Advertisement
২৫ নভেম্বর ২০২৪
Aditi Swami

হাসপাতালের ওয়ার্ডবয় থেকে পুলিশ, আখের ক্ষেতে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ফলাচ্ছেন প্রবীণ

দুই বিশ্বচ্যাম্পিয়ন তিরন্দাজের আঁতুর ঘর মহারাষ্ট্রের সাতারার দৃষ্টি অ্যাকাডেমি। যেখানে প্রতিভা খুঁজে নেয় পুলিশ কর্মী প্রবীণের চোখ। তিরন্দাজ তৈরির কাজে স্বামীর সঙ্গ দেন তাঁর স্ত্রীও।

picture of Aditi Swami and Ojas Deotale

(বাঁদিকে) ওজস দেওতালে এবং অদিতি স্বামী। ছবি: টুইটার।

আনন্দবাজার অনলাইন ডেস্ক
শেষ আপডেট: ০৭ অগস্ট ২০২৩ ২১:৩৬
Share: Save:

বিশ্ব তিরন্দাজি চ্যাম্পিয়নশিপে সোনা জিতেছেন ভারতের অদিতি স্বামী এবং ওজস দেওতালে। মহারাষ্ট্রের সাতারা এলাকার একই অ্যাকাডেমির ফসল দু’জনে। তাঁদের বিশ্বজয়ের নেপথ্যে রয়েছেন এক ব্যক্তি। তাঁর নাম প্রবীণ সাওয়ান্ত।

প্রবীণ তিরন্দাজি কোচ হয়েছেন পরে। প্রথমে ছিলেন একটি হাসপাতালের ওয়ার্ড বয়। তার পর কাজ করেছেন পুলিশ কর্মী হিসাবে। আরও পরে মহারাষ্ট্রের খরা-প্রবণ এলাকায় গড়ে তুলেছেন তিরন্দাজি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। আখ চাষের জমিতে ‘অর্জুন’ গড়ার কাজ করছেন ‘দ্রোণাচার্য’। ১৭ বছরের অদিতি বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়েছেন কনিষ্ঠতম হিসাবে। আর ২১ বছরের ওজস বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়েছেন ১৫০-এর মধ্যে ১৫০ স্কোর করে।

এক বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপে একই কোচের প্রশিক্ষণে থাকা দু’জন খেলোয়াড়ের ব্যক্তিগত বিভাগে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়ার নজির ভারতের ক্রীড়া ইতিহাসে ছিল না। সেটাই এ বার করে দেখিয়েছেন প্রবীণের দুই ছাত্র। অদিতির প্রতিভা প্রবীণের চোখে পড়েছিল পাঁচ বছর আগে। আর ওজস এক বছর আগে নাগপুরের বাড়ি ছেড়ে নাড়া বেঁধেছিলেন প্রবীণের কাছে।

বেশি দিন আগের কথা নয়। ২০০৮ সালে বেজিং অলিম্পিক্সের খেলা দেখে তিরন্দাজির প্রেমে পড়েছিলেন প্রবীণ। খেলার জন্য বেসরকারি সরকারি চাকরির চেষ্টা শুরু করেছিলেন। এক বন্ধু প্রবীণকে পরামর্শ দিয়ে বলেছিলেন, সরকারি চাকরি পাওয়ার সব থেকে সহজ উপায় কোনও একটি খেলায় জাতীয় স্তরের পদক জেতা। তা হলে খেলোয়াড় হিসাবে সহজে চাকরি পাওয়া যায়। প্রবীণ বলেছেন, ‘‘২০০৮ অলিম্পিক্সের সময় প্রথম তিরন্দাজি খেলাটা দেখেছিলাম। তার আগে আমি ভলিবল খেলতাম। অন্য খেলাও খেলতাম। তিরন্দাজি দেখে ভাল লেগেছিল। ভেবেছিলাম চেষ্টা করে দেখলে কেমন হয়। মনে হয়েছিল, তিরন্দাজিতে খুব বেশি খেলোয়াড় নেই। তাই প্রতিযোগিতা সহজ হবে।’’

খোঁজ খবর করে দেখেন, নিকটবর্তী তিরন্দাজি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের দূরত্ব তাঁর বাড়ি থেকে ৪৫ কিলোমিটার। হাসপাতালে রাতের শিফটে কাজ করে প্রশিক্ষণ নেওয়া একটু সমস্যা হচ্ছিল। প্রবীণ বলেছেন, ‘‘সারা রাত কাজ করে সকাল ৮টার মধ্যে পৌঁছতে হত প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে। দেড় ঘণ্টা সময় লাগত যেতে। তাও চেষ্টা ছাড়িনি। জাতীয় স্তরে অনূর্ধ্ব ১৯ পর্যায়ের একটা প্রতিযোগিতায় জেতার পর উৎসাহ আরও বেড়ে গিয়েছিল। ২১ বছর বয়সে পুলিশে চাকরি পাওয়ার পর হাসপাতালের কাজ ছেড়ে দিয়েছিলাম।’’

প্রবীণ মনে করেছিলেন, সরকারি চাকরিতে কাজের চাপ কম হবে। কিন্তু হয়েছিল উল্টো। পুলিশের চাকরিতে দিনে প্রায় ১৪ ঘণ্টা কাজ করতে হত তাঁকে। ফলে প্রতি দিন অনুশীলন করতে যেতে পারতেন না। পুলিশের পক্ষ থেকে তাঁর অনুশীলনের ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছিল সাতারার শাহু স্টেডিয়ামে। কিন্তু সেখানে পর্যাপ্ত পরিকাঠামো ছিল না। তার মধ্যেই অনুশীলন করতেন। পাশাপাশি, ছোটদের প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করেছিলেন তিরন্দাজির প্রতি ভাল লাগা থেকে। তাদের বাড়ির কাছে যতটা সম্ভব ভাল সুযোগ দেওয়ার ভাবনা থেকেই আখ ক্ষেতে তৈরি করেছিলেন নিজস্ব প্রশিক্ষণ কেন্দ্র।

নিজেও আরও ভাল ভাবে শেখার চেষ্টা করে গিয়েছেন নিরন্তর। তিরন্দাজির বিভিন্ন কৌশল শেখার জন্য দেশের বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। প্রবীণ বলেছেন, ‘‘সময় এবং সুযোগ হলে পুণের আর্মি ইন্সস্টিটিউটে যেতাম। সেখানকার এক কোচকে আমার এক বন্ধু চিনত। ওর মাধ্যমেই আলাপ হয়েছিল। তাঁর কাছে গিয়ে শিখেছিলাম, ছোটদের কী করে তিরন্দাজি শেখাতে হয়। ছোটদের প্রশিক্ষণের কৌশল শিখতে গিয়ে মনে হত, ছোট বেলায় সুযোগ পেলে দেশের জন্য পদক জিততে পারতাম। তা হয়নি। তাই ছাত্র-ছাত্রদের নিয়েই সেই স্বপ্ন দেখতে শুরু করি। ওদের সেখানোর জন্য নিজস্ব একটা জায়গা দরকার ছিল। শাহু স্টেডিয়ামের অস্থায়ী পরিকাঠামো পছন্দ হত না আমার।’’

সে সময় এগিয়ে এসেছিলেন প্রবীণের প্রথম কর্মস্থল সেই হাসপাতালের এক বন্ধু। তিনি নিজের মেয়েকেও প্রবীণের কাছে তিরন্দাজি শেখাতে পাঠাতেন। সেই বন্ধুকে এক দিন জায়গার অভাবের কথা বলতেই সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। সাতারায় তাঁদের আখ ক্ষেতের এক একর জমি প্রবীণকে ব্যবহার করতে দেন। সেই জমিতেই ২০টি শিশুকে নিয়ে পথ চলা শুরু হয়েছিল প্রবীণের তিরন্দাজি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। ক্ষেতের অসমান জমি সমান করা বা অন্যান্য পরিকাঠামো গড়ে তোলার মতো টাকাও ছিল না প্রবীণের কাছে। মা এবং স্ত্রীর গয়না বন্ধক রেখে ২ লাখ টাকা পেয়েছিলেন। তা দিয়ে যতটা সম্ভব পরিকাঠামো গড়ে তুলেছিলেন।

প্রবীণের দুই ছাত্র বিশ্বচ্যাম্পিয়শিপে সোনা জিতলেও তাঁর মা-স্ত্রীর গয়না এখনও ব্যাঙ্কেই জমা রয়েছে। ছাড়াতে পারেননি। তা নিয়ে আক্ষেপ নেই প্রবীণের স্ত্রীরও। স্বামীর তৈরি ‘দৃষ্টি অ্যাকাডেমি’ নিয়ে তিনিও সমান উৎসাহী। স্বামীর কাছ থেকে নিয়েছেন ছোটদের তিরন্দাজির হাতেখড়ি দেওয়ার পাঠ। তিনিও সমান তালে ছোটদের প্রশিক্ষণ দেন এখন। প্রবীণ বলেছেন, ‘‘প্রচুর পরিশ্রম করতে হয় আমাকে। আমি কাজে গেলে অ্যাকাডেমির সব কাজ সামলান আমার স্ত্রী। ও এখন আট মাসের গর্ভবতী। তাও দিনের অনেকটা সময় ছোট ছোট শিক্ষার্থীদের দিচ্ছে। দিনে আমরা হয়তো চার থেক পাঁচ ঘণ্টা ঘুমানোর সময় পাই। সেই কষ্ট বুঝতে দেয় না ছাত্র-ছাত্রীদের সাফল্য। ওদের পদকের থেকে দামী আমাদের কাছে কিছু নেই।’’

অন্য বিষয়গুলি:

Archery Archery World Cup
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy