নায়ক: অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ হাতে অধিনায়ক আকবর। ফাইল চিত্র
আর দশটা দিনের মতোই নিয়ম মেনে পূব দিগন্তে দেখা দিয়েছে সূর্য...
না, না তা কী করে হয়?
বাংলাদেশের জন্য সোমবারের ভোর নিশ্চয়ই আর পাঁচটা দিনের মতো হয়নি। এমন ভোর আগে কখনও হয়েছে নাকি? যখন বাংলাদেশের মানুষ ঘুম থেকে উঠেছে এক অবর্ণনীয় অনুভূতি নিয়ে যে, আমরা বিশ্বচ্যাম্পিয়ন!
হোক না সে অনূর্ধ্ব উনিশের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন। হোক না সে যুব বিশ্বকাপ জয়! তবু বিশ্বজয়ই তো বটে। বহু দূরের দক্ষিণ আফ্রিকান শহর পোচেস্ট্রুমের নামই হয়তো এর আগে শোনেননি বাংলাদেশের অনেকেই। ৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ থেকে সারা জীবনের জন্য মনের মধ্যে গেঁথে থাকবে এই নাম। ১৯৯৭ সালে আইসিসি ট্রফি জিতেছিল বাংলাদেশ। সেটাই ছিল ক্রিকেটে প্রথম বড় সাফল্য। কুয়ালা লামপুরের কিলাত ক্লাব মাঠ যেমন বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে বরাবরের মতো জায়গা করে নিয়েছে, তেমনই আজীবন খোদাই হয়ে থাকবে পোচেস্ট্রুমে সেনওয়েস পার্কের নামও।
আরও পড়ুন: ‘গো ব্যাক’ ধ্বনি ওঠে উঠুক, দর্শন বদলাব না
বিশ্ব মানচিত্রে আইসিসি পরিচালিত কোনও প্রতিযোগিতায় প্রথম বার চ্যাম্পিয়ন হল বাংলাদেশ। শুধু ক্রিকেটের সীমানাতে আটকে থাকা কেন, যে কোনও খেলাতেই তো প্রথম বিশ্বজয়। বাংলাদেশ যে রবিবার রাতে উৎসবের দেশ হয়ে উঠেছিল, তাতে আর আশ্চর্যের কী! ২৩ বছর আগে আইসিসি ট্রফি জেতার সময় রাস্তায় মানুষের ঢল নেমে এসেছিল। সে রকম মিছিল হয়তো এ বার দেখা যায়নি। তবে সর্বত্র জয়ের ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়তে সময় নেয়নি। রকিবুলের ব্যাট থেকে জয়ের রানটি আসার পরেই ঘরে-ঘরে ‘বাংলাদেশ, বাংলাদেশ’ বলে জয়ধ্বনি উঠতে থাকে। বাংলাদেশের ক্রিকেটে যে কোনও সাফল্য উদযাপনের কেন্দ্রবিন্দু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি-তে তরুণ প্রজন্মের উল্লাস, সোশ্যাল মিডিয়ায় আকবর আলিকে অভিনন্দনের বন্যায় ভাসিয়ে দেওয়া— সব মিলিয়ে স্বপ্নপূরণের রামধনু রং তৈরি হয়েছে।
আরও পড়ুন: ফেরার পথে উইলিয়ামসন, সুযোগ পাবেন কি ঋষভরা
দেখেশুনে মনে হচ্ছে, উৎসবের আমেজ বাড়িয়ে দিয়েছে মহানাটকীয় ফাইনাল। পেন্ডুলামের মতো দুলেছে দু’দলের ভাগ্য। আর নাছোড় ভঙ্গিতে লড়াই করে ম্যাচ বার করে নিয়ে আসা গিয়েছে বলেই হয়তো উৎসবের আমেজ আরও বেশি উপভোগ করা যাচ্ছে। পরাক্রমশালী ভারতকে মাত্র ১৭৭ রানে শেষ করে দেওয়া যাবে, কে ভেবেছিল! তার পরেও তো একটা সময় রবি বিষ্ণোইয়ের বিষাক্ত গুগলিতে সব শেষ হতে বসেছিল! বাংলাদেশ চলে গিয়েছিল খাদের কিনারায়। কিন্তু তাদের এক জন আকবর আলি ছিলেন। তিনিই ম্যাচে ফিরিয়ে আনেন দলকে। ক্রিজে যাঁর স্থিতধি, নিষ্পন্দ উপস্থিতি দেখে এক বারও প্রশ্ন জাগেনি, ‘‘পথিক তুমি কি পথ হারায়েছ?’’ যেন প্রশ্ন নয়, উত্তর সঙ্গে নিয়ে ক্রিজে এসেছিলেন বাংলাদেশ অধিনায়ক। অপরাজিত ৪৩ রানের এই ইনিংসের মূল্যায়ন শুধু রানসংখ্যা দিয়ে কখনও করা যাবে না।
সকালে উঠে বাংলাদেশের এক সংবাদপত্রে শিরোনাম দেখলাম, ‘আকবর দ্য গ্রেট’। হয়তো সেটাই বাংলাদেশের অধিনায়কের লড়াইকে সম্মান জানানোর উপায়। সেই আকবর আলি, যিনি টুর্নামেন্টের মাঝপথে তাঁর প্রিয় দিদির মৃত্যুসংবাদ পেয়েছেন। চার ভাইয়ের ওই একটিই মাত্র বোন। সবার ছোট আকবরের প্রতিই সব চেয়ে স্নেহপ্রবণ ছিলেন যিনি। যমজ সন্তানের জন্ম দিয়ে সেই দিদি হারিয়ে গেলেন চিরতরে। আকবরের পরিবার সিদ্ধান্ত নেয়, ছেলে দূরদেশে গিয়েছে দেশের স্বপ্নপূরণ করতে, তাই এমন মর্মান্তিক দুঃসংবাদ এখন তাঁকে না-দেওয়াই ঠিক হবে। কিন্তু আকবর কী ভাবে যেন ঠিক জেনে যান। বাড়িতে ফোন করে কান্নায় ভেঙে পড়ে অনুযোগ করেন, কেন তোমরা আমাকে খবর দাওনি?
চোখ মুছতে মুছতে তখনই কি আকবর প্রতিজ্ঞা সেরে নিয়েছিলেন নিজের মধ্যে যে, দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে দিদির জন্য বিশ্বজয়ের ট্রফি নিয়ে ফিরব? রবিবার রাতে সেনওয়েস পার্কের নৈশালোকে জ্বলজ্বল করছিল আকবরের সেই প্রতিজ্ঞা। মনে করিয়ে দিচ্ছিল বাবাকে হারিয়েও বুকের ভিতরে কান্না চেপে বিশ্বকাপে সচিন তেন্ডুলকরের সেই ব্রিস্টল সেঞ্চুরির কথা। রঞ্জি ট্রফির মাঝে বাবাকে হারিয়ে খেলা চালিয়ে গিয়ে দিল্লিকে বাঁচিয়েছিলেন বিরাট কোহালি। এ বার ক্রিকেটের লোকগাথায় ঢুকে পড়ল যোদ্ধা আকবরের লড়াইও।
এতটা মর্মস্পর্শী না হলেও আকবরের সতীর্থদের জীবনেও কোনও না কোনও কাহিনি রয়েছে। কেউ উঠে এসেছেন অজ পাড়া-গাঁ থেকে, কারও সংসারে হাতে ধরা ব্যাটই হল সোনার হরিণ। বাংলাদেশের এই অনূর্ধ্ব উনিশ বিশ্বজয়ও এক দিনে সম্ভব হয়নি। প্রায় দু’বছরের সাধনার ফল এই জয়। ফাইনালের আগের দিন আইসিসি ওয়েবসাইটকে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন ওপেনার প্রান্তিক নওরোজ নাবিল। বিশ্বকাপে একটাও ম্যাচ খেলেননি। কিন্তু তা নিয়ে হতাশার কোনও ছাপই ছিল না তাঁর চোখেমুখে। এই তরুণ ছেলেরা যে ‘সবার আগে দল’ মন্ত্রে দীক্ষিত। এর আগে আর কোনও বাংলাদেশ দল কখনও এতটা প্রস্তুতি নিয়ে অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপে খেলতে যায়নি। সঠিক প্রস্তুতিই যে সাফল্যের চাবিকাঠি, সেই শিক্ষালাভ করাটা ট্রফির মতোই এক বড় প্রাপ্তি। ফাইনালে ভারতকে হারানো নিঃসন্দেহে বাড়তি আনন্দ যোগ করেছে। আর তার কারণ খুব সহজ। বড়দের ক্রিকেটে অস্ট্রেলিয়ার যে রকম ইতিহাস, যুব বিশ্বকাপে ভারতও তেমনই এক মহাশক্তি। চার বারের চ্যাম্পিয়ন, দু’বারের রানার্স। এ বার নিয়ে টানা তিন বার ফাইনাল খেলল। গত কয়েক বছর বড়দের ক্রিকেটে ভারত বনাম বাংলাদেশ নতুন এক প্রতিদ্বন্দ্বিতার নাম। তার আঁচ রবিবার যুব ফাইনালেও দেখা গিয়েছে। ম্যাচ শেষ হওয়ার পরে অপ্রীতিকর ঘটনায় জড়িয়ে পড়েছে দু’দল।
কিন্তু সেই সময়েও শান্ত, ধীরস্থির দেখিয়েছে এক জনকে। ক্রিজের মতো বিশ্ব জয়ের আনন্দের মধ্যেও যিনি নিয়ন্ত্রণ হারাননি— আকবর আলি।
সত্যিই ‘আকবর দ্য গ্রেট!’
(লেখক বাংলাদেশের নামী ক্রীড়া সাংবাদিক। পঁচিশ বছরের উপরে নিজের দেশের নানা প্রজন্মের ক্রিকেট দলের সঙ্গে একাধিক সফরে গিয়ে রিপোর্ট করার অভিজ্ঞতা রয়েছে।)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy