বার্ধক্যের দিকে এগিয়ে চলার গতিতে কি এ বার লাগাম পরাতে পারবে টিকাই? -ফাইল ছবি।
ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় অভিনীত 'আশিতে আসিও না' ছবির কাহিনি মনে পড়ে যেতে পারে। বার্ধক্য রুখতে মানুষের আকুলতা ছিল ১৯৬৭ সালের সেই ছবির উপজীব্য। কিন্তু প্রাণীজগতের অমোঘ সত্য যে জরা, সে কথা কিন্তু সেই কল্পকাহিনিও স্বীকার করেছিল।
কিন্তু অনিবার্য বার্ধক্যকে কি এ বার রুখে দেওয়া সম্ভব হবে, টিকার জাদুমন্ত্রে?
বয়সে আর জবুথবু হয়ে পড়তে হবে না? হয়ে পড়তে হবে না জরাগ্রস্ত? সারানো যাবে বয়সজনিত নানা ধরনের জটিল রোগ, শুধুই টিকার কেরামতিতে?
ওষুধবিষুধ নয়। বার্ধক্যের দিকে এগিয়ে চলার গতিতে কি এ বার লাগাম পরাতে পারবে টিকাই?
ইঁদুরের উপর একটি টিকার সফল পরীক্ষা সেই সম্ভাবনারই দরজা খুলে দিল।
বিশেষজ্ঞদের একাংশ বলছেন, ‘‘মানুষের উপর সফল হলে এই টিকা একটি নতুন দিগন্ত খুলে দেবে। যার জন্য মানুষ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সভ্যতা আধুনিক হয়ে ওঠার আগে থেকেই।’’
আমেরিকার ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব এজিং (এনআইএ)’-এর বিজ্ঞানীদের ইঁদুরের উপর চালানো পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান গবেষণা পত্রিকা ‘নেচার এজিং’-এ। গত ১০ ডিসেম্বর।
টিকায় বার্ধক্য রুখে দেওয়া গিয়েছে
গবেষণাপত্রটি জানিয়েছে, পরীক্ষায় সফল টিকাটি ইঁদুরের শরীর থেকে বুড়োটে, অথর্ব হয়ে পড়া কোষগুলিকে সরিয়ে দিতে পেরেছে। তার ফলে, ইঁদুরের আয়ু বেড়েছে। তাদের বার্ধক্যজনিত অনেক রোগ পুরোপুরি সেরেও গিয়েছে।
মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অন দ্য বায়োলজি অব এজিং অ্যান্ড মেটাবলিজমের সহকারী অধিকর্তা অধ্যাপক পল রবিন্স বলেছেন, ‘‘অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য গবেষণা। গবেষকরা যে পথ ধরে এগিয়েছেন তাতে তাত্ত্বিক ভাবে এই টিকার পরীক্ষা মানুষের উপরেও সফল হওয়া উচিত। তবে মানুষের আগে আরও কয়েকটি মনুষ্যেতর স্তন্যপায়ীর উপর এই পরীক্ষা চালিয়ে দেখা উচিত।’’
টিকার লক্ষ্য দেহের কোন কোষগুলি, কেন?
টিকা বানাতে ইঁদুরের কোন ধরনের কোষগুলির উপর নজর রেখেছিলেন গবেষকরা?
এনআইএ জানিয়েছে, সেনেসেন্ট কোষ। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অত্যধিক চাপে বা অন্য কোনও ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ফলে এই কোষগুলির স্থিতিস্থাপকতা (‘ইলাস্টিসিটি’) পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যায়। তখন কোষগুলির আর বিভাজন হয় না। কিন্তু তারা মরেও যায় না। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই সেনসেন্ট কোষের সংখ্যা বাড়তে থাকে। দেহে জমতে থাকে দ্রুত। এই কোষগুলির ‘পাহাড়’ সরানো তখন অসম্ভব হয়ে পড়ে দেহের স্বাভাবিক প্রতিরোধ ব্যবস্থার কোষগুলির পক্ষে।
জমতে জমতে শুধুই যে পাহাড় হয়ে ওঠে তা-ই নয়। এই সেনেসেন্ট কোষগুলি থেকে এক ধরনের যৌগের ক্ষরণ হয়। যা নানা ধরনের প্রদাহ (‘ইনফ্ল্যামেশন’) সৃষ্টি করে। তার ফলে, সেনেসেন্ট কোষগুলির আশপাশে থাকা সুস্থ সবল কোষগুলির প্রচুর ক্ষতি হয়। এর আগে বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গিয়েছে, শরীরে এই সেনেসেন্ট কোষগুলির বাড়-বৃদ্ধির জন্যই ক্যানসার, অ্যালঝাইমার্স এবং স্ক্লেরোসিসের মতো বার্ধক্যজনিত নানা জটিল রোগের সূত্রপাত হয়। ধমনীতে রক্ত চলাচল থমকে যায় সামনে বাধার দেওয়াল (‘আর্টারি প্লেক্স’) তৈরি হয়ে যাওয়ায়। এগুলি সারানো আর সম্ভব হয় না।
ওষুধের চেয়ে টিকা কেন হতে পারে বেশি কার্যকরী?
সেনেসেন্ট কোষগুলিকে সরানোর জন্য নানা ধরনের ওষুধ আবিষ্কারের চেষ্টা গত এক দশক ধরেই চলছে। তাদের কোনও কোনওটি এখন হিউম্যান ট্রায়ালে রয়েছে।
রবিন্স বলেছেন, ‘‘তবে ওই সব ওষুধের চেয়ে টিকার কার্যকারিতা অনেক বেশি হবে বলেই আশা করছি। কারণ, ওষুধ তো ব্যবহৃত হবে দেহে সেনেসেন্ট কোষ জমতে জমতে পাহাড়ে পরিণত হওয়ার পর। তখন অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। দেহের সুস্থ কোষগুলির ততক্ষণে অনেকটাই ক্ষতি হয়ে গিয়েছে। আরও দুর্বল হয়ে পড়েছে প্রতিরোধ ব্যবস্থার কোষগুলিও। কিন্তু ৫০ বছর বয়স হলেই যদি এই টিকা দেওয়া সম্ভব হয়, তা হলে শরীরে এই সেনেসেন্ট কোষ গড়েই উঠতে পারবে না। জমতে জমতে পাহাড় হয়ে ওঠা তো অনেক দূরের কথা। টিকা দিয়ে প্রতিরোধ ব্যবস্থার কোষগুলিকে এমন ভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া যাবে যাতে সেনেসেন্ট কোষ তৈরি হচ্ছে দেখলেই তারা তাদের নিকেশ করে দিতে পারে।’’
সমস্যা কোথায়?
কিন্তু সমস্যাটা অন্যত্র। এই সেনেসেন্ট কোষগুলি দেহের সর্বত্রই তৈরি হয়। এক জায়গার সেনেসেন্ট কোষের সঙ্গে দেহের অন্য জায়গার সেনেসেন্ট কোষের আচার-আচরণে মিলও থাকে না।
গবেষকরা একটি বিশেষ ধরনের সেনেসেন্ট কোষের উপর নজর রেখেছিলেন। যেগুলি তৈরি হয় ধমনী, শিরা ও রক্তজালিকার একেবারে ভিতরের দিকে থাকা এন্ডোথেলিয়াল কোষগুলিতে। এগুলিকে বলা হয়— সেনেসেন্ট ভাসক্যুলার এন্ডোথেলিয়াল কোষ।
গবেষকরা কী খুঁজেছিলেন? কেন?
তার পর তাঁরা খুঁজে বার করেন সেই কোষগুলির উপরের স্তরে কোন প্রোটিনটিকে বেশি পরিমাণে দেখা যাচ্ছে। কারণ, গবেষকরা চেয়েছিলেন সেই প্রোটিনটিকেই তাঁদের বানানো টিকার লক্ষ্যবস্তু করতে।
গবেষকরা তেমন একটি প্রোটিন খুঁজে পান। যার নাম— ‘গ্লাইকোপ্রোটিন ননমেটাস্ট্যাটিক মেলানোমা প্রোটিন বি ’ (জিপিএনএমবি)। বার্ধক্যজনিত বেশ কয়েকটি জটিল রোগ, মেলানোমা-সহ কয়েক ধরনের ক্যানসারের ক্ষেত্রে এই প্রোটিনটিকে বেশি পরিমাণে সেনেসেন্ট কোষে জমতে দেখা যায়।
মানব দেহকোষ নিয়ে পরীক্ষা চালিয়েও গবেষকরা দেখেছেন, এই প্রোটিনটি স্ক্লেরোসিস রোগীদের সেনেসেন্ট কোষে অনেক বেশি পরিমাণে দেখা যায়। এই প্রোটিনের পরিমাণ বৃদ্ধির জন্যই বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ধমনীতে রক্ত সংবহন বাধাপ্রাপ্ত হয়।
পরীক্ষাটি চালানো হয় মধ্যবয়সি ইঁদুরের উপর, যাতে তাদের বার্ধক্য ও বার্ধক্যজনিত রোগের গতিতে লাগাম পরানো সম্ভব হচ্ছে কি না বোঝা যায়। দেখা গিয়েছে, টিকা ৯৫ শতাংশ সফল হয়েছে ইঁদুরের ক্ষেত্রে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy