সক্রেটিস: সৃষ্টির ব্রাজিল।
আটান্ন আর বাষট্টির বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিল দলে ছিলেন ওয়ালদির পেরেইরা। ফুটবল দুনিয়া যাঁকে চেনে ডিডি নামে। যাঁর ফ্রিকিক কী ভাবে ঝরা পাতার মতো গোঁত খেয়ে গোলে ঢুকে যেত তা নিয়ে এখনও গবেষণা চলে ফুটবল মহলে।
আটান্ন আর বাষট্টির বিশ্বকাপেই শক্তপোক্ত রুশ ফুটবলাররা মেরেধরেও আটকাতে পারেননি আর এক ব্রাজিলিয়ানকে। যাঁর ড্রিবল দেখে রুশ ডিফেন্ডাররা ম্যাচের হাফটাইমে কোচের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, “ও কি রক্ত-মাংসের না রবারে তৈরি?” তিনি গ্যারিঞ্চা।
ব্রাজিল ফুটবলের এই মন মাতানো চরিত্ররা কোথায়? পেলে, ডিডি, গ্যারিঞ্চা না হোন। জিকো, সক্রেটিস, ফালকাও অন্তত! নিদেনপক্ষে রোমারিও, রোনাল্ডো, রোনাল্ডিনহো! তাও তো নেই এখন স্কোলারির দলে।
পেলের দেশের ফুটবলের সেই রোম্যান্টিসিজম কি পশ্চিম আটলান্টিকের পার থেকে ধীরে ধীরে দূরে সরে যাচ্ছে? কোথায় সেই ছন্দময় ড্রিবল, পাস, স্পটকিক ব্রাজিলীয়দের নিজেদের ভাষায় যার নাম ‘জোগো বোনিতো’ (সুন্দর খেলা)। হারা, জেতা, ড্রয়ের বাইরেও যাদের ফুটবল গত অর্ধশতাব্দীতে মুঠো মুঠো বিনোদনের পশরা সাজিয়ে বসেছে প্রতিটি বিশ্বকাপের আসরে সেই স্বপ্নের ফেরিওয়ালা কোথায়?
ছাপ্পান্ন বছর আগে শক্তপোক্ত রুশরা কোবরা ট্যাকল নিয়েও ধারেকাছে ঘেঁষতে পারেননি গ্যারিঞ্চার। আর ২০১৪০-এ এসে নেইমাররা কাবু চিলি, কলম্বিয়ার মতো একই মহাদেশীয় (লাতিন আমেরিকান) ফুটবলারদের শরীরী ফুটবলের সামনেই।
তা হলে কি ফুটবল বিবর্তনের সরণিতে ব্রাজিলের সেই ‘জোগো বোনিতো’-এ মিউটেশন, তথা ক্রোমোজোমের জিনঘটিত সজ্জায় রাতারাতি স্থায়ী পরিবর্তন ঘটেছে? না হলে কাফু থেকে কার্লোস আলবার্তো পাহিরা চিলি-বধের পর থিয়াগো সিলভাদের আনন্দাশ্রু দেখে রুষ্ট হচ্ছেন কেন?
উত্তরে কারাকাস থেকে কিয়োসুসব জায়গার ফুটবলপ্রেমীদের বলতে ইচ্ছে করবে, শরীর, শরীর, তোমার মন নাই কুসুম-এর মতোই ব্রাজিল, ব্রাজিল, তোমার ফুটবলে হৃদয় নাই! ফ্রেড, হাল্কদের ফুটবলে আজও জেতা, হারা, ড্র, সবই রয়েছে, কিন্তু পুরনো সুগন্ধটা নেই। যা এই গ্রহের মানুষ শেষ দেখেছে বিরাশি, ছিয়াশির বিশ্বকাপে তেলে সান্তানার ব্রাজিল টিমে।
সেমিফাইনালে না গেলেও সেই ব্রাজিলের খেলা দেখে বিরাশির বিশ্বকাপে স্পেনের আর্জেন্তাইন কোচ কার্লোস কাপ্পা বলেছিলেন, “বলটা সেই এক দিক থেকেই আসবে অন্য দলের গোলের দিকে। ঢেউয়ের মতো তা আসতেই থাকবে। কখনও মাটিতে খরগোশের মতো লাফিয়ে লাফিয়ে। কখনও বা পাখির মতো হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে। যার হদিশ বিপক্ষ কিছুতেই পাবে না।” এখানেই শেষ নয়। দর্শকদের মধ্যে সেই ব্রাজিলীয় ফুটবলের আবেদন কী রকম তা জানাতে গিয়ে কাপ্পা বলেছিলেন, “আমরা গ্যালারিতে বসে তখন ঘড়ির দিকে চোখ রেখে হতাশ হতাম। কারণ ওই সুন্দর ফুটবলটা অনন্ত সময় ধরেই যে দেখতে চাইতাম আমরা।”
গুস্তাভো: ধ্বংসের ব্রাজিল।
তিন বছর আগে বিশ্ব ক্লাব কাপে ব্রাজিলের সান্তোসকে চূর্ণ করে বার্সেলোনার তিকিতাকা খ্যাত তৎকালীন কোচ পেপ গুয়ার্দিওলা বলেছিলেন, “মাঠে আমরা সে ভাবেই বল নিয়ে এগোচ্ছি। যে ভাবে আমার দাদু ব্রাজিলকে বল নিয়ে এগোতে দেখতেন।”
ব্রাজিল ফুটবলের সেই বসন্ত গ্রাস করে নিল কে? ফুটবল বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশটার অর্থনীতি। তাঁদের বিশ্লেষণে যে দিন থেকে ব্রাজিলের ফুটবলাররা ঝাঁকে ঝাঁকে অর্থ উপার্জনে বেরিয়ে পড়লেন ইউরোপের পথে, সে দিন থেকেই ছুটির ঘণ্টা বেজে গিয়েছে পেলের দেশের ফুটবল-রোম্যান্টিসিজমের। আরও একটা গভীর ব্যাখ্যা আছে। সৃষ্টির পাশাপাশি সেন্ট্রাল মিডিওদের রক্ষণের সামনে আরও বেশি করে প্রাচীরও তুলতে হবে। যে দর্শন আষ্টেপৃষ্ঠে আঁকড়ে ধরেছে লাজারোনি থেকে আজকের স্কোলারিকে। তাই নব্বইয়ের বিশ্বকাপে সেবাস্তিয়াও লাজারোনি গ্লাসনস্ত, পেরেস্ত্রৈকার মতো ব্রাজিল ফুটবলে আমদানি করলেন সুইপার ব্যাক। আর ব্রাজিলও হারাল তার নিজস্বতা। যুক্তি উঠে এল, বিরাশিতে জোগো বোনিতো দেখিয়ে তো কাপ আসেনি। সাবধানী ফুটবলে অসুবিধা কোথায়? যদি সেটায় কাপ আসে! চাকরি বাঁচানোর জন্য যে মতবাদে অক্লেশে ছাপ মেরে গিয়েছেন একের পর এক নাম করা ব্রাজিলীয় সব কোচ।
এ রকম দিন যে তাঁর দেশের ফুটবলে আসতে চলেছেন তা বোধহয় বুঝতে পেরেছিলেন জিজিনহো। ১৯৫০-এর বিশ্বকাপে মারাকানাকে স্তব্ধ করে ফাইনালে পরাজিত ব্রাজিল দলের সদস্য। পেলের আদর্শ ফুটবলার দেওয়াল লিখনটা বোধহয় পড়ে ফেলেছিলেন আগেভাগেই। আশির দশকের মাঝামাঝি আত্মজীবনীতে তিনি লিখে গিয়েছিলেন সতর্কবার্তাটা। “সেন্ট্রাল মিডফিল্ডারের উপর টিমের সত্তর শতাংশ বল পজেশনের দায়িত্ব থাকে। আর আমরা তাকে দলের আক্রমণ গড়ার মুভ তৈরির বদলে বিপক্ষের আক্রমণ ভাঙার দায়িত্ব দিচ্ছি।”
টেকনিক্যালি এটাই ব্রাজিলের ফুটবল জৌলুস ফিকে হওয়ার কারণ বলে মনে করেন বেশির ভাগ বিশেষজ্ঞ। গারসন, সক্রেটিসের মতো শিল্পী ফুটবলারের বদলে তাই ব্রাজিলের মাঝমাঠের দায়িত্ব হাতবদল হয়েছে দুঙ্গা, ফেলিপে মেলো, লুই গুস্তাভো, ফার্নান্দিনহোদের কাছে।
পেলের কথায়, একদা ব্রাজিলীয়রা ফুটবল খেলত হৃদয় দিয়ে। আর ইউরোপের ফুটবলারা খেলত মস্তিষ্ক দিয়ে। ২০১৪-এ দাঁড়িয়ে কথাটা একটু অদলবদল করে নিতে হবে।
ব্রাজিলের ফুটবলেও এখন হৃদয় কম। মস্তিষ্ক বেশি। যে মস্তিষ্কে সৃষ্টির চেয়ে ধ্বংসের প্রবণতা বেশি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy