উচ্ছ্বাস: শনিবার মেলবোর্নে চলল যাঁদের শাসন। (বাঁ দিক থেকে) ফের স্মিথ-শিকার অশ্বিনের। চার উইকেট তুললেন বুমরা। অভিষেকে নজর কেড়ে সদ্য প্রয়াত পিতাকে স্মরণ সিরাজের। গেটি ইমেজেস।
মেলবোর্নে ভারতীয় ক্রিকেট ভক্তদের জন্য উপহারে ভরা দারুণ একটা বক্সিং ডে। মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানে ৩৬ অলআউটের যন্ত্রণা মুছে ফেলে এ ভাবে প্রত্যাঘাত করাটা সত্যিই সাহসিকতার পরিচয়। বোলাররা ফের এগিয়ে দিয়েছে। এ বার ব্যাটসম্যানদের পরীক্ষা এবং আশা করব, অ্যাডিলেডের বিপর্যয় থেকে ওরা শিক্ষা নিয়ে ঘুরে দাঁড়াবে।
আমার মনে হয়, বোলারদের তৈরি করা জমির উপরে যদি ব্যাটসম্যানরা প্রথম ইনিংসে ১৫০-১৬০ রানের ‘লিড’ তৈরি করে দিতে পারে, ম্যাচের রাশ ভারতের হাতে থাকবে। সিরিজ ১-১ করার আশাও থাকবে। তবে অ্যাডিলেড আমাদের শিখিয়েছে, একটা ম্যাচের ভাগ্য আমূল পাল্টে যেতে লাগে কয়েকটা দারুণ ডেলিভারি। মহান অনিশ্চয়তার খেলা নিয়ে তাই আগে থেকে কিছু ধরে না নেওয়াই ভাল। আশা করব, ভারতীয় দলও এই শিক্ষাটা মাথায় রাখবে যে, যত ক্ষণ না কাজ শেষ হচ্ছে, আরামে ঘুমিয়ে পড়ার উপায় নেই। টেস্ট ক্রিকেটে আত্মতুষ্টির কোনও জায়গা নেই।
আমি যদিও শুরুতেই খুব অবাক হলাম, টস জিতে অস্ট্রেলিয়া ব্যাটিংয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়ায়। আমরা অস্ট্রেলিয়ায় অনেক খেলেছি। বরাবর এটাই জেনে এসেছি যে, মেলবোর্নে টসে জিতে চোখ বুজে ফিল্ডিং করো। টিম পেনরা কেন ব্যাটিং করল জানি না। মেলবোর্নে প্রথমে ফিল্ডিং করার সেই পুরনো প্রবাদ যে এখনও চলছে, তা এ দিনও প্রমাণ হয়ে গেল। ভারতের দিক থেকে বলব, টসটা হেরে গিয়ে বরং ভালই হয়েছে। নিজেদের সিদ্ধান্ত নিতে হয়নি কী করব। প্রতিপক্ষই সাজিয়ে পুরস্কারটা তুলে দিয়েছে হাতে। দিনের শেষে ঘরের মাঠে টস জিতেও অস্ট্রেলিয়াই চাপে।
অস্বীকার করব না, এই টেস্ট শুরুর আগে অজিঙ্ক রাহানের অধিনায়কত্ব নিয়ে আমার মনে সংশয় ছিল। ওকে দেখে সত্যিই মনে হত না যে, দারুণ নেতৃত্ব গুণ ওর মধ্যে রয়েছে। বিরাট কোহালির মতো বলিষ্ঠ নেতার পরিবর্ত হিসেবে ও কী করতে পারে, তা নিয়ে সংশয়ের মেঘ জমছিল। রাহানে কিন্তু আমাদের সকলকে ভুল প্রমাণিত করে দিয়েছে। ওর ফিল্ডিং সাজানোটা বিশেষ করে আমাকে খুব স্মৃতিমেদুর করে তুলছিল। স্পিনারের জন্য যেন আমাদের সময়কার সেই ফিল্ডিং। ব্যাকওয়ার্ড শর্ট লেগ, শর্ট মিডউইকেট, ফরোয়ার্ড শর্ট লেগ, মিড-অন জাতীয় ফিল্ডিং রেখে বল করছে অফস্পিনার। ব্যাটসম্যানের একটা দিক আক্রমণ করার এই ফিল্ডিংই তো আমাদের সময়ে সাজানো হত!
আমার মনে হয়, রাহানের অধিনায়কত্ব পুরাতন ও নতুনের মিশ্রণ। এ রকম ফিল্ডিং সাজানোর কারণে কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার পক্ষেও রান তোলা কঠিন হয়েছে। ওরাও হয়তো এমন চক্রব্যূহের হোমওয়ার্ক করে আসেনি। খুব শান্ত, ধীরস্থির একটা মনোভাব রয়েছে রাহানের। মাঠে একদমই উত্তেজনার প্রকাশ ঘটায় না। আরও যেটা ভাল লাগল, বোলারদের ফিল্ডিং সাজানোর স্বাধীনতাটা দিচ্ছিল। টাইগার পটৌডিকে এই জিনিসটা করতে দেখেছি। আমরা চার স্পিনার খেলতাম টাইগারের অধীনে। এক-এক জনের জন্য এক-এক রকম ফিল্ডিং সাজাতে হত। কিন্তু ভারতের সর্বকালের সেরা অধিনায়ক যাকে মানা হয়, সে-ও কিন্তু বোলারদের সঙ্গে আলোচনা করত। টাইগারকে দেখে আর একটা জিনিস বুঝেছি। যে কোনও বড় অধিনায়কের গুণ হচ্ছে, খেলার মধ্যে মগ্ন থাকা। টাইগার যেমন খেলায় বুঁদ হয়ে থাকত। যে কারণে ওর ‘গেম রিডিং’ ক্ষমতা ছিল অসাধারণ। ও রকম বোলিং পরিবর্তন, মোক্ষম চাল দিতে কখনও কাউকে দেখিনি।
বক্সিং ডে-তে অস্ট্রেলিয়াকে ওদের ডেরায় ১৯৫ রানে শেষ করে দেওয়ার উপহার তুলে দিয়ে আসল সান্টা ক্লজ় কিন্তু বোলাররা। চোটের জন্য মহম্মদ শামি ছিটকে যাওয়াটা বড় ধাক্কা ছিল। কিন্তু সদ্য বাবাকে হারানো মহম্মদ সিরাজ অভিষেক টেস্টে মন জয় করে নিয়েছে। কী আগ্রাসী শরীরী ভাষা ছেলেটার! কে বলবে, অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে এ রকম চাপের আবহে জীবনের প্রথম টেস্ট খেলছে! তবে এ বারের অস্ট্রেলিয়া সফরে ভারতীয় বোলিংয়ের দুই স্তম্ভের নাম যশপ্রীত বুমরা এবং আর অশ্বিন। শনিবারও এই দু’জনই শেষ করে দিল অস্ট্রেলিয়াকে। প্রথম সেশনে বুমরার সাফল্য দারুণ শুরু পাইয়ে দেয়। রাহানে খুব দ্রুত অশ্বিনকে আক্রমণে আনল। অশ্বিন অধিনায়কের আস্থার মর্যাদা দিতে দেরি করেনি। স্টিভ স্মিথের উইকেট যে কোনও দলের কাছে সব চেয়ে বড় শিকার। অ্যাডিলেডের পরে মেলবোর্নেও স্মিথ ফের অশ্বিনের শিকার। উইকেটটা কিন্তু একদম পরিকল্পনা করে তুলল ভারতীয় দল। স্মিথ অফের দিকে ‘শাফল’ করে অনের দিকে খেলতে ভালবাসে। ‘অ্যাক্রস দ্য লাইন’ গিয়ে মিডউইকেটে খেলার চেষ্টা করে। এত দিন সকলে তাই ওকে অফের দিকে বল করত। ভারতীয় দল ঠিক উল্টোটা করল। স্মিথকে ওর শক্তির জায়গায়, অর্থাৎ পায়ের দিকেই আক্রমণ করল। ব্যাকওয়ার্ড শর্ট লেগ, শর্ট ফাইন লেগ, ফরোয়ার্ড শর্ট লেগ রেখে ওকে শক্তির জায়গাতেই আক্রমণ করাটা ছিল অভিনব। ব্যাকওয়ার্ড শর্ট লেগে অফস্পিনারের বলে ক্যাচ যাচ্ছে— কত দিন পরে যে আবার এ সব দৃশ্য দেখছিলাম! সেই কারণেই বলছি, আমাদের সময়কার টেস্ট ক্রিকেট মনে পড়ছিল।
আমি অ্যাডিলেড টেস্টের সময়েই বলেছিলাম, দুই স্পিনারে খেলা উচিত ভারতের। এ দিন কিন্তু জাডেজাও বেশ ভাল বল করেছে। যদিও খুব বেশি কিছু করার সুযোগ ও পায়নি। দ্বিতীয় ইনিংসে দুই স্পিনারের উপস্থিতি কিন্তু পার্থক্য গড়ে দিয়ে যেতে পারে। মেলবোর্নের পিচে বরাবর বোলারদের জন্য সাহায্য থেকেছে। চন্দ্রের দুর্দান্ত ম্যাচ জেতানো স্পেল ছিল। বরাবর স্পিনাররা ‘টার্ন’ পেয়েছে। কপিল দেব যখন মেলবোর্নে জিতিয়েছিল, সুইংয়ের চেয়ে কাটার বেশি করেছিল। অস্ট্রেলিয়ায় এখন শুনি ‘ড্রপ-ইন’ পিচ হয়। কিন্তু স্পিনারদের জন্য সাহায্য যে শেষ হয়ে যায়নি, তা তো প্রমাণ হয়ে যাচ্ছে।
আরও পড়ুন: বছরের শেষ ম্যাচেও সমর্থকদের জয় উপহার দিতে পারলেন না ফাওলার
শুভমন গিলকে ওপেনার হিসেবে নিয়ে আসাটা একদম ঠিক সিদ্ধান্ত। ছেলেটার সময়জ্ঞান অসাধারণ। দু’টো স্ট্রেট ড্রাইভ মেরেছে এ দিন, যা ওর ব্যাটিং উৎকর্ষের পরিচয়। রবিবার সকালে নতুন করে পরীক্ষা দিতে হবে ওকে। এটুকু বলতে পারি, এই পর্যায়ের ক্রিকেটের সব ধরনের পরীক্ষায় পাশ করার যোগ্যতা শুভমনের রয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy