প্রদীপ কুমার (পিকে) বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রদীপ কুমার (পিকে) বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁদের কারও কাছে ছিলেন বাবার মতো। কেউ আবার তাঁকে মনে করতেন বড় দাদা। কিংবদন্তি ফুটবলার ও কোচের প্রয়াণের চব্বিশ ঘণ্টা পরেও মানসিক ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে পারেননি সমরেশ চৌধুরী (পিন্টু), গৌতম সরকার, শিশির ঘোষ, বিকাশ পাঁজিরা।
কয়েক দিন আগেই বাইপাসের ধারে হাসপাতালে প্রিয় কোচকে দেখতে গিয়েছিলেন সমরেশ। ভেবেছিলেন, সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরলে প্রিয় বন্ধু গৌতমকে নিয়ে আবার গল্প করতে যাবেন। ভারাক্রান্ত গলায় সমরেশ বলছিলেন, ‘‘প্রদীপদা শুধু আমার কোচ ছিলেন না। দাদার মতো সব সময় আমাকে আগলে রাখতেন। আসলে প্রদীপদা ও আমি দু’জনেই বাঘা সোমের ছাত্র ছিলাম। তাই হয়তো আমার প্রতি দুর্বলতা একটু বেশি ছিল।’’ সমরেশের স্মৃতিতে এখনও উজ্জ্বল পিকের সঙ্গে প্রথম দেখা হওয়ার মুহূর্ত। বলছিলেন, ‘‘প্রদীপদার সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ কলকাতা লিগের একটি ম্যাচে। আমি তখন উয়াড়িতে। প্রদীপদা ছিলেন ইস্টার্ন রেলে। বারবার ওঁর পায়ের সামনে থেকে আমি বল সরিয়ে দিচ্ছিলাম দেখে বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি সেই পোলা? বাঘাদা যার কথা কইসে। আমিও পাল্টা প্রশ্ন করলাম, কী কইসে বাঘাদা? প্রদীপদা বলেছিলেন, বাঘাদা কইসিলেন একটা পোলা পাইসি প্রদীপ। দেখবি, অনেক দূর যাইব।’’
সমরেশের মনে পড়ে যাচ্ছে ভারতের হয়ে প্রথম বিদেশ সফরের নানা কাহিনি। বলছিলেন, ‘‘১৯৭১ সালে রাশিয়া সফরের জন্য ভারতীয় দলে নির্বাচিত হই। প্রদীপদা কোচ। মস্কো রওনা হওয়ার আগে মুম্বইয়ে দলের সঙ্গে যোগ দেওয়ার পরে প্রদীপদা প্রথমেই জিজ্ঞেস করলেন, রাশিয়া যাওয়ার জন্য গরম পোশাক কী এনেছো? আমি বললাম, শুনেছি জাতীয় দলের ফুটবলারদের ট্র্যাকসুট দেওয়া হয়। আমার ওতেই কাজ চলে যাবে। আমার কথা শুনে প্রদীপদা মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন।’’ কেন? সমরেশ যোগ করলেন, ‘‘সেই সময় সুতির ট্র্যাকসুট দেওয়া হত জাতীয় দলের ফুটবলারদের। প্রদীপদা রেগে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার কোনও ধারণা আছে রাশিয়ায় কি রকম ঠান্ডা? মাইনাস পাঁচ-সাত ডিগ্রিতে এই ট্র্যাকসুট পরলে কেউ বাঁচাতে পারবে না তোমাকে। তার পরেই পকেট থেকে পঞ্চাশ টাকার একটা নোট বার করে আমার হাতে দিয়ে বললেন, এক্ষুনি গিয়ে একটা মোটা ওভারকোট কিনে আনো। প্রদীপদার জন্যই রাশিয়াতে পুলিশ আমাকে গ্রেফতার করেনি।’’ কেন? সমরেশ বলছিলেন, ‘‘প্রদীপদা আমাকে নিয়ে লেনিনের শায়িত দেহ দেখতে গিয়েছিলেন। আমার মনে হয়েছিল, লেনিন বেঁচে আছেন। আমি হাত দিয়ে লেনিনের চোখের উপরে হাওয়া করতে শুরু করেছিলাম। প্রদীপদা দেখেই চমকে উঠলেন। আমাকে হাত ধরে টেনে এনে ফিসফিস করে বললেন, কী করছ তুমি? তোমাকে তো পুলিশ ধরবে। আর কোনও দিন দেশে ফিরতে পারবে না।’’ নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে শোনালেন, ‘‘১৯৭৩ এ আইএফএ শিল্ড ফাইনালে আমাদের খেলা ছিল কোরিয়ার পিয়ং ইয়ং-এর সঙ্গে। প্রথম পনেরো মিনিট বলই ধরতে পারছিলাম না। হঠাৎ-ই মাঠের পাশে চলে এলেন প্রদীপদা। তারপর বললেন, ‘দেশের ক্লাবগুলোর বিরুদ্ধে তো খুব কেরামতি দেখাও, প্রচুর পাস করো। ড্রিবল করো। বিদেশি দল পড়লেই গুটিয়ে গেলে বাবা।’ মাটিতে বল রেখে খেলার কথা বললেন তিনি। ‘‘বিশ্বাস করুন যেই বল ধরে খেলতে শুরু করলাম সব বদলে গেল। জিতলামও আমরা। দারুণ খেলেছিল হাবিব, গৌতমরা।’’
ফুটবল মাঠে সমরেশ-গৌতম জুটি ছিল বিপক্ষের আতঙ্ক। গৌতমের কথায়, ‘‘প্রদীপদা সব সময়ই শেখার চেষ্টা করতেন। বিদেশ থেকে কোচিংয়ের নানা রকম বই আনাতেন। বিদেশি ফুটবলারদের খেলা দেখতেন। তা শেখানোর চেষ্টা করতেন। ওঁর কোচিংয়ের পদ্ধতি ছিল আলাদা। আমি একবার ছন্দ হারিয়ে ফেলেছিলাম। প্রদীপদার জন্যই সফল হই।’’
গৌতমের মনে পড়ে যাচ্ছে ফুটবল সম্রাট পেলের কসমসের বিরুদ্ধে সেই ঐতিহাসিক ম্যাচের কথা। শুধু তা-ই নয়। ফুটবলার হিসেবে পিকের শেষ ম্যাচে সতীর্থও ছিলেন গৌতম! বললেন, ‘‘কলকাতা লিগে ইস্টার্ন রেল বনাম রাজস্থান ম্যাচ। আমি ভুল পাস দেওয়ায় প্রচণ্ড ধমক দিলেন প্রদীপদা। তার পরে আমার পাস থেকেই গোল করেন তিনি। সেটাই ছিল ফুটবলার হিসেবে প্রদীপদার শেষ ম্যাচ।’’ কসমস ম্যাচ নিয়ে বললেন, ‘‘মাঠে নামার আগে বলেছিলেন, পেলে ফুটবল সম্রাট। কিন্তু তোমাকেও প্রমাণ করতে হবে যে তুমি কারও চেয়ে কম নও। প্রদীপদার কথা শুনে মনে হচ্ছিল, শরীরের ভিতরে যেন আগুন জ্বলছে।’’
স্মৃতির সরণি ধরে হাঁটতে হাঁটতে শিশির বলছিলেন, ‘‘প্রদীপদা আমার বাবার মতো। কোচ হিসেবে জাতীয় দলেই বেশি পেয়েছি ওঁকে।’’ শোনালেন চমকপ্রদ কাহিনি, ‘‘মোহনবাগান মাঠে এক দিন অনুশীলনের পরে আমরা সবাই চা-খাচ্ছিলাম। হঠাৎ প্রদীপদার সঙ্গে মজা করতে ইচ্ছে হল। হাতে চায়ের কাপ নিয়ে প্রদীপদাকে বললাম, আমার বাবা বলতেন, আপনি নাকি বিরাট বড় ফুটবলার ছিলেন। বলটা মারুন তো দেখি এই কাপে। মনে রাখবেন, বল যেন আমার হাত স্পর্শ না করে।’’ কী হল তার পরে? হাসতে হাসতে শিশির বললেন, ‘‘প্রথম শটটা কাপের প্রায় দশ ফুট দূর দিয়ে উড়ে যায়। দ্বিতীয়টাও তাই। আমি তখন বললাম, ছাড়ুন, আপনাকে আর মারতে হবে না। কত বড় ফুটবলার ছিলেন, বুঝে গিয়েছি। মুখ লাল হয়ে গেল প্রদীপদার। বললেন, চুপ করে দাঁড়াও। এর পরে যা ঘটল, তা অভাবনীয়।’’ মুগ্ধ শিশির যোগ করলেন, ‘‘প্রদীপদা বল বসিয়ে তৈরি হচ্ছেন শট নেওয়ার জন্য। মুহূর্তের মধ্যে দেখলাম, আমার আঙুলের ফাঁকে শুধু কাপের হাতলটা ধরা আছে। কাপটা পড়ে আছে অনেক দূরে। তখন লজ্জায় আর তাকাতে পারছিলাম না ওঁর দিকে।’’
মানস ভট্টাচার্য বলছিলেন, ‘‘প্রদীপদা না থাকলে বিদেশ-মানস জুটি দেখতে পেত না কলকাতার ফুটবল। যা করেছি, যে টুকু শিখেছি সব প্রদীপদার জন্য।’’ ১৯৭৮-এ কলকাতা লিগ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর মোহনবাগান হারে ডুরান্ডে। তারপর রোভার্সে ওরকে মিলসের কাছে হেরে বিদায় নিয়েছিল মোহনবাগান। ক্ষুব্ধ সবুজ-মেরুন কোচ যে, পুজোর সময় অনুশীলন করিয়েছিলেন পুরো দলকে। কাউকে ছুটি দেননি। মানস বলছিলেন, ‘‘ইনসাইড ড্রিবলটা জানতাম। কিন্তু প্রদীপদা আমাকে হাতে ধরে আউটসাইড ড্রিবলটা শিখিয়েছিলেন। ফলে কাট করে বিপক্ষের বক্সে ঢোকাটা রপ্ত হয়ে গিয়েছিল। গোলও পেতাম। প্রদীপদা বলতেন গোলই হল একজন স্ট্রাইকারের সাফল্যের মাপকাঠি।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy