শক্তিটা আসত স্টেডিয়াম-ভর্তি মানুষের ওই ধ্বনিটা থেকে। অবসরের এতগুলো বছর পরেও যে-ধ্বনিটা আমার কানে লেগে রয়েছে।
প্রশ্ন: সচিন তেন্ডুলকরের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী? তাঁকে কী ভূমিকায় এর পরে আমরা দেখব? কোচ না মেন্টর? নাকি অন্য কিছু?
সচিন: আমার দরজা সকলের জন্য সব সময় খোলা। যে যখনই এসেছে পরামর্শ নেওয়ার জন্য বা আলোচনা করার জন্য, আমি সব সময়েই পাশে থেকেছি। বরাবর তেমনই ছিল। আমার খেলার দিনেও অনেকের সঙ্গে আলোচনা করতাম। আমি এই ক্রিকেট আলোচনাগুলো উপভোগ করি। এ ভাবেই চলুক না। কারও পাশে দাঁড়ানোর জন্য বা কাউকে উপদেশ দেওয়ার জন্য সরকারি ভাবে কোচ বা মেন্টরের পদে বসতেই হবে, এমন কোনও কথা নেই, তা-ই না? আমার দরজা সকলের জন্য সব সময় খোলা ছিল, থাকবে।
প্রশ্ন: নতুন টেস্ট ওপেনার রোহিত শর্মাকে কেমন লাগল? রোহিতকে দেখে কি সহবাগের কথা মনে পড়ছে?
সচিন: আমি তুলনায় যেতে চাই না। রোহিত শর্মার মূল্যায়ন রোহিত শর্মা হিসেবেই হওয়া উচিত। সহবাগ বা অন্য কারও ছায়ায় ওকে ভাবা উচিত নয়। আমার নতুন করে বলার দরকার নেই যে, ও দুর্ধর্ষ প্রতিভা। সব সময়েই সকলে সেটা জানত। একটা নতুন ভূমিকায় ওকে পরীক্ষা দিতে নামতে হয়েছিল এবং দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে তিনটি টেস্টে দারুণ সাফল্যের পরে এই প্রশ্নটা আর উঠবে না যে, রোহিত পারবে কি না? ও প্রমাণ করে দিয়েছে, ওপেনার হিসেবে সফল হওয়ার যোগ্যতা এবং মানসিকতা দু’টোই ওর আছে। তবে রোহিত নিজেই বলেছে, ওর আসল পরীক্ষা হবে বিদেশের মাটিতে। আমি নিশ্চিত, ওর মতো প্রতিভাবান ক্রিকেটার বিদেশে গিয়েও নিশ্চয়ই সাফল্য পাবে। রোহিতের ব্যাট সুইংটা দারুণ। সহবাগেরও সেটা ছিল। আমি নিশ্চিত রোহিত ওপেনার হিসেবেও ‘স্পেশ্যাল’ কিছু করে দেখাবে।
প্রশ্ন: রোহিত, পুজারা, বিরাট, অজিঙ্ক। সেরা ব্যাটিং লাইন-আপের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার মতো নাম। তবু একযোগে ব্যাটিং ইউনিট হিসেবে উচ্চতম শৃঙ্গে আরোহণ করাটা আটকে রয়েছে বলে মনে হয় কেন? কেন এই ব্যাটিংকে সর্বকালের সেরা ব্যাটিং বিভাগগুলোর পাশে বসানো যাচ্ছে না? বিশেষ করে বিদেশে সকলের সেই ধারাবাহিকতা নেই।
সচিন: আমার মনে হয়, চার জনেই খুব প্রতিষ্ঠিত ব্যাটসম্যান। তবে ওদের মধ্যে কোথাও একটা নিরাপত্তা বোধের অভাব তৈরি হয়েছিল। যদি দেখেন, টেস্ট ক্রিকেটে ওদের বসিয়েও দেওয়া হয়েছে, এবং, যখন এক জন প্রতিষ্ঠিত ক্রিকেটারকে বসিয়ে দেওয়া হয়, তাকে সেটা ধাক্কা দিতে বাধ্য। তখন নতুন করে আবার তাকে আত্মবিশ্বাস তৈরি করতে হয় যে, আমি সেই আগের মতোই ভাল খেলোয়াড় আছি। আমি আগের মতোই পারব। এটা কিন্তু সহজ কাজ নয়। সেই পুরনো আত্মবিশ্বাস তখনই ফিরবে, যদি সেই খেলোয়াড় আবার আগের মতো রান করা শুরু করে। যত ক্ষণ না সেটা হচ্ছে, তার জন্য পরিস্থিতি বেশ কঠিন এবং চ্যালেঞ্জিং। এক জন ক্রিকেটার টানা খেলার স্রোতের মধ্যে থাকলে এক রকম মানসিক গঠন থাকে। তাকে বসিয়ে দেওয়া হলে চিন্তাভাবনা সম্পূর্ণ ঘুরে যেতে পারে। সেটা হয়ে থাকতে পারে। আপনি বিদেশে ব্যাটিং পারফরম্যান্সের কথা তুললেন। কিন্তু বিদেশ সফরেই তো ওদের বসানো হয়েছিল। পুজারাকে ইংল্যান্ডে বসানো হয়েছিল, রাহানেকে দক্ষিণ আফ্রিকায় বাদ দেওয়া হয়েছিল। যে-কোনও ক্রিকেটারকে গিয়ে জিজ্ঞেস করুন, বাদ পড়ার আগে আর বাদ পড়ার পরে দু’টো পর্বে আপনার চিন্তাভাবনায় কোনও তফাত হয়েছিল কি? দেখবেন প্রত্যেকে বলবে, হ্যাঁ, হয়েছিল।
প্রশ্ন: ধারাবাহিক সাফল্যের জন্য প্রতিষ্ঠিত টিম দরকার, তা-ই বলবেন কি? বেশি নাড়াচাড়া অপ্রয়োজনীয়?
সচিন: আমার মনে হয়, আমাদের ব্যাটিং বিভাগ অবশ্যই প্রতিষ্ঠিত। এ নিয়ে সন্দেহের কোনও অবকাশই নেই। অনেক সময় টিমে অদলবদল করতে হয় চোট-আঘাতের জন্য। তবে ফর্মের জন্য বদল করার সময় সতর্ক থাকাই উচিত। যদি কোনও প্রতিষ্ঠিত ক্রিকেটার সাংঘাতিক রকম খারাপ ফর্মের মধ্য দিয়ে যায়, তখনই শুধু তাকে নিয়ে চিন্তাভাবনা করার অবকাশ থাকে। না-হলে এটাই ধরে নেওয়া স্বাভাবিক যে, প্রতিষ্ঠিত টিম থাকলে তাকে বিরক্ত করার দরকার নেই। এবং আমি মনে করি, আমাদের প্রতিষ্ঠিত ব্যাটিং ইউনিট রয়েছে।
প্রশ্ন: রাজ্যসভার সদস্য হিসেবে দূরদূরান্তে স্কুল গড়ে তোলার কাজে সাহায্য করছিলেন। এখন শিশু এবং মেয়েদের ভূমিকা নিয়ে সমাজকে সচেতন করতে উদ্যোগী হচ্ছেন। নিজের অন্য ভূমিকার কথা বলুন...
সচিন: শিশুরাই তো ভবিষ্যৎ। গড় বয়সের দিক থেকে বিশ্বের কনিষ্ঠতম দেশ হতে চলেছে ভারত। সেই কারণে শিশুদের নিয়ে আরও গভীরে গিয়ে ভাবার সময় এসেছে। আমি ইউনিসেফের সঙ্গে এই বিষয়ে একটা কাজে যুক্ত হয়েছি, যার নাম দেওয়া হয়েছে ‘আর্লি চাইল্ডহুড ডেভেলপমেন্ট’। প্রধান লক্ষ্য, শিশুদের সক্রিয়, স্বাস্থ্যবান আর শিক্ষিত করে তোলা। যদি এটা সব দিকে ছড়িয়ে দেওয়া যায়, আমাদের দেশের ভবিষ্যৎও উজ্জ্বল হয়ে উঠবে। আমি শিশুদের নিয়ে কাজ করতে চাই। তাতে খেলার ভূমিকাও থাকবে। ভারতকে খেলাধুলো-প্রিয় দেশ থেকে খেলাধুলো করা দেশে পরিণত করার স্বপ্ন দেখি। ইউনিভার্সিটি এবং বিভিন্ন সরকারি সংস্থার সঙ্গে হাত মিলিয়ে কাজ করছি, যাতে এই পরিবর্তনটা আনা সম্ভব হয়। দেশ জুড়ে চলা কিছু উদ্যোগেও আমি শামিল হয়েছি। স্বচ্ছ ভারত অভিযান তার মধ্যে রয়েছে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নিয়ে চার দিকে যে-উন্নতির ছাপ ধরা পড়ছে, তা দেখে আমি উচ্ছ্বসিত। আর একটা জিনিস নিয়ে বলতে চাই। তা হচ্ছে, জলের অপচয় রোধ করা। এ ব্যাপারে সচেতন হতেই হবে আমাদের। সম্প্রতি ‘জল শক্তি অভিযান’ নামে একটা কর্মসূচিতে আমি যোগ দিয়েছি। আমার দেশ আমাকে দু’হাত ভরে দিয়েছে। যা কখনওই ফিরিয়ে দেওয়া যাবে না। তবে যে-কোনও উদ্যোগের মাধ্যমে দেশের সেবায় নিযুক্ত হয়ে অবদান রাখতে চাই।
প্রশ্ন: শেষ প্রশ্ন। জানি, এই বিষয়টি নিয়ে কখনওই মুখ খুলতে চান না। তবু জানতে ইচ্ছা করছে, পুত্র অর্জুন যে ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন দেখছে... তাতে বাবার থেকে কী ধরনের সমর্থন আর উপদেশ পাচ্ছে?
সচিন: আমি অন্য আর-পাঁচটা বাবার মতোই। যারা সব সময় সন্তানদের শুভ কামনাই করে আর তাদের জীবনের রাস্তায় এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য যে-পথপ্রদর্শকের কাজ করতে হয়, সেটা করে যায়। যদি ক্রিকেটের দিকটা বলেন, হ্যাঁ, আমার হয়তো মাঠে নেমে খেলার অভিজ্ঞতাটা রয়েছে। সেটা বাদ দিলে অনুভূতিটা অন্য যে-কোনও বাবার মতোই। আর অর্জুনের ক্রিকেট খেলার সিদ্ধান্তটা ওর নিজের। আমি কখনও চাপিয়ে দিইনি। আমি তো দেখি, ও অনেক খেলা নিয়েই আবেগতাড়িত হয়ে পড়ে। ক্রিকেট তো খেলেই, ফুটবল নিয়ে মেতে থাকে, দাবা খেলতেও খুব ভালবাসে। আমি একটাই কথা মনে রাখতে বলি ওকে। যা-ই করো না কেন, নিজের সেরাটা দাও। কোনও শর্টকাট খোঁজার চেষ্টা করবে না। ঠিক যে-কথাটা আমার বাবা আমাকে বলতেন। নিজের খেলার অভিজ্ঞতা থেকে ছেলেকে বলি, আমি নিজে খেলেছি বলে জানি। প্রতিদিন সাফল্য তোমার সঙ্গী হবে না। কিন্তু মনে রাখবে, প্রস্তুতিটাই সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। যদি সাধনায় খামতি না-থাকে, যদি পরিশ্রম করে যাও, যদি ফাঁকি না-দাও, যদি অধ্যবসায় থাকে, ফল আসবেই। বলি, একাধিক জিনিস মাথায় ঢুকিয়ে বিভ্রান্ত হয়ে যেয়ো না। কোনও রকম চাপ আমার দিক থেকে নেই। শুধু একটাই কথা বলব, যদি খেলতে হয়— সেটা যে-খেলাই হোক না কেন— সবার আগে খেলাটাকে ভালবাসো। আমি ঠিক সেটাই করেছিলাম। আর আমি আপনাকে বলতে পারি, অর্জুনকে দেখে আমার মনে হয়েছে, ক্রিকেটের প্রতি ভালবাসায় ও বুঁদ হয়ে রয়েছে। এখন ওকে সে-রকমই থাকতে দিতে চাই। আমার কাছে সেটাই সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আর কোনও রকম চাপ দেওয়ার ব্যাপারই নেই যে, এ-রকম ফল করতে হবে, সে-রকম ফল করতে হবে। খেলাকে ভালবাসো, খেলাকে উপভোগ করো। আমি খেলার সময় এটাই আমার প্রধান মন্ত্র ছিল। ছেলের জন্যও একই পরামর্শ!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy