Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Bengal

আশা বাঁচিয়ে রেখেছেন সেই অনুষ্টুপই, দুরন্ত লড়াই সুদীপের

বাংলা ও রঞ্জি ট্রফির মাঝে এখনও ৭২ রান, হাতে চার উইকেট। চতুর্থ দিনের শেষে সৌরাষ্ট্রের প্রথম ইনিংসের থেকে ৭১ রানে পিছিয়ে

ভরসা: দলের প্রয়োজনে বারবার জ্বলে উঠেছে তাঁর ব্যাট। ফাইনালেও অনুষ্টুপের দিকে তাকিয়ে বাংলা। সিএবি মিডিয়া

ভরসা: দলের প্রয়োজনে বারবার জ্বলে উঠেছে তাঁর ব্যাট। ফাইনালেও অনুষ্টুপের দিকে তাকিয়ে বাংলা। সিএবি মিডিয়া

ইন্দ্রজিৎ সেনগুপ্ত
রাজকোট শেষ আপডেট: ১৩ মার্চ ২০২০ ০৫:০১
Share: Save:

ধৈর্য ও নিষ্ঠার লড়াই। প্রতিভা ও তাগিদের লড়াই। তারকার খোলস ছেড়ে বেরিয়ে পাশে দাঁড়ানোর পরীক্ষা। রঞ্জি ট্রফির ফাইনাল এখন এ সবেরই মিশ্রণ।

এখানে কৌশলকে পিছনে ফেলে এগিয়েছে শৃঙ্খলা। কমেছে দম্ভ-অদম্ভের ব্যবধান। জিতেছে ক্রিকেট। প্রশ্ন উঠতে পারে, বাংলা তো এখনও জেতেনি। এই প্রসঙ্গ উঠছে কী করে? প্রসঙ্গ তুলে দিয়েছেন সুদীপ চট্টোপাধ্যায়, ঋদ্ধিমান সাহা, অনুষ্টুপ মজুমদার ও অর্ণব নন্দী নামক চার বঙ্গসন্তান। যাঁদের হার-না-মানা লড়াই টিকিয়ে রেখেছে তিরিশ বছর আগে গড়া ইতিহাসের পুনরাবৃত্তির স্বপ্ন।

বাংলা ও রঞ্জি ট্রফির মাঝে এখনও ৭২ রান, হাতে চার উইকেট। চতুর্থ দিনের শেষে সৌরাষ্ট্রের প্রথম ইনিংসের থেকে ৭১ রানে পিছিয়ে। নিশ্চিত ভাবেই বলে দেওয়া যায়, প্রথম ইনিংসে এগিয়ে থাকা দলই তুলবে এ বারের রঞ্জি ট্রফি। বাংলার সামনে পথ দুর্গম হলেও লক্ষ্য স্থির।

১৯৯০ সালে দিল্লির বিরুদ্ধে ফাইনালের আগে বাংলার ড্রেসিংরুমে উদ্বুদ্ধ করতে এসেছিলেন প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। স্লোগান তুলেছিলেন, ‘‘ফাইট, বেঙ্গল ফাইট।’’ প্রদীপবাবু এখন গুরুতর অসুস্থ। লড়াই করছেন প্রতিটি মুহূর্তের সঙ্গে। লড়ছে বাংলাও। রাজকোটের এসসিএ স্টেডিয়ামের বাইশ গজে। যেখানে একটি করে রান, একটি নিঃশ্বাসের সমান। একটি করে ওভার পেরোনো, যেন চোরাবালি ভেদ করে বেরিয়ে আসার লড়াই।

চোরাবালিতে পা ডুবিয়েই শুরু হয়েছিল বাংলার চতুর্থ দিন। তখন স্কোরবোর্ড বলছে ১৩৪-৩। সুদীপ ও ঋদ্ধির দায়িত্ব ছিল, সেখান থেকে দলকে টেনে বার করা। দু’ঘণ্টার মধ্যে কয়েকটি ঘটনা বদলা দিতে পারত চিত্রনাট্য। কিন্তু ভাগ্য, ধৈর্য ও অদম্য ইচ্ছেয় প্রথম সেশনে সফল বাংলা। দিনের তৃতীয় ওভারের তৃতীয় বল আছড়ে পড়ে ঋদ্ধির প্যাডে। আম্পায়ার অনন্তপদ্মনাভন আঙুল তুলে প্যাভিলিয়নে ফেরার নির্দেশ দেন। প্রাণ ফিরিয়ে দেয় আংশিক ডিআরএস। ওভার ৮৫.৪। ফের উনাদকাটের ইনসুইং আছড়ে পড়ে ঋদ্ধির পিছনের পায়ে। আবেদনের আগেই উৎসব শুরু করে দেন উনাদকাট। কিন্তু আম্পায়ার নির্বাক শ্রোতা। আংশিক ডিআরএস-এ বল ট্র্যাকিং প্রযুক্তির অভাব বাঁচিয়ে দেয় ঋদ্ধিকে।

কিন্তু সুদীপ যেন অন্য ধাতু দিয়ে তৈরি। কোনও ঝড়ঝাপটা তাঁর উপর প্রভাব ফেলতে পারে না। তৃতীয় দিনের শেষ থেকে চতুর্থ দিনের দুপুর পর্যন্ত একই ছন্দে টানলেন বাংলাকে। তাঁর একটি করে ডিফেন্স যেন ক্রিকেট ব্যাকরণের প্রতিচ্ছবি। আউটসুইং দিলে ছেড়ে দিচ্ছেন। ইনসুইং আটকে দিচ্ছেন। অতিরিক্ত ঘূর্ণি তাঁকে পরাস্ত করতে পারছে না। স্লেজিংয়ে কান দিচ্ছেন না।

কী ভাবে সুদীপকে আউট করবে? উত্তর খুঁজে পাচ্ছিল না সৌরাষ্ট্র।

ঋদ্ধি ও সুদীপের জুটি টেঁকে ২৪৭ মিনিট। ২৯৪ বল খেলে যোগ করে মহামূল্যবান ১০১। এই বাইশ গজে যা দেড়শো রানের সমান। তাঁদের পরীক্ষা বিপক্ষের বোলারদের বিরুদ্ধে নয়। বিপক্ষের ধৈর্যের সঙ্গে।

লাঞ্চে তিন উইকেটের বিনিময়ে ২১৮ রান ছিল বাংলার। ৫৫ রানে ব্যাট করছিলেন ঋদ্ধি। ৭৭ রানে অপরাজিত ছিলেন সুদীপ। পরের দু’ঘণ্টায় ম্যাচের রং পাল্টে যায়। পিচের ক্ষত লক্ষ করে বল করা ধর্মেন্দ্রসিংহ জাডেজার একটি ডেলিভারি লাফিয়ে ওঠে। সুদীপের গ্লাভসে লেগে চলে যায় ফরোয়ার্ড শর্ট লেগে দাঁড়িয়ে থাকা বিশ্বরাজ জাডেজার হাতে। ৮১ রানে মাঠ ছাড়তে হয় মরসুমের শুরুতে দল থেকে বাদ পড়া বাঁ-হাতিকে। ঠিক ৯ ওভার পরেই ফিরে যান ঋদ্ধিমান (৬৪)। প্রেরক মাঁকড়ের রিভার্স সুইং তাঁর স্টাম্প ছুঁয়ে চলে যায় বাউন্ডারিতে। পালকের মতো মাটিতে পড়ে যায় বেল। মরসুমের সেরা আবিষ্কার শাহবাজ আহমেদও ব্যর্থ। ৩৯ বলে ১৬ রানের ক্যামিয়ো ইনিংস খেলে পরাস্ত চেতন সাকারিয়ার ইনসুইংয়ে। স্কোরবোর্ড বলছে ২৬৩-৬। তখনও ১৬২ রানে পিছিয়ে।

বাংলা শিবিরে তখন ট্রফি হাতছাড়া হওয়ার আশঙ্কা। নির্বাচক শুভময় দাস বলতে থাকেন, ‘‘এ বারও যেন রানার্স হয়ে ফিরতে না হয়!’’ হয়তো ভুলে গিয়েছিলেন, ক্রিজে অনুষ্টুপ রয়েছেন। কোয়ার্টার ফাইনাল, সেমিফাইনালে সেঞ্চুরি করে দলকে বিপন্মুক্ত করা ব্যাটসম্যান এত সহজে হাল ছাড়ার পাত্র নন। অরুণ লাল তো এমনি এমনি বলেননি, ‘‘অনুষ্টুপের চেয়ে বড় ক্রিকেটার বাংলায় কখনও আসেনি।’’

অর্ণব নন্দীকে পাশে নিয়ে শুরু হয় শেষ বারের মতো মান বাঁচানোর যুদ্ধ। ঘরের মাঠে নিজেদের পছন্দ মতো পিচ তৈরি করে বাংলাকে আটকানোর চেষ্টা না হয় করলই সৌরাষ্ট্র! কিন্তু তাঁরাও বুঝুক, এত সহজে হার মানতে শেখেননি ফেলুদা-ভক্ত। তদন্ত শেষ না হলে তিনিও যে মাঠ ছাড়বেন না।

দশ রানের মাথায় স্লিপে সহজ ক্যাচ পড়ে অনুষ্টুপের। জাডেজার বল বুঝতে না পেরে কাট করতে চলে যান। কিন্তু ভাগ্য যে সাহসীদেরই সঙ্গ দেয়। আর অনুষ্টুপ তো শুধু সাহসী নন। পোড় খাওয়া এক যোদ্ধা। যাঁর কাছে দলের সাফল্যই সব চেয়ে বড়। তাঁর ব্যাটে একটি করে রান, মুষড়ে পড়া বাঙালির মধ্যে জয়ের প্রদীপ জ্বেলে দিচ্ছে।

যখনই চাপ তৈরি করার চেষ্টা করছিল সৌরাষ্ট্র, বড় শট নিয়ে চাপ কমিয়ে দিচ্ছিল এই জুটি। শেষ ৮০ বলে ৫৯ রান করেছে বাংলা। চলতি ম্যাচে এ রকম রানের গতি কখনও দেখা যায়নি। সিলি পয়েন্ট ও ফরোয়ার্ড শর্ট লেগ নিয়ে বল করা জাডেজাকে স্টেপ আউট করে ছয় মেরে ‌দিলেন অর্ণব। অভিজ্ঞ বাঁ-হাতি স্পিনারের ঔদ্ধত্যে তা যেন এক থাপ্পড়ের সমান। ১৪০তম ওভারে জাডেজার প্রলুব্ধ করা বল সুইপ করে চার রান কুড়িয়ে লক্ষ্য কমিয়ে আনেন একশো রানের নীচে।

তখন থেকেই আত্মবিশ্বাস হারাতে শুরু করে সৌরাষ্ট্র। রীতিমতো ভয় পেতে শুরু করেন উনাদকাটরা। কোচ কার্সন ঘাউরি যদিও বলে গেলেন, ‘‘এখনও ম্যাচ ৫০-৫০। আমরা ঘাবড়াচ্ছি না।’’ যতই তিনি মুখে বলুন। ‘ক্ল্যাপ থেরাপি’ প্রয়োগ করে উৎসাহ ফেরানো দলের হাততালি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল অনুষ্টুপদের দাপটে। ৫৮ রানে অপরাজিত থাকা অনুষ্টুপ ও ২৮ রানে লড়াই করা অর্ণব তখন গম্ভীর হয়ে ড্রেসিংরুমে ফিরছেন।

ম্যাচের ফল কী হবে তা নির্ভর করবে পঞ্চম দিনের প্রথম দু’ঘণ্টার উপর। এই জুটি আরও ৩০ রান যোগ করতে পারলে ট্রফি জয়ের আশা আরও উজ্জ্বল হবে। যদিও আকাশ দীপ, ঈশান পোড়েল ও মুকেশ কুমারকে অঙ্কের বাইরে রাখা যাচ্ছে না। চতুর্থ দিন শেষ হলেও নেটে বিশেষ অনুশীলন শুরু হয় তাঁদের। টিকে থাকার লড়াই হয়তো এখান থেকেই শুরু। হবে নাই বা কেন। রঞ্জি জয়ের গন্ধ পাওয়া গিয়েছে যে!

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy