রাজসিক: জোড়া সেঞ্চুরিতে বাজিমাত ওয়ার্নার (বাঁ দিকে) এবং ফিঞ্চের। পিটিআই, এএফপি
দেশের মাঠে বিরাট কোহালির দলের বিজয়রথ হ্যাঁচকা টানে থামিয়ে দিল অ্যারন ফিঞ্চের অস্ট্রেলিয়া। এমনই শাসকের ভঙ্গিতে দশ উইকেটে ডেভিড ওয়ার্নারেরা দুরমুশ করলেন ভারতকে যে, দেশের মাঠে এক দিনের ক্রিকেটে শেষ কবে এমন লজ্জার হারের চাবুক আছড়ে পড়েছে, পুরনো সেই সব রেকর্ড দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন সকলে।
একটা ম্যাচই মনে করা যাচ্ছে। ২০০৫-এর ইডেন। ভারতীয় দলের অধিনায়ক তখন রাহুল দ্রাবিড়, কোচের নাম গ্রেগ চ্যাপেল। কোনও এক সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় দল থেকে ব্রাত্য। ইডেনে গুরু গ্রেগকে সবুজ পিচ উপহার দেন প্রয়াত কিউরেটর প্রবীর মুখোপাধ্যায়। আর সবুজ উইকেটের সুবিধা তুলে গ্রেম স্মিথের দল দশ উইকেটে উড়িয়ে দেয় ভারতকে। শন পোলক, আন্দ্রে নেলদের সামনে ১৮৮ রান সাবাড় হয়ে যান দ্রাবিড়রা।
সেই ম্যাচে তা-ও কঠিন প্রশ্নপত্রের মুখে পড়তে হয়েছিল ভারতকে। শোনা যায়, কলকাতা থেকে ফ্লাইটে উঠে কোনও কোনও ক্রিকেটার বলেছিলেন, যাক বাবা, বিদেশ ছাড়লাম! তেমন কোনও ‘আতিথেয়তা’ ওয়ার্নারদের দিকে বাড়িয়ে দেয়নি মঙ্গলবারের ওয়াংখেড়ে। এখানে যেমন সুন্দর পিচ হয়, তেমনই ছিল। তাতেও ভারতীয় ব্যাটিংয়ের পা হড়কে গেল। তার পরে বোলিং দেখে মনে হল, অ্যানিমিয়ায় ভুগছে। সব চেয়ে চোখে লাগার মতো, গোটা দলের শরীরী ভাষা। ম্যাচ শেষ হওয়ার অনেক আগে থেকে দুমড়ানো-মুচড়ানো মনে হল। সেই চনমনে, হার-না-মানা মনোভাবটাই দেখা গেল না, যা কোহালি জমানার সেরা সম্পদ।
আরও পড়ুন: এক দিনের খেলার পাল্লা ভারি কার দিকে, কী বলছে রেকর্ড?
ভারতের ঘসটাতে ঘসটাতে তোলা ২৫৫ রান তুড়ি মেরে তুলে দিলেন দুই অস্ট্রেলীয় ওপেনার ডেভিড ওয়ার্নার এবং অ্যারন ফিঞ্চ। দু’এক বার উল্টোপাল্টা ডিআরএসের ধুকপুকানি ছাড়া তাঁদের কপালে ন্যূনতম ভাঁজও লক্ষ্য করা যায়নি। বরং জুটিতে দেড়শো উঠতেই দেখা গেল, অনেকে স্ট্যান্ড ছেড়ে নীচে নামতে শুরু করেছেন। শামি, শার্দূল, কুলদীপ— মুম্বইয়ের বড়া পাও উপহার দিয়ে চললেন। আর মনের সুখে তা খেয়ে গেলেন অতিথিরা। এমনকি, বুম বুম বুমরাকে পর্যন্ত পথ হারানো পথিক মনে হল। নাকি চোটের ধাক্কা কাটিয়ে পুরনো ফিটনেসে এখনও ফেরেননি তিনি? এই সিরিজের বাকি দুই ম্যাচ দেখলে হয়তো আরও পরিষ্কার হবে।
২৫৫ নিশ্চয়ই ওয়াংখেড়ের পিচে জেতার গ্যারান্টি কার্ড দেয় না। কিন্তু একটা লড়াই তো অন্তত করা যায়। সেটাই বা দেখা গেল কোথায়? সাড়ে আটটার মধ্যেই ‘শো’ শেষ। ভয় ধরানো সব তথ্য আর সংখ্যা পড়ে থাকল। ওয়ার্নার ১১২ বলে ১২৮। ফিঞ্চ ১১৪ বলে ১১০। স্টিভ স্মিথকে নামতেই হল না। প্যাট কামিন্সের বাউন্সারে হেলমেটে লাগা ঋষভ পন্থ ফিল্ডিং করতে নামতেই পারলেন না। কিপিং করতে হল কে এল রাহুলকে। ম্যাচ কোথায় ছিল? মুম্বই না মেলবোর্নে? অস্ট্রেলীয় শাসন দেখে গুলিয়ে যাচ্ছিল।
দু’টো ব্যাপার আলাদা করে বলতেই হবে। এক) অ্যারন ফিঞ্চের অধিনায়কত্ব। কোহালির বিরুদ্ধে যখন সবাই ভাবছে ফাস্ট বোলারদের এগিয়ে দেবেন, নিয়ে এলেন তরুণ লেগস্পিনার অ্যাডাম জ়াম্পাকে। যিনি এর আগে কোহালিকে তিন বার আউট করেছেন। হাফভলিতে প্রলুব্ধ করে ভারত অধিনায়ককে কট অ্যান্ড বোল্ড করলেন জ়াম্পা। তার আগে রাহুল-ধওয়ন ভাল শুরু করার পরেও হাল ছাড়েননি ফিঞ্চ। বোঝাই যাচ্ছে, রীতিমতো হোমওয়ার্ক করে এসেছেন। রাহুল-ধওয়নের স্কোরিং অঞ্চলগুলো বুঁজিয়ে দিতে থাকলেন। দুই) মিচেল স্টার্কের বোলিং। প্রথম স্পেলে মার খেলেও পরে ফিরে এলেন দুর্দান্ত ভাবে। রোহিতকে তুললেন যে বলটায় তার গতি ছিল ঘণ্টায় ১৪৮ কিলোমিটার। এর পর শ্রেয়স আইয়ারকে তুলে নিলেন। সব মিলিয়ে ভারতে তাঁর দ্বিতীয় ওয়ান ডে ম্যাচে নিয়ে গেলেন তিন উইকেট। প্যাট কামিন্স তুলে নিলেন ধওয়ন আর ঋষভ পন্থের উইকেট।
ভারতীয় বোলারদের মধ্যে সব চেয়ে কম রান দিলেন রবীন্দ্র জাডেজা। ৮ ওভারে ৪১। শামি ৭.৪ ওভারে ৫৮। বুমরা ৭ ওভারে ৫০। অস্ট্রেলিয়া ইনিংস শুরুর সময় বেশ জোরে হাওয়া দিচ্ছিল। আরব সাগর সংলগ্ন ওয়াংখেড়েতে বরাবর পেসাররা সুইং পেয়েছেন। কিন্তু শামি, বুমরারা তার ফায়দা তুলতে পারলেন না। কুলদীপ দিলেন ১০ ওভারে ৫৫। তাঁর চায়নাম্যান, গুগলি সবই ধরে ফেললেন ওয়ার্নাররা। সেটা আরও চিন্তার কারণ। রহস্য আর রহস্য থাকছে না যে!
টি-টোয়েন্টি খেলে অভ্যস্ত শার্দূল ঠাকুরকে কী করে পঞ্চাশ ওভারের ওয়ান ডে-র জন্য বাছা হল, সেটা অবশ্য রহস্যই থেকে যাচ্ছে! অথচ, গতি ও বৈচিত্রে সকলকে মুগ্ধ করা নবদীপ সাইনি বাইরে বসে থাকলেন। দল নির্বাচন সংক্রান্ত প্রশ্ন আরও আছে। কোহালির ব্যাটিং অর্ডার পাল্টানোর সিদ্ধান্ত কার? যদি তাঁর নিজের হয়, তা হলে এখনই হেড কোচ রবি শাস্ত্রীর উচিত তাঁর অধিনায়ককে বলা, ‘‘শোনো, আমরা এখানে মহানুভবতা দেখাতে আসিনি। জিততে এসেছি। তুমি তিন নম্বরেই যাবে। কারণ, ওয়ান ডে-তে তুমি আর রোহিতই আমাদের প্রধান ব্যাটসম্যান। তোমাদের ব্যাটিং অর্ডার একই থাকবে, তার পরে বাকিটা দেখা যাবে।’’ ঠিক যেমন সচিন ওয়ান ডে ক্রিকেটে ভারতের হয়ে ওপেন করতেন। সৌরভ শুরুতে যেতেন। সহবাগ ওপরের দিকে নামতেন। চার নম্বরে নেমে কোহালি চরম ব্যর্থ। কখনও রান পাননি। এ দিনও ১৪ বলে ১৬ রানের বেশি হল না।
শিখর ধওয়নকে নিয়েও কঠিন সিদ্ধান্তের লগ্ন উপস্থিত। তাঁর ৯১ বলে ৭৪ এখনকার ওয়ান ডে ক্রিকেটের ধাঁচে বেশ মন্থর ইনিংস। ওয়াংখেড়েতে কাউকে কাউকে গজগজ করতে শোনা গেল, ‘‘দলে জায়গা নিয়ে চাপে আছে। তাই স্বার্থপরের মতো ব্যাটিং করে গেল।’’ ভারতীয়রা প্রথম দশ ওভারের পাওয়ার প্লে-তে এক উইকেট হারিয়ে তুললেন ৪৫ রান। আর অস্ট্রেলিয়া প্রথম দশ ওভারে তুলল ৮৪। সেই বিশ্বকাপ থেকে প্রথম পাওয়ার প্লে-তে এই ঠুকঠুক চালু হয়েছে। বিশ্বকাপ হাত থেকে গলে যাওয়ার পরেও রোগ সারানোর লক্ষণ নেই!
৩৭.৪ ওভারেই রান তুলে নিল অস্ট্রেলিয়া। মানে খেলার ১২.২ ওভার বাকি থাকতেই জয়। দেশের মাঠে ওয়ান ডে-তে কুৎসিততম হারগুলোর একটা লেখা থাকল আরব সাগরের পাড়ে। কোথায় মেরিন ড্রাইভ ধরে বিজয়োৎসব করতে করতে ফিরবেন ক্রিকেট ভক্তেরা, না বিষণ্ণ হৃদয়ে মাঠ ছাড়তে হল! ২০১১ নয়, যেন ১৯৮৭ বিশ্বকাপের ওয়াংখেড়ে। যে দিন মাইক গ্যাটিং সুইপ মেরে ভারতের বিশ্বকাপ স্বপ্ন ভাসিয়ে দিয়েছিলেন আরব সাগরের জলে।
কোহালিকে ম্যাচের পরে দেখে মনে হল, চাবুকের ঘায়ে রক্তাক্ত। মুখের জ্যামিতি বলে দিচ্ছে, এমন লজ্জার হার তীব্র ভাবে আঘাত করেছে। অন্য দিকে, ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরি জেগে উঠেছে। দক্ষিণ আফ্রিকায় বল-বিকৃতি কেলেঙ্কারির পরে অস্ট্রেলীয়দের মধ্যে সব চেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছিলেন ডেভিড ওয়ার্নার। তিনিই হয়ে উঠেছিলেন খলনায়ক। সাংবাদিক সম্মেলন করতে আসার পথে যে ভাবে ওয়াংখেড়েতে উপস্থিত জনতার দিকে হাত নেড়ে সাড়া পাচ্ছিলেন ওয়ার্নার, দেখে মনে হচ্ছিল, নিন্দিত নায়ক ফের বন্দিত!
রাজকোটের দ্বৈরথে সামান্য অদলবদল হবে মনে হচ্ছে। স্টিভ স্মিথকে ছাপিয়ে অস্ট্রেলিয়ার এক নম্বর আকর্ষণ হিসেবে উঠে এসেছেন ডেভিড ওয়ার্নার। এক দিকে ফের রক্তের স্বাদ পাওয়া অস্ট্রেলীয় বাঘ। অন্য দিকে আত্মসম্মানে আঘাত লাগা ভারতীয় চ্যাম্পিয়ন। ১৬ জানুয়ারির রাজকোট কার, দেখার অপেক্ষায় ক্রিকেট দুনিয়া।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy