প্রতিযোগিতা: চলছে দোহায়। নিজস্ব চিত্র
অণু রানি জাতীয় পর্যায়ে রেকর্ডধারী। জ্যাভেলিন থ্রোয়ার তিনি। এবার কাতারের দোহায় ওয়ার্ল্ড অ্যাথলেটিক্স চ্যাম্পিয়নশিপে যোগ দিয়েছিলেন। আমি এবং আমার এক ছাত্র অণুর ইভেন্টের সময়ে স্টেডিয়ামে ছিলাম। ছিলেন আরও বহু ভারতীয়। আদতে তাঁরা কেরল, তামিলনাড়ু, পঞ্জাবের বাসিন্দা। কর্মসূত্রে কাতারে থাকেন। দল বেঁধে স্টেডিয়ামে জাতীয় পতাকা হাতে বসেছিলাম। অণু রানির প্রতিটি থ্রোয়ের সময়ে প্রবল চিৎকার করে, পতাকা নাড়িয়ে ওঁকে উৎসাহ দিয়েছি। কিন্তু কাজ হয়নি। আমার মনে হয়েছে, কোয়ালিফায়িং রাউন্ড পর্যন্ত বেশ উৎসাহ ছিল অণুর। কিন্তু পরের দিন ফাইনাল পর্যায়ে যখন এলেন তখন আর সেই উৎসাহ, আত্মবিশ্বাসের ছিটেফোঁটাও নেই। একটাও ভাল থ্রো করতে পারেননি। কোয়ালিফায়িং রাউন্ডে জাতীয় পর্যায়ে রেকর্ড করেছিলেন। কিন্তু ফাইনালে তার কাছাকাছিও থ্রো করতে পারেননি। তবে জ্যাভেলিনে ভারত থেকে কেউ ফাইনালে উঠলেন এই প্রথম।
ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব অ্যাথলেটিক্স ফেডারেশনের (আইএএএফ) ১৭তম প্রতিযোগিতা হল কাতারের রাজধানী দোহাতে। ২৭ সেপ্টেম্বর থেকে ৬ অক্টোবর পর্যন্ত এই ১০ দিনের প্রতিযোগিতার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলাম। এই প্রতিযোগিতা পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম ‘মেগা শো’ হিসেবে পরিচিত। গুরুত্ব হিসেবে প্রথম হল অলিম্পিক গেমস। দ্বিতীয় ফিফা ওয়ার্ল্ড কাপ। এই প্রতিযোগিতা মধ্য-পূর্ব এশিয়ায় প্রথমবার আয়োজিত হল। ফিনল্যান্ডের রাজধানী হেলসিঙ্কিতে প্রতিযোগিতা প্রথম শুরু হয়েছিল ১৯৮৩ সালে। ২১০টি দেশের ২০৪৩ জন প্রতিযোগী ৪৯টি ইভেন্টে ১৯২টি পদকের জন্য ১০ দিন ধরে লড়াই করেন। ভারত থেকে ২৫ জন প্রতিযোগী যোগ দেন।
প্রথম প্রতিযোগিতার পরিচালন ব্যবস্থার কথা বলি। বিভিন্ন দেশের ২৪টি গোষ্ঠীর জন্য ‘ফ্যান জোন’এর ব্যবস্থা ছিল। সেখানে বিভিন্ন দেশের ঐতিহ্যবাহী নৃত্য-গীতের ব্যবস্থা ছিল। আমি তখন স্টেডিয়ামে ঢুকছি। কানে এল ‘জয় হো’ গানটি বাজছে। এ ছাড়া দর্শকদের জন্যও প্রতিযোগিতার আয়োজন ছিল। আমি তো স্যাক রেসে যোগ দিয়ে প্রথম হয়েছি। পেয়েছি দোহা চ্যাম্পিয়ানশিপের স্মারক, টি-শার্ট, কোর্ট পিন ইত্যাদি। ছিল বিভিন্ন দেশের খাবারের স্টল। দেখলাম ফুচকার ব্যবস্থাও করা হয়েছে।
আয়োজন নিয়ে কিছু বলার নেই। ৩৬৯০ জন নথিভুক্ত স্বেচ্ছাসেবী, ৩০ জন আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবী এবং আইএএএফ অনুমোদিত পরীক্ষায় পাশ করা অফিশিয়ালেরা প্রতিযোগিতা নিখুঁত ভাবে সম্পন্ন করতে কাজ করে গিয়েছেন। সুষ্ঠু পরিবহণ ব্যবস্থা। প্রতিযোগী, অফিসিয়াল এবং স্বেচ্ছাসেবকদের যথাযথ স্থানে পৌঁছনোর ব্যবস্থা ছিল নিখুঁত। খলিফা ইন্টার ন্যাশানাল স্টেডিয়াম বিশ্বের অ্যাথলেটিক্স জগতের একটি অন্যতম স্টেডিয়াম। আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার, লাইট অ্যান্ড সাউন্ডের মাধ্যমে অ্যাথলিটদের পরিচয় পর্ব এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। দোহাতে তাপমাত্রা ছিল ৩৮-৪০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। কিন্তু অনুভূত হচ্ছিল ৫০-৫২ ডিগ্রি। অথচ স্টেডিয়ামের ভেতর তামপাত্রা ২৩-২৭ ডিগ্রি। প্রত্যেক দিন শেষ দু’একটি ইভেন্টে স্টেডিয়ামের আলো নিভিয়ে ট্র্যাকের উপর বিভিন্ন বর্ণের আলো দিয়ে খেলোয়াড়দের মুখ, নাম, দেশের পতাকা দিয়ে খেলোয়াড়দের পরিচয় পর্বের পর আবার স্টেডিয়াম আলোকিত করে ইভেন্ট শুরু করা যেন এক মায়াবী পরিবেশ তৈরি করছিল। এবার সব চেয়ে কম বয়সের প্রতিযোগী ছিলেন নাইজেরিয়ার ফেভার ওফিলি। বয়স ১৬ বছর ২৭৩ দিন। ৪০০ মিটার দৌড়ে অংশ নেন। প্রবীণতম প্রতিযোগী স্পেনের ৪৯ বছর ৩৪৬ দিনের জেসাস অ্যাঞ্জেল গার্সিয়া। তিনি ৫০ কিলোমিটার হাঁটায় অংশ নিয়েছিলেন।
এবারের প্রতিযোগিতায় ব্যক্তিগত ইভেন্টে দু’টি সোনা পেয়েছেন নেদারল্যান্ডের মহিলা অ্যাথলিট সাফিন হাসান। তিনি ১৫০০ মিটার ও ১০০০০ মিটার ইভেন্টে পদক পেয়েছেন। ১০০ মিটার হার্ডলসে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের নিয়া আলি ১২.৩৪ সেকেন্ড সময় করে সোনা জেতেন। তাঁর স্টার্টিং যেমন সঠিক তেমনই তাঁর হার্ডল ক্লিয়ারেন্স। চুলের স্টাইলও বর্ণময়। তাঁর ৪ বছরের পুত্র এবং ২ বছরের কন্যাকে কোলে নিয়ে আমেরিকার পতাকা গায়ে জড়িয়ে ভিকট্রি ল্যাপ সকলের মন জয় করে নিয়েছে। সকলেই উঠে দাঁড়িয়ে করতালি দিয়ে তাঁকে অভিনন্দন করেন। সে এ আবেগ ঘন মুহূর্ত। ৪০০ মিটার হার্ডলসে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের ডালিলাহ মহম্মদ নিজেরই বিশ্ব রেকর্ড ভেঙে ৫২.১৬ সেকেন্ড সময় করে নতুন রেকর্ড করেছেন। এর জন্য কাতার ন্যশনাল ব্যাঙ্ক তাঁকে এক লক্ষ ডলার পুরস্কার দিয়েছে।
আয়োজক দেশ কাতার একটি ছোট্ট দেশ। লোকসংখ্যা ৫ লক্ষেরও কম। তাঁদেরও মহম্মদ বার্সিম ২.৩৭ মিটার উচ্চতা লাফিয়ে হাইজাম্পে সোনা পেয়েছেন এ ছাড়াও ৪০০ মিটার হার্ডলসে আরও একজন প্রতিযোগী তৃতীয় স্থান পেয়েছেন। অথচ আমাদের দেশ ১২৫ কোটির ভারত শুধুই হতাশ করেছে। ভারতের ২৫ জন প্রতিযোগীর মধ্যে অণু রানিই জ্যাভলিন থ্রোতে কোয়ালিফায়িং রাউন্ডে ৬২.৪৩ মিটার থ্রো করে নতুন জাতীয় রেকর্ড স্থাপন করেছেন। কিন্তু ফাইনালে অষ্টম স্থানে শেষ করেছেন। কিছুটা লড়াই করেছেন অবিনাশ সাবলে। ট্রিপল চেজ তিন হাজার মিটারে যোগ দেওয়া অবিনাশ তিনবার ধাক্কাধাক্কিতে পড়ে যান। তা না হলে আরও ভাল ফল করতে পারতেন। হিটেই সপ্তম স্থানে শেষ করেন। ফলে তিনি ফাইনালে পৌঁছতে পারেননি। তিনি এই হিটের সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২০ সালে টোকিও অলিম্পিক গেমসে যোগদান করার সুযোগ পেয়েছেন। তবে ওঁকে দেখে মনে হয়েছে, বিশ্ব পর্যায়ে নিজেকে তুলে ধরতে পারবেন সুযোগ পেলে। লড়াই করার ক্ষমতা রয়েছে। ৪x৪০০ মিটার রিলেতে ভারতের মেয়েদের দল সপ্তম স্থানে শেষ করেছেন। প্রথম ও শেষ ল্যাপের প্রতিযোগীরা ভাল দৌড়েছেন। মাঝের প্রতিযোগীরা আরেকটু চেষ্টা করলে আরও ভাল ফল হত। জিনসন জনসনের ১৫০০ মিটার দৌড়ে হতাশজনক ফল। সব মিলিয়ে ভারতের অ্যাথলেটিক্স দলের বিশ্ব পর্যায়ে শোচনীয় অবস্থা।
পরিচালনার দিক থেকে বিচার করলে ভারত খুব একটা পিছিয়ে নেই। উদাহরণ ক্রিকেট, মেয়েদের ফুটবল বিশ্বকাপের সফল আয়োজন। তবে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে এখনও অনেক পিছিয়ে। ভারতের অ্যাথলেটিক্সের উন্নতির জন্য অ্যাথলিটদের প্রথমেই চাই সিন্থেটিক ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডে অনুশীলন। অথচ আমাদের এটাই অপ্রতুল। আমাদের পশ্চিমবঙ্গে মাত্র দু’টো সিন্থেটিক ট্র্যাক রয়েছে। বিবেকানন্দ যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গন এবং সাই। তা-ও সকলে অনুশীলন করার সুযোগ পান না। আইএএফ অনুমোদিত ওয়েস্ট বেঙ্গল অ্যাথলেটিক্স অ্যাসোসিয়েশনের নির্দিষ্ট কোনও স্থায়ী ঠিকানা নেই। অনুশীলন ও প্রতিযোগিতার জন্য নিজস্ব কোন মাঠ নেই। প্রতিভাবান অ্যাথলিটদের ট্রায়াল বা প্রতিযোগিতা আয়োজনের মাধ্যমে নির্বাচন করে উচ্চ পর্যায়ের আবাসিক প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য খেলোয়াড়দের গুণমান অনুযায়ী উচ্চ জ্ঞান সম্পন্ন প্রশিক্ষক প্রয়োজন। জেলায় জেলায় সিন্থেটিক ট্র্যাক যুক্ত পরিকাঠামো অবশ্যই প্রয়োজন। সঙ্গে উন্নতমানের স্পোর্টস মেডিসিন সেন্টার ও স্পোর্টস মেডিসিন পার্সোনাল নিয়োগ করতে হবে। খেলোয়াড়দের কর্মজীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ তৈরি করতে হবে। পুরস্কার ও তিরস্কার পদ্ধতি অবশ্যই প্রয়োজন। নির্দিষ্ট সময় অন্তর কাজ ও দক্ষতার মূল্যায়ন করে নতুন নতুন পরিকল্পনা করে কাজে লাগাতে হবে। বিদেশের মাটিতে অ্যাথলিটদের পর্যাপ্ত পরিমাণে প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার সুযোগ দিতে হবে। এবার বহু দেশই কাতারে আগেভাগে পৌঁছেছিল। আবহাওয়ার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে। ভারত কিন্তু বেশি আগে যায়নি। ‘স্পোর্টস সকলের জন্য’ এই স্লোগান নিয়ে সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাকে উদ্যোগী হতে হবে। বয়স ভাঁড়িয়ে প্রতিযোগিতায় অংশ নিলে কঠোর ভাবে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
একটা কথা বলতেই হবে, বিশ্ব পর্যায়ে সক্ষমতার যে স্তর তাতে ভারত অনেক পিছিয়ে। ঘাটতি রয়েছে মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকেও। সাফল্য পেতে হলে এই বিষয়ে ভাবা দরকার।
লেখক পণ্ডিত রঘুনাথ মুর্মু গভর্মেন্ট কলেজের শারীরশিক্ষার বিভাগীয় প্রধান ও অ্যাথলেটিক্স বিশেষজ্ঞ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy