কোচ রমেশের সঙ্গে প্রজ্ঞানন্দ। —ফাইল ছবি
এয়ারথিংস মাস্টার্স দাবায় বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ম্যাগনাস কার্লসেনকে হারিয়ে হইচই ফেলে দিয়েছে চেন্নাইয়ের ছেলে রমেশবাবু প্রজ্ঞানন্দ। কিন্তু ভারতীয় দাবার এই প্রতিভাধর কী ভাবে কিস্তিমাত করলেন কার্লসেনকে? সেই রহস্যই প্রকাশ্যে আনলেন প্রজ্ঞার কোচ গ্র্যান্ড মাস্টার আরবি রমেশ। প্রায় এক দশক ধরে রমেশ ভারতের পুরুষদের জাতীয় দলেরও প্রশিক্ষক। ভারতের দাবা মহলে তাঁর পরিচয় সুপার কোচ হিসেবে।
কার্লসেনকে হারানো সহজ ছিল না। ভারতের তৃতীয় দাবাড়ু হিসেবে এই কৃতিত্ব দেখিয়েছে প্রজ্ঞানন্দ। এর আগে বিশ্বনাথন আনন্দ এবং পি হরিকৃষ্ণ হারিয়েছেন কার্লসেনকে। ১৬ বছরের গ্র্যান্ড মাস্টার আগেই জানিয়েছেন নিজের অনুভূতি, প্রস্তুতির কথা। কিন্তু তাঁর এই কৃতিত্বের পিছনে রয়েছে আরও এক জনের ক্ষুরধার মগজাস্ত্র। তিনি আরবি রমেশ। প্রজ্ঞানন্দের কোচ। কার্লসেনের সঙ্গে ম্যাচের দিন পাশের ঘরে সারা রাত জেগেছিলেন রমেশ। ভোর তিনটের সময় তিনিই প্রজ্ঞানন্দের বাবাকে প্রথম জয়ের খবর দেন। আগের ম্যাচেই প্রজ্ঞানন্দ আর্মেনিয়ান গ্র্যান্ড মাস্টার লেভন অ্যারোনিয়নকে হারানোয় আত্মবিশ্বাসী ছিলেন তিনি।
রমেশ জানিয়েছেন, প্রতিযোগিতা শুরুর দশ দিন আগেই চূড়ান্ত প্রস্তুতি শুরু করেন তাঁরা। তিনি বলেছেন, ‘‘প্রজ্ঞানন্দ ভোর চারটের সময় ঘুমাতে যেত দশ দিন আগে থেকে। দুপুর একটায় উঠত। অনুশীলন শুরু করত রাত সাড়ে দশটা থেকে। ভোর তিনটে পর্যন্ত চলত অনুশীলন। এটাই ছিল ভারতীয় সময় অনুযায়ী খেলার সময়। নতুন সময় সূচির সঙ্গে মানসিক এবং শারীরিক ভাবে মানিয়ে নেওয়ার জন্য এটা দরকার ছিল।’’
সাত বছর বয়স থেকে প্রজ্ঞানন্দকে কোচিং করাচ্ছেন রমেশ। তিনি বলেছেন, ‘‘ম্যাগনাসের ম্যাচটার কৌশল নিয়ে আমরা প্রতিদিন দুপুরে আলোচনা করতাম। চার রকম কৌশল ঠিক করা হয়েছিল। প্রতিদিন দু’জনে চারটে করে ম্যাচ খেলতাম। সব কৌশলগুলো রপ্ত করার জন্য। ওপেনিং নিয়েও নতুন ভাবনা ছিল। প্রতিপক্ষের শক্তি এবং দুর্বলতা নিয়ে আলোচনা করতাম।’’
অনেক বিশেষজ্ঞই মনে করছেন, একটা ছোট ভুলে ম্যাগনাস ম্যাচটা একরকম প্রজ্ঞানন্দের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। রমেশ এই যুক্তি মানতে নারাজ। তাঁর বক্তব্য, ‘‘যদি সব খেলায় উভয় পক্ষ সব দিক দিয়ে নিখুঁত হয়, তা হলে কোনও খেলার মীমাংসাই হবে না। এক পক্ষকে কিছু না কিছু ভুল করতেই হবে। না হলে ম্যাগনাসের মতো খেলোয়াড়ও কাউকে হারাতে পারবেন না।’’ তিনি আরও বলেছেন, ‘‘ম্যাগনাসের বিরুদ্ধে সুবিধাজনক জায়গায় যাওয়া খুবই কঠিন। বিশেষ করে কালো ঘুঁটি নিয়ে। কিন্তু ওই ম্যাচটায় সেটা হয়নি কারণ, আমাদের খুব ভাল প্রস্তুতি ছিল। প্রজ্ঞা ওপেনিংয়ের পরই সুবিধাজনক জায়গায় চলে আসে। ম্যাচে ওঁর অগ্রগতিও প্রজ্ঞার মতো ভাল ছিল না। ম্যাগনাস আরও একটা ভুল করেন। সেটা কিন্তু প্রতিপক্ষের ভাল খেলার চাপেই করেছেন। জানতাম আমরা নির্ভুল খেলতে পারলে প্রতিপক্ষ এমনিই চাপে পড়ে যাবে। ওই ম্যাচে ঠিক সেটাই হয়ে ছিল। প্রজ্ঞা যখন রক্ষণাত্মক খেলছিল, তখন একটু ঝুঁকি নিয়েই একটা বড়ে হারিয়েছিল। তার পরেই প্রজ্ঞা নিজের ঘুঁটিগুলোকে সক্রিয় করতে শুরু করে এবং ম্যাগনাসকে চাপে ফেলার চেষ্টা করে। এই কৌশলেই চাপের মুখে ভুল করেন ম্যাগনাস। প্রজ্ঞা কিন্তু সুযোগটা দারুণ ভাবে কাজে লাগিয়েছে।’’
রমেশ মেনে নিয়েছেন কার্লসেনকে হারানো বাড়তি তৃপ্তি দিচ্ছে তাঁকে। ভারতীয় দাবা নিয়েও দারুণ আশাবাদী তিনি। বলেছেন, ‘‘আমেরিকা এবং ইউরোপের খেলোয়াড়রা কিন্তু এখন ভারতের তরুণ প্রজন্মের বিরুদ্ধে বেশ চাপে থাকে। আমাদের তরুণ খেলোয়াড়রা অনেকটা শিকারী বাঘের মতো। কারণ, ওরা বিদেশের সব খেলোয়াড়েরই ভাবমুর্তি একদম তছনছ করে দিয়েছে।’’ আরও বলেছেন, ‘‘এর পর হয়তো বহু ছোট ছোট ছেলে-মেয়ে প্রজ্ঞার মতো হওয়ার চেষ্টা করবে। ওরাও বিশ্বচ্যাম্পিনয়কে বা ওই মানের কাউকে হারানোর চেষ্টা করবে। অনেকে নুতন করে দাবার প্রতি আকৃষ্টও হতে পারে। সব মিলিয়ে খেলাটার জন্য ভালই হবে। আশা করব এর পর আরও বেসরকারি সংস্থা দাবার জন্য খরচ করতে আগ্রহী হবে।’’
ভারতে এই মুহূর্তে দাবার প্রশিক্ষণের মান নিয়ে খুশি গ্র্যান্ড মাস্টার রমেশ। তবে তাঁর আক্ষেপ দেশে ভাল প্রশিক্ষকের সংখ্যা একটু কম। গত পাঁচ-ছ’দিনে বহু মানুষ তাঁকে তাঁদের বাচ্চাদের দাবা শেখানোর অনুরোধ নিয়ে যোগাযোগ করেছেন। রমেশ চান দাবা শেখার একটা সিলেবাস তৈরি করতে। যেটা কোচ এবং শিক্ষার্থীদের সাহায্য করবে। রমেশের স্ত্রী আরতি রামস্বামীও মহিলা গ্র্যান্ড মাস্টার। কয়েক বছর আগে দু’জনে মিলে চেন্নাইয়ে শুরু করেছেন চেস গুরুকূল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy