চর্চায়: এই ভঙ্গিই বুমরার সম্পদ, মনে করছেন সরফরাজ়। ফাইল চিত্র
রিভার্স সুইংয়ের জনক বলা হয় তাঁকে। সেই তিনি— সরফরাজ় নওয়াজ় শঙ্কিত হয়ে পড়ছেন করোনা পরবর্তী সময়ে ফাস্ট বোলারদের কথা ভেবে। লন্ডন থেকে আনন্দবাজারকে দেওয়া বিশেষ সাক্ষাৎকারে প্রাক্তন পাক পেস-কিংবদন্তি এমন কথাও বলে দিলেন যে, ‘‘করোনাভাইরাসের জেরে বলের পালিশ করা নিয়ে যে রকম কঠিন সব নিষেধাজ্ঞা আসতে চলেছে, তাতে রিভার্স সুইং শিল্পটাই না বিলুপ্ত হয়ে যায়! বলে যদি থুতু বা লালা দিয়ে পালিশ না-করা যায়, তা হলে রিভার্স সুইং হবেই বা কী করে!’’
লাহৌরের নেটে অনুশীলনের সময়ে সরফরাজ়ের রিভার্স সুইং আবিষ্কারের চমকপ্রদ কাহিনি ক্রিকেট রূপকথায় স্থান করে নিয়েছে। তাঁর অভ্যাস ছিল নানা ধরনের পুরনো বল দিয়ে বল করা। এক দিন খুব পুরনো একটা বলকে পালিশ করে চকচকে করে তোলেন তিনি। তার পরে সেটা দিয়ে বল করতে গিয়ে দেখেন, যে দিকে সুইং করার কথা, তার উল্টো দিকে বাঁক নিচ্ছে বল। চমকে উঠে সরফরাজ় দেখেন, বলটির দু’দিকই বেশ ক্ষয় হয়ে গিয়েছে। এবড়োখেবড়ো হয়ে রয়েছে। কিন্তু যে-হেতু তিনি পালিশ বার করতে পেরেছেন, সেই চকচকে ভাবটুকুর দৌলতে উল্টো সুইং হচ্ছে।
রিভার্স সুইংয়ের সেই ছিল ‘ইউরেকা’ মুহূর্ত। ‘‘রিভার্স বন্ধ হয়ে গেলে ফাস্ট বোলারদের জীবন বিপন্ন হয়ে পড়বে। লকডাউন উঠে ক্রিকেট ফিরলে আইসিসি-র উচিত, ঘাসের উইকেট তৈরি করা। না হলে আরওই ব্যাটসম্যানদের পক্ষে চলে যাবে ক্রিকেট,’’ বলছেন সরফরাজ়। আরও পর্যবেক্ষণ, ‘‘স্পিনারদের ভূমিকা ফের বেড়ে যাবে ক্রিকেটে। বল যদি রক্ষণাবেক্ষণ না-করা যায়, রিভার্স হবে না। তখন পুরনো বলে প্রভাব কমবে পেসারদের, ভরসা হবে স্পিনাররাই।’’
আরও পড়ুন: বর্ণবিদ্বেষ ক্রিকেটেও আছে, তোপ গেলের
ভারতীয় ক্রিকেট ভক্তদের নিশ্চয়ই মনে থাকবে লম্বা গোঁফের সোয়েটার পরিহিত সরফরাজ় নওয়াজ়কে। ইডেনেও খেলে গিয়েছেন ইমরান খানের দলের সঙ্গে। ভারতে এক সময়ে ফাস্ট বোলিংয়ের ক্লাসও করিয়ে গিয়েছেন। ইংল্যান্ডে কোভিড-১৯ নিয়ে খুবই উদ্বেগজনক পরিস্থিতি। লন্ডননিবাসী পাক পেস-কিংবদন্তি অবশ্য শোনালেন, ‘‘এখন মনে হচ্ছে, অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আসছে। তবে বাইরে বেরনোর ঝুঁকি কেউ নিতে চাইছে না।’’ তবে তিনি বেশি চিন্তিত ফাস্ট বোলিং এবং বিশেষত, রিভার্স সুইংয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে। বলছেন, ‘‘পুরনো বলের এক দিক চকচকে রেখে, অন্য দিকটা ভারী করতে না-পারলে তো রিভার্স হবে না!’’ মোমের মলম বানিয়ে কৃত্রিম পদার্থ দিয়ে বলের পালিশ রক্ষা করার কথা উঠেছে। সরফরাজ়ের প্রতিক্রিয়া, ‘‘ঘাম, থুতু, লালা— এ সব দিয়েই তো বলের পালিশ রেখে এসেছে বোলাররা। তাতে পুরনো বলে রিভার্স সুইং হয়েছে। কৃত্রিম পদার্থ দিয়ে একই কাজ হবে? আমি কিন্তু নিশ্চিত নই।’’
ডব্লিউ জি গ্রেস ফরোয়ার্ড-ব্যাকফুট এনেছিলেন ব্যাটিংয়ে। রঞ্জিৎ সিংহজি লেগ গ্লান্স উপহার দিয়েছিলেন এমন একটা খেলায় যেখানে এক সময়ে অনসাইডে খেলার জন্য সি বি ফ্রাইকে দুঃখপ্রকাশ করতে হয়েছিল। বোসানকোয়েটের হাতে জন্ম নিয়েছিল গুগলি। তেমনই রিভার্স সুইংয়ের আবিষ্কারক সরফরাজ় নওয়াজ়। ‘রিভার্স’ কারণ, প্রথাগত সুইংয়ের উল্টোটা হয়। যেমন, ডানহাতি বোলার আউটসুইংয়ের সময়ে পালিশ করা দিকটি বাইরের দিকে (সেলাইয়ের উপরে ধরা আঙুলের ডান দিকে) রাখে। রিভার্স সুইংয়ে এ ভাবে ধরলে বলটি ইনসুইং হয়ে যাবে। শুধু সেলাইকে ঘুরিয়ে দিতে হবে স্লিপ থেকে লেগস্লিপের দিকে। যে-হেতু প্রত্যেক ব্যাটসম্যান চেষ্টা করেন বোলারের হাত দেখে খেলার, রিভার্স সুইং হলে তাঁরা বিভ্রান্ত হন, বল কোন দিকে বাঁক নেবে। এবং, উচ্চ গতিতে খুব দেরিতে সুইং করে বলে রিভার্স সামলানো অনেক বেশি কঠিন।
একটি ম্যাচে ইমরান খান লক্ষ্য করেন, পুরনো বলে তিনি সুইং পাচ্ছেন না। সরফরাজ় দিব্যি পাচ্ছেন। তখনই ইমরান তাঁকে বলেন, রিভার্সের মন্ত্র শেখাতে। সরফরাজ় জানান, ম্যাচে নয়, পরে অনুশীলনে শিখিয়ে দেব। কথা রেখেছিলেন তিনি। ইমরানকে শিখিয়ে দেন রিভার্স শিল্প এবং তাঁর থেকে পরবর্তীকালে শেখেন ওয়াসিম আক্রম, ওয়াকার ইউনিসরা।
এখন পাকিস্তানকে টেক্কা দেওয়ার মতো ফাস্ট বোলার এসে গিয়েছে ভারতের হাতে। সরফরাজ়ের পর্যবেক্ষণ, ‘‘আইপিএল আসার পরে ক্রিকেট বিপ্লব ঘটে গিয়েছে ভারতে। অনেক তরুণ প্রতিভা উঠে আসতে পারছে। দারুণ মঞ্চ পেয়ে গিয়েছে ওরা। টি-টোয়েন্টি লিগ পেসার হওয়ার স্বপ্ন তৈরি করেছে তরুণদের মধ্যে।’’
ভারতীয় পেসারদের মধ্যে যশপ্রীত বুমরা, মহম্মদ শামি, ভুবনেশ্বর কুমারকে পছন্দ তাঁর। বললেন, ‘‘করোনার জেরে যে সব নিষেধাজ্ঞা আনার কথা হচ্ছে, তাতে বুমরার উপরে কোনও প্রভাব পড়বে না। ওর বোলিংয়ের ধরনটা সম্পূর্ণ অন্য রকম। পালিশ-নির্ভর সুইং বোলিং নয়, ওর অস্ত্র পিচ্ছিল গতি এবং কোণ তৈরি করা।’’ বাকিদের? সরফরাজ়ের বিশ্লেষণ, ‘‘ভুবনেশ্বর নতুন বলে ভাল সুইং করায়। পুরনো বলে ততটা কার্যকর নয়। তাই ওর ক্ষেত্রেও খুব ফারাক হবে না। শামি সিমকে ব্যবহার করে বোলিং করতে পারে। সুইংও করায়। পুরনো বলে রিভার্স সুইং করায় শামি। ওর কিছুটা সমস্যা দেখা দিতে পারে।’’ করোনা-পরবর্তী লড়াইয়ে ফাস্ট বোলারদের জন্য তাঁর পরামর্শ কী? ‘‘বলের পালিশ না রাখা গেলে সুইং ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তা হলে কাটারের উপরে বেশি নির্ভর করতে হবে। ক্রিজের কোণ তৈরি করে, বুদ্ধি করে গতির হেরফের করে ব্যাটসম্যানকে সমস্যায় ফেলতে হবে,’’ প্রেসক্রিপশন রিভার্স সুইংয়ের জনকের।
আরও পড়ুন: অদম্য সেই কুম্বলেতে মুগ্ধ লক্ষ্মণ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy