আগ্রাসী: মঙ্গলবার ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে রিভার্স সুইপ মারছেন ঋষভ পন্থ। নিজেকে প্রমাণ করতে তৈরি ভারতীয় দলের তরুণ তারকা। ফাইল চিত্র
মহেন্দ্র সিংহ ধোনিকে কি আর কখনও ভারতের নীল জার্সিতে ফিরতে দেখা যাবে? গায়ানায় কোহালির দলের ৩-০ জয়ের রাত এবং হোয়াইটওয়াশের উৎসবের মধ্যে ক্রমশ তলিয়ে যাচ্ছে সেই সম্ভাবনা।
বিশেষ করে ধোনির উত্তরসূরি হিসেবে যাঁকে ভাবা হচ্ছে, সেই ঋষভ পন্থ মঙ্গলবারের টি-টোয়েন্টি ম্যাচে রান করে দেওয়ার পরে পরিস্থিতি আরওই ঘুরতে শুরু করেছে। ৪২ বলে ৬৫ রানের ইনিংস খেলে বাঁ হাতি তরুণ শুধু দলকে জেতাননি, রীতিমতো শাসকের ভূমিকায় ব্যাট করেছেন। ইনিংসে চারটি চার এবং চারটি ছক্কা। যা দেখে অনেকেই আশ্বস্ত হচ্ছেন যে, পরের প্রজন্ম তৈরি। নির্বাচক থেকে শুরু করে টিম ম্যানেজমেন্ট, সকলেই নতুন প্রতিভায় লগ্নি করতে প্রস্তুত।
ঋষভের জন্য যা সুখবর এবং তাঁর প্রিয় কিংবদন্তির জন্য মোটেও সুখের বার্তা নয়, তা হচ্ছে, দলের অন্দরমহলেও ক্রমশ কমে আসছে একচেটিয়া ধোনি-বন্দনার সেই রিংটোন। বিশ্বকাপ পর্যন্তও কোহালিদের মুখে বার বার শোনা গিয়েছে ধোনির প্রতি সমর্থনের সুর। মঙ্গলবার ম্যাচ এবং সিরিজ জেতার পরে অধিনায়ককে বলতে শোনা গিয়েছে ‘ঋষভই ভবিষ্যৎ’। ইনি সেই কোহালি, যিনি বিশ্বকাপের সময় ধোনিকে নিয়ে সচিন তেন্ডুলকরের সমালোচনাতেও ফোঁস করে উঠেছেন!
অনেকের মনে হচ্ছে, ধোনির প্রতি শ্রদ্ধা অটুট রেখেও দল বুঝতে পেরেছে, সামনের দিকে তাকানোর সময় হয়েছে। ভিতরে-ভিতরে মানতেই হচ্ছে যে, একটা সময় সকলকেই চলে যেতে হয়। মাহি যুগ শেষের সীমায়, এখন ঋষভের মতো তরুণকে নিয়ে নতুন যাত্রা শুরু করার সময়। ইন্টারনেট বন্ধ থাকা কাশ্মীরের সীমান্তেও হয়তো প্রতিধ্বনিত হচ্ছে এই নির্মম সত্য। যেখানে টেরিটোরিয়াল আর্মির হয়ে ফৌজি জীবন কাটাচ্ছেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল ধোনি।
ভারতীয় ক্রিকেটের প্রভাবশালী মহলে কয়েক জনের সঙ্গে কথা বলে মনে হচ্ছে, সব কিছু আর ধোনির হাতেও নেই। কাশ্মীরের সেনা ছাউনি থেকে বেরোনোর পরে মোবাইল নেটওয়ার্ক যখন আবার চালু হবে, ধোনি নিজেও সেগুলি টের পেতে থাকবেন। যেমন তাঁর প্রতি জাতীয় নির্বাচকদের মনোভাব। শোনা যাচ্ছে, এম এস কে প্রসাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় নির্বাচক কমিটি পরিষ্কার বার্তাই দিতে চলেছে ধোনিকে যে, আপাতত যত বেশি সম্ভব ম্যাচে ঋষভ পন্থকে তাঁরা খেলাতে চান। অর্থাৎ, সম্মানহানি না ঘটিয়ে কিংবদন্তিকে ঘুরিয়ে বলা যে, তোমার জন্য এখনই জায়গা করা যাচ্ছে না। ওয়ান ডে বা টি-টোয়েন্টি, কোনওটাতেই নয়।
সামনের দু’বছরে পর-পর দু’টি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ রয়েছে। ২০২০-তে অস্ট্রেলিয়ায়, ২০২১-এ ভারতে। এই দু’টি বিশ্বকাপের জন্য নির্বাচকদের রোডম্যাপে ধোনি নেই, আছেন ঋষভ। সেটা তাঁর সামনে পরিষ্কার করে দেওয়া হবে। তার পরে বাকিটা তাঁর সিদ্ধান্ত। দেওয়াল লিখন পড়ে নিয়ে তিনি নিজে সরে দাঁড়াতে পারেন। অথবা অবসর ঘোষণা না করে ঘরোয়া ক্রিকেটের ময়দানে নিজেকে নতুন করে প্রমাণ করার জন্য পড়ে থাকতে পারেন।
কিন্তু সেখানেও নানা সমস্যার কাঁটাতার রয়েছে। প্রথমত, ধোনির বয়স ৩৮। প্রত্যাবর্তনের জন্য খুব তাজা বয়স নয়। দ্বিতীয়ত, তিনি নিজে বহু বছর ধরেই ঘরোয়া ক্রিকেটে খেলার তাগিদ অনুভব করেননি। হঠাৎ এত দিন পরে, ৩৮ বছর বয়সে দেশের প্রত্যন্ত সব জায়গায় গিয়ে ফাঁকা মাঠে খেলার জ্বালানি তাঁর শরীরে আর অবশিষ্ট আছে কি না, দেখার। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের ‘বিজনেস ক্লাস’ পৃথিবী ছেড়ে ঘরোয়া ক্রিকেটের ‘লো কস্ট এয়ারলাইন্স’-এর দুনিয়ায় মানিয়ে নেওয়ার পরীক্ষাও দিতে হবে।
কয়েকটি মহলের খবর, ধোনি এখনই অবসর ঘোষণা করবেন না। পড়ে থাকবেন সামনের বছরের আইপিএলের জন্য। যদি কোনও ভাবে চেন্নাই সুপার কিংসের হলুদ জার্সিতে জ্বলে উঠে নির্বাচকদের মনোভাবে বদল আনতে পারেন। আপাতত সেই সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। ধোনি যদি নিজে না পাকাপাকি ভাবে সরে দাঁড়ান, তা হলে হয়তো তাঁর মুখরক্ষার জন্য প্রত্যেক সিরিজের আগেই নির্বাচকদের বলতে হবে, এটায় এমএস খেলছেন না। বিশ্রাম নিচ্ছেন। যেমন করা হয়েছে এ বারের ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরের দল নির্বাচনের ক্ষেত্রে।
ধোনি-ঘনিষ্ঠদের মনে হচ্ছে, যে-হেতু দেশব্যাপী প্রাক্তন ও বিশেষজ্ঞের দল তাঁর অবসরের দাবি তুলেছেন, তিনিও জেদ দেখিয়ে বিদায়ের কথা জানাচ্ছেন না। যে কোনও দিন তিনি এই জেদাজেদি ত্যাগ করে নিঃশব্দে বিদায় নিতে পারেন। এক জন এ দিন বললেন, ‘‘দেশের মাঠে অস্ট্রেলিয়া যখন ওয়ান ডে সিরিজ খেলতে এসেছিল, রাঁচীর পরে আর খেলেনি মাহি। পুরো টিমকে নিজের বাড়িতে ডিনার পার্টি দিয়েছিল। আমাদের মনে হয়েছিল, ওটাই দেশের মাটিতে ওর শেষ ম্যাচ। এখনও সেটাই মনে হচ্ছে যে, রাঁচীতেই মাহি দেশের মাটিতে ওর শেষ ম্যাচ খেলে ফেলেছে।’’
চিরকালের নিঃশব্দে বিদায় নেওয়ার মাহি-রীতি তো আছেই। এর পাশাপাশি যদি ঋষভের উড়ান আরওই উচ্চ আকাশে উড়তে থাকে, কঠিন হতে থাকবে ধোনির প্রত্যাবর্তন সম্ভাবনা। গায়ানার মাত্র একটি ম্যাচ জেতানো ইনিংসেই যে ভাবে পন্থ দলের আস্থা জিতে নিয়েছেন, তা চোখে পড়ার মতো। আজ, বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হচ্ছে ক্রিস গেলদের বিরুদ্ধে ওয়ান ডে সিরিজ। সেখানেও আলোচনার কেন্দ্রে ঋষভ। চার নম্বরে তাঁকে খেলানো হবে কি না, গুরুত্ব দিয়ে ভেবে দেখা হচ্ছে।
বিশ্বকাপে চারেই ব্যাট করেছিলেন পন্থ। মনে করা হচ্ছিল, ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজে ধোনি না থাকায় তাঁকে পাঁচে নামানো হতে পারে। চারে নামতে পারতেন মণীশ পাণ্ডে বা শ্রেয়স আইয়ার। কিন্তু বুধবার রাতে শোনা গেল, ঋষভকে চারেই রেখে দিয়ে পাঁচে মণীশ বা শ্রেয়সকে খেলানো হতে পারে। যার অর্থ, কে এল রাহুলকে চার নম্বরে ব্যবহার না-ও করা হতে পারে। দল পরিচালন সমিতির একটা অংশের মত, রাহুলকে শুধু ওপেনার হিসেবেই ভাবা হোক। এখানকার ব্যাটসম্যানকে ওখানে ঠেলে দেওয়ার এই অস্থায়ী নীতি এ বার বিসর্জন দেওয়া হোক। ছয় নম্বরে কেদার যাদবকে আরও এক বার সুযোগ দেওয়ার কথা উঠছে। যদিও কেন উঠছে, তার ব্যাখ্যা পাওয়া কঠিন।
গায়ানায় ঋষভের ইনিংস নিয়ে সকলের উচ্ছ্বাসের প্রধান কারণ, তাঁর পরিণত মনোভাবের ঝলক। ম্যাচ শেষ করে আসতে পেরেছেন তিনি। উল্টোপাল্টা শট খেলে উইকেট ছুড়ে দিয়ে আসেননি। অর্থাৎ কি না নতুন ‘ফিনিশার’-এর ধ্বনি। এত কালের সর্বসেরা ‘ফিনিশার’-কে মসনদচ্যূত করার দিকে এগোচ্ছে। অনুজ ঋষভের সেরা আদর্শ? অগ্রজ এম এস ধোনি।
ক্রিকেট সময়-সময় যেমন উদার, তেমনই নির্মমও!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy