লড়াকু: ফাইনালে হারলেও ভারতীয় বক্সিংকে গর্বিত করলেন অমিত পাঙ্ঘাল। জিতলেন ঐতিহাসিক রুপো।
ভারতীয় মহিলা বক্সিং দলকে নিয়ে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের প্রস্তুতির জন্য এই মুহূর্তে আমি রয়েছি ইটালিতে। রোম থেকে সড়কপথে আড়াই ঘণ্টার পথ। সেখানেই বিকেলের দিকে ভারতীয় মহিলা বক্সারদের নিয়ে অনুশীলনের মাঝেই ইউটিউবে চোখ রেখেছিলাম বিশ্ব বক্সিংয়ের ফাইনালের উপর।
শনিবার ভারতীয় সময় সন্ধে সাড়ে সাতটায় রাশিয়ার এই জায়গাতেই যে বিশ্ব বক্সিং চ্যাম্পিয়নশিপে ৫২ কেজি বিভাগের ফাইনালে মুখোমুখি হয়েছিল আমাদের অমিত পাঙ্ঘাল। বিপক্ষে রিয়ো অলিম্পিক্সে সোনাজয়ী উজ়বেকিস্তানের বক্সার শাখোবিদিন জ়ইরভ। তাই আমার শরীরটা ইটালিতে থাকলেও মনটা ছিল রাশিয়ায়।
বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে এর আগে ব্রোঞ্জ পেয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে আমাদের। ২০০৯ সালে বিজেন্দ্র সিংহ, ২০১১ সালে বিকাশ কৃষাণ, তার পরে ২০১৫ সালে শিবা থাপা আর দু’বছর আগে গৌরব বিধুরি। সকলেই বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ থেকে ব্রোঞ্জ নিয়ে দেশে ফিরেছে। তাই শনিবার অমিতের লড়াইটা ছিল ভারতের বক্সিংয়ের ইতিহাসেই একটি বিরল দিন। ফাইনালে উঠেই ও নিশ্চিত করে দিয়েছিল, এই প্রথম অন্তত রুপো জিতে ইতিহাস সৃষ্টি হবে। কিন্তু অপেক্ষা ছিল ফাইনালটাও জিতে সোনালি দিন উপহার দিতে পারে কি না। শেষ পর্যন্ত ও পারল না। ০-৫ হেরে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে রুপো পেয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হল।
হয়তো অনেকেই অমিত সোনা জিততে না পারায় হতাশ। কিন্তু আমি সেই দলে পড়ছি না। বিশ্বসেরা বক্সারদের মঞ্চ থেকে রুপো পাওয়াও কোনও অংশে কম কৃতিত্ব নয়। প্রথম ভারতীয় বক্সার হিসেবে যে কৃতিত্ব অর্জন করল ও।
প্রশ্ন উঠবে সোনা জয় কেন হল না? আমার মতে, প্রত্যাশার চাপ ও আবেগেই হয়তো নিজের সেরাটা আজ তুলে ধরতে পারেনি অমিত। নিজে দেশের হয়ে বক্সিং করেছি। তাই জানি, এ রকম ঐতিহাসিক দিনে রিংয়ে নামার আগে প্রত্যাশার চাপ কতটা থাকে একজন বক্সারের উপর। হয়তো এই চাপটাই অমিতকে সোনার ইতিহাস গড়তে দিল না।
বাঁ হাতি বক্সার অমিতের রক্ষণ ভাল। হাতে দুর্দান্ত ‘হুক’ রয়েছে। প্রতিপক্ষের ডান ও বাঁ দিকে ওর সেই হুকগুলো আছড়ে পড়ে। তিন বছর ধরে ওকে দেখছি জাতীয় শিবিরে। তাই জানি ওর ‘ফুটওয়ার্ক’ চমৎকার। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে না কখনও। আক্রমণে গিয়ে একটু সামনের দিকে ঝুঁকে জোরালো ঘুসি মারতে পারে বিপক্ষের মুখে। এ ছাড়াও বিপক্ষকে প্ররোচিত করে নিজে আক্রমণে এগিয়ে গিয়ে। এর পরে যখনই বিপক্ষ আক্রমণে আসে তখন ও একটু পিছিয়ে গিয়ে নাগাড়ে প্রতি-আক্রমণ করে যায়।
কিন্তু আজ দেখে মনে হল ওর শরীর চলছিল না। দেহ ও মনের সংযোগস্থাপন হয়নি। তাই নিখুঁত ভাবে ওর ঘুসিগুলো ঠিক জায়গায় পড়ল না। এটা হতে পারে ঠিক মতো বিশ্রাম না হলে বা ঘুম ঠিক না হলে। হয়তো ভারতীয় বক্সিংয়ের এই মাহেন্দ্রক্ষণের সামনে দাঁড়িয়ে প্রত্যাশার চাপেই মাথা ঠান্ডা রাখতে বা ঠিক মতো ঘুমোতে পারেনি ছেলেটা। তাই ওর পা আজ ঠিক মতো পড়ছিল না। শরীর আগে চলে যাচ্ছিল আর পা পিছনে। উজ়বেকিস্তানের বক্সার শাখোবিদিন সেই সুযোগটাই নিয়ে চলে গেল। প্রতি-আক্রমণ করেই হারিয়ে দিল অমিতকে।
বক্সিংয়ে প্রথম রাউন্ডটা সব সময়েই বিপক্ষকে বুঝে নেওয়ার। অমিতও প্রথম রাউন্ডটা ঠিকঠাক শুরু করেছিল। খুব বেশি আক্রমণে যাচ্ছিল না। প্রতি-আক্রমণে দু’একবার গিয়েছিল। কিন্তু দ্বিতীয় রাউন্ডে বিপক্ষ পাল্টা আক্রমণে আসতেই ও নিজের ছন্দে খেলতে পারল না। বিপক্ষ এমনিতেই লম্বা এবং বেশি স্বাস্থ্যকর। তাই শারীরিক সুবিধা পাচ্ছিল। আমার মনে হয়, আর একটু বেশি আক্রমণে যেতে পারত অমিত। আর একটু নিখুঁত নিশানায় ‘পাঞ্চ’ করতে পারলে ফল অন্য রকম হতে পারত।
তৃতীয় রাউন্ডে অমিত মরিয়া হয়ে আক্রমণে গিয়েছিল। কিন্তু তখন দেরি হয়ে গিয়েছে। উজ়বেক প্রতিপক্ষ রক্ষণাত্মক নীতি নিয়ে সময়টা কাটিয়ে দেয়। যদি প্রথম ও তৃতীয় রাউন্ডে মরিয়া আক্রমণ করে বিপক্ষকে কোণঠাসা করতে পারত অমিত, তা হলে সোনার সুযোগ থাকলেও থাকতে পারত। সোনা না এলেও অমিতের মরিয়া লড়াই দেখে সারা দেশই গর্বিত হবে, সন্দেহ নেই। আমি অনেক বিখ্যাত বক্সারকে দেখেছি, রুপো নিশ্চিত হওয়ায় মরিয়া লড়াই করেনি। আমাদের ছেলেটা কিন্তু হাল ছাড়েনি এক বারও। অভিজ্ঞতাও অমিতের পক্ষে ছিল না। যত সময় যাবে, ও লড়াইয়ের কৌশল আরও ভাল করে রপ্ত করবে। অদূর ভবিষ্যতেই হয়তো অনেক দেখা যাবে অমিত বিক্রম।
অমিতের সঙ্গে এর আগে শেফিল্ড ও আয়ারল্যান্ডে গিয়েছি প্রস্তুতি সফরে। ওকে অনুশীলন করিয়েছি বেশ কয়েক বার। তাই জানি ও নিজে কতটা আগ্রাসী লড়াই করতে পারে। তা ছাড়া শাখোবিদিন আগে নামত ব্যান্টামওয়েটে। ওজন কমিয়ে এখন লড়ছে ৫২ কেজি বিভাগে। আর অমিত ৪৯ কেজি থেকে বাড়িয়ে লড়ছে ৫২ কেজিতে। এর আগে এশীয় চ্যাম্পিয়নশিপে লড়াই করার পরে এটা ওর দ্বিতীয় প্রতিযোগিতা। দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতাতেই যদি ও রুপো নিয়ে আসতে পারে, তা হলে অভিজ্ঞতা বাড়লে এই অমিতই আরও বড় সাফল্য আনবে বলে আমার বিশ্বাস। ফেব্রুয়ারিতে অলিম্পিক্সের যোগ্যতামান অর্জন করলে টোকিয়ো থেকে পদক নিয়েও ফেরার মতো প্রতিভা ও।
বলতেই পারি, এ বারের বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপ ভারতীয় বক্সিংয়ে নতুন জোয়ার এনে দিল। আগেই মণীশ কৌশিক ৬৩ কেজি বিভাগে ব্রোঞ্জ পাওয়ায় একটি রুপো ও একটি ব্রোঞ্জ নিয়ে দেশে ফিরছে ভারত। যে সাফল্য বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপ থেকে কখনও পাইনি আমরা।
(লেখক কমনওয়েলথ গেমসে প্রথম সোনাজয়ী ভারতীয় বক্সার ও ভারতীয় মহিলা দলের কোচ)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy