লক্ষ্যপূরণ: দক্ষিণ এশীয় গেমসে সোনার হ্যাটট্রিক ইতির। টুইটার
তিন বছর আগেই নিজের বিয়ে ঠেকিয়ে একটা যুদ্ধে জয়ী হয়েছিল তাবাসসুম খাতুন ইতি। বাংলাদেশের চুয়াডাঙ্গার মেয়ে এ বার আর একটা লড়াই জিতল। সেটা দক্ষিণ এশীয় গেমসে। সে দিনকার সেই ইতি এই প্রতিযোগিতায় ৩৫ বছরের ইতিহাস ভেঙে বাংলাদেশের হয়ে তিরন্দাজিতে তিনটি সোনা জিতে হইচই ফেলে দিয়েছে। নেপালের পোখরাতে চলা ১৩তম দক্ষিণ এশীয় গেমসের দলগত, মিক্সড ও ব্যক্তিগত তিরন্দাজি ইভেন্টে সোনা জেতে ১৪ বছর বয়সি ইতি।
চুয়াডাঙ্গা শহরের হোটেল শ্রমিক ইবাদত আলি ও আলেয়া খাতুনের তিন মেয়ের দ্বিতীয় ইতি। অপর দুই বোনের নাম ইভা ও স্মৃতি। তিন মেয়েকে নিয়ে সংসার চালাতে গিয়ে রীতিমতো হিমশিম খেতে হয়েছে বাবা ইবাদতকে। মেয়েদের স্কুলের খরচ জোগাতে না পেরে ইতিকে ২০১৬ সালে ১২ বছর বয়সেই বিয়ে দিতে উদ্যোগী হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়ায় ইতি নিজেই। সে দিনের সিদ্ধান্ত যে কত বড় ভুল ছিল, তা এখন অকপটে স্বীকার করেন ইতির বাবা। আনন্দবাজারকে তিনি বলেন, ‘‘আমার মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত ভুল ছিল। মেয়েকে প্রধানমন্ত্রীর হাতে তুলে দিলাম। তিনি যা ভাল মনে করবেন, এখন থেকে তা-ই হবে।’’
মেয়ের সাফল্যের কথা বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলেন ইবাদত। ভেজা গলায় বলেন, ‘‘অভাবের জ্বালায় ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময় ওর বিয়ের ব্যবস্থা করেছিলাম। কিন্তু ইতি সে দিন বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়। ওর এই প্রতিবাদ আমাদের চোখ খুলে দিয়েছিল।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘আমার মতো আর কোনও বাবা যেন তার সন্তানদের বাল্যবিবাহ দেওয়ার কথা না ভাবে।’’ ইতির মা আলেয়া খাতুনও মেয়ের সোনা জেতার খবরে আনন্দে আত্মহারা।
বাংলাদেশের তিরন্দাজির ইতিহাসে এই বিস্ময়বালিকা সে দিন যদি প্রতিবাদ করে পালিয়ে না যেত, তা হলে দক্ষিণ এশীয় গেমসে হয়তো নামাই হত না। পরিবারিক সূত্রে জানা গিয়েছে, তিরন্দাজিতে এতটাই ডুবে গিয়েছিল ইতি যে, মা-বাবার বকুনিকেও পরোয়া করত না। অনুশীলন শেষে একদিন বাড়ি ফিরে দেখে, বাবা তাকে বিয়ে দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। পাত্রপক্ষ বসে বাড়ির বারান্দায়। বিয়ের তাৎক্ষণিক সব আয়োজনও শেষ। শাড়ি পরে ঘোমটা মাথায় পাত্রপক্ষের সামনে গিয়ে দাঁড়ায় ইতি। পাত্রপক্ষের পছন্দও হয়ে যায় তাকে। কিন্তু শেষ মুহূর্তে সে বেঁকে বসায় বিয়েটা আর হয়নি।
জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের প্রতিভা অন্বেষণের আবিষ্কার ইতি। চুয়াডাঙ্গা স্টেডিয়ামে ২০১৬ সালে ডিসেম্বরে আর্চারির প্রাথমিক বাছাইয়ে প্রথম হয়েছিল সে। এর পরে বাংলাদেশের জাতীয় তিরন্দাজিতে ২০১৮ সালে প্রথম পদক পায়। তিরন্দাজ সংসদের হয়ে মেয়েদের রিকার্ভ ইভেন্টে ব্রোঞ্জ জিতেছিল চুয়াডাঙ্গার কিশোরী। দক্ষিণ এশীয় গেমসে ইতির সাফল্যে এ বার ভাসছে চুয়াডাঙ্গাবাসী। ইতির স্কুলশিক্ষক-সহ সহপাঠীরা তাঁর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। ইতির স্থানীয় কোচ সোহেল আকরাম বলেন, ‘‘প্রথম দিনই আমার মন কেড়েছিল ইতি। আমি সে-দিনই ওর মধ্যে বড় খেলোয়াড় হওয়ার সম্ভাবনা দেখেছিলাম। আজ আমার সে স্বপ্ন পূর্ণ হয়েছে।’’
চুয়াডাঙ্গা ঝিনুক মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয় থেকে চলতি বছর জেএসসি (জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট) পরীক্ষা দিয়েছে ইতি। বিদ্যালয়ের ক্রীড়াশিক্ষক শামসুন্নাহার শীলার কথায়, ‘‘আমাদের ছাত্রীর সোনা জয়ের খবরে দারুণ খুশি। ও শুধু চুয়াডাঙ্গার নয়, গোটা দেশের গর্ব।’’ শীলা আরও জানান, ‘‘বিদ্যালয়ের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার ১০০ মিটার দৌড় ইভেন্টে প্রথম হওয়ার পরে ইতির কাছে জানতে চেয়েছিলাম আর কী কী খেলা ওর পছন্দের। জবাবে ইতি জানিয়েছিল, হ্যান্ডবল, ভলিবল, ক্রিকেট, ফুটবল ও ব্যাডমিন্টন খেলতে পারে। শুনে বেশ অবাক হয়েছিলাম। আসলে সব খেলাতেই ওর পারদর্শিতা রয়েছে।’’
দক্ষিণ এশিয়ান গেমসে বাংলাদেশের সাফল্যে উচ্ছ্বসিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নেপালে পদক জয়ীদের ইতিমধ্যে অভিনন্দন জানিয়েছে তিনি। আমন্ত্রণ জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাড়ি গণভবনে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘‘সবাইকে আমার আন্তরিক অভিনন্দন। বাংলাদেশের সুনাম বৃদ্ধিতে আমি খুব খুশি। গণভবনে সবার দাওয়াত থাকল।’’
এ বারের এশিয়ান গেমসের পদক জয়ীদের জন্য রয়েছে আর্থিক পুরস্কার। গেমস শুরু হওয়ার আগেই এ কথা জানিয়েছিল যুব ও ক্রীড়ামন্ত্রী। ব্যক্তিগত ইভেন্টে সোনা জয়ীকে দেওয়া হবে ৬ লাখ টাকা। রুপো ও ব্রোঞ্জ জয়ী পাবেন ৩ লাখ ও ১ লাখ টাকা করে। পাশাপাশি ইতি-কে বিশেষ সংবর্ধনা জানানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে চুয়াডাঙ্গা প্রশাসন ও জেলা ক্রীড়া সংস্থা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy