এই সেই অ্যাবেল-২২৬১ গ্যালাক্সি। যার কেন্দ্রস্থল থেকে বেমালুম উধাও হয়ে গিয়েছে মহারাক্ষস। ছবি- নাসার সৌজন্যে।
মহাদৈত্যাকার একটি ব্ল্যাক হোল কোথায় যেন উধাও হয়ে গিয়েছে। বিলকুল হাপিশ!
গেল কোথায়, গেল কোথায়, রব উঠেছে বিশ্বজুড়ে। চলছে জোর তল্লাশি। কিন্তু কিছুতেই সেই মহাদৈত্যাকার ব্ল্যাক হোলের টিকির হদিশও মিলছে না।
‘হারানো প্রাপ্তি নিরুদ্দেশ’-এর বিজ্ঞাপন দিয়েও খোঁজ মিলছে না সেই মহাদৈত্যের!
পোস্টম্যানের মিসিং ডায়েরি!
এক দশক আগে প্রথম ‘মিসিং ডায়েরি’ করেছিলেন মেরিল্যান্ডের বাল্টিমোরে ‘স্পেস টেলিস্কোপ সায়েন্স ইনস্টিটিউট (সেটি)’-র জ্যোতির্বিজ্ঞানী মার্ক পোস্টম্যান। একটি আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান-জার্নালে প্রকাশিত তাঁর গবেষণাপত্রে। করার পর ২০১২ থেকে সেই ভাবে পড়েই ছিল ‘মিসিং ডায়েরি’টি। নিখোঁজ মহাদৈত্যের হদিশ দিতে পারেননি কেউই। তদন্ত, খোঁজাখুঁজির প্রক্রিয়া কিছুটা যেন ধামাচাপাই পড়ে গিয়েছিল। বিজ্ঞান-জার্নাল ‘অ্যাস্ট্রোফিজিক্যাল জার্নাল’-এ খুব সম্প্রতি প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্র ফের সেই তল্লাশি শুরু করল।
মিল্কি ওয়ের ১০ গুণ অ্যাবেল-২২৬১ গ্যালাক্সি
হাব্ল স্পেস টেলিস্কোপ (এইচএসটি) দিয়ে ব্রহ্মাণ্ডে গ্যালাক্সির ঝাঁক (‘গ্যালাক্সি ক্লাস্টার’)-গুলিকে দেখতে গিয়েই এমন একটি মহাদৈত্যাকার (‘সুপারজায়ান্ট’) গ্যালাক্সির খোঁজ পেয়েছিলেন পোস্টম্যান। তার নাম- ‘অ্যাবেল-২২৬১’। আকারে যা আমাদের মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সির চেয়ে ১০ গুণ বড়। আরও একটি পোশাকি নাম রয়েছে তার। ‘এ২২৬১-বিসিজি’।
তিনি দেখেছিলেন, ওই গ্যালাক্সির ঝাঁকে এই অ্যাবেল-২২৬১ গ্যালাক্সিটিই উজ্জ্বলতম।
প্রতিটি গ্যালাক্সিরই একেবারে কেন্দ্রস্থলে থাকে একটি দৈত্যাকার মহারাক্ষস। আর সেই কেন্দ্রস্থলে থাকা ব্ল্যাক হোলটি গ্যালাক্সির মধ্যে তার কাছেপিঠে থাকা তারাগুলিকে গপাপপ গিলে খায়। গোগ্রাসে। সেই খাওয়ার সময় দু’ধরনের আলোকতরঙ্গ বেরিয়ে আসে কোনও গ্যালাক্সির কেন্দ্রস্থল থেকে। এক্স-রে আর রেডিও জেট। এদের জন্যই কোনও গ্যালাক্সির কেন্দ্রস্থলটি হয়ে ওঠে আলোকোজ্জ্বল। আর সেই আলোর হদিশ মিললেই বোঝা যায়, গ্যালাক্সির কেন্দ্রে রয়েছে সেই মহারাক্ষস।
ঘুটঘুটে অন্ধকার সেই গ্যালাক্সির কেন্দ্রস্থলে!
পোস্টম্যান দেখেছিলেন, অত উজ্জ্বল একটা গ্যালাক্সি, অথচ তার কেন্দ্রস্থলে বিন্দুমাত্র আলো নেই। বলা ভাল, একেবারে ঘুটঘুটে অন্ধকার। এটা কী ভাবে হল, এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়েই পোস্টম্যান দেখেছিলেন গ্যালাক্সির কেন্দ্রস্থলে যে মহারাক্ষস (‘সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাক হোল’)-টার থাকার কথা, অ্যাবেল-২২৬১ গ্যালাক্সির কেন্দ্রস্থল থেকে সেটা বেমালুম উধাও হয়ে গিয়েছে।
পোস্টম্যানের ‘পোস্ট’-এর পর শোরগোল হয়েছিল ঠিকই। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। নাগালের বাইরেই থেকে গিয়েছিল সেই নিখোঁজ মহারাক্ষস।
মহারাক্ষস নিখোঁজ এখনও, ফের শুরু তল্লাশি
কোথায় গেল? অ্যাবেল-২২৬১ গ্যালাক্সির কেন্দ্রস্থল থেকে কী ভাবে বেমালুম উধাও হয়ে গেল সেই মহারাক্ষস?
সাম্প্রতিক গবেষণাপত্রটিতে ফের তার খোঁজতল্লাশি শুরু হয়েছে।
কলকাতার ‘ইন্ডিয়ান সেন্টার ফর স্পেস ফিজিক্স (আইসিএসপি)’-র অধিকর্তা অধ্যাপক সন্দীপ চক্রবর্তী বলছেন, ‘‘গবেষণাপত্রটিতে দু’ধরনের সম্ভাবনার কথা বলা হয়েছে। তবে কোনটি সঠিক সে ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারেননি গবেষকরা। তাই নিখোঁজ মহারাক্ষসেরও হালহদিশ জানাতে পারেননি তাঁরা।’’
প্রথম সম্ভাবনা
গ্যালাক্সির কেন্দ্রস্থলে থাকা অসম্ভব খাই খাই স্বভাবের মহারাক্ষস সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাক হোলটি খাবারদাবার না পেয়ে একেবারেই মনমরা হয়ে গিয়েছে! গ্যালাক্সি তৈরি হওয়ার পর তার আশপাশে যত তারা আর গ্যাস ছিল, সেই সব গোগ্রাসে চেটেপুটে খেয়ে গায়েগতরে বেড়ে উঠে সে হয়ে উঠেছিল মহারাক্ষস। কিন্তু এখন আর তার ধারে-কাছে কোনও তারা বা ততটা গ্যাস নেই। তাই তার খাওয়ার চাহিদা মিটছে না।
কতটা খাওয়ার চাহিদা তার?
সন্দীপের কথায়, ‘‘আমাদের মিল্কি ওয়ের কেন্দ্রস্থলেও যে মহারাক্ষসটি (‘স্যাজিটারিয়া-এ*’) রয়েছে সেটিও রয়েছে কার্যত অনাহারেই। বছরে ২০০০টি পৃথিবীর মতো ওজনের খাবারদাবার প্রয়োজন তার। অথচ, এখন পাচ্ছে বছরে বড়জোর ২/৩টি পৃথিবীর মতো ওজনের খাবারদাবার। একই হাল অ্যাবেল-২২৬১ গ্যালাক্সির কেন্দ্রস্থলে থাকা মহারাক্ষসটিরও। দরকার তার বছরে সূর্যের সমান ওজনের অন্তত ২০টি তারা। অথচ পাচ্ছে এখন থখুব বেশি হলে ২টি কি ৩টি। তার নাগপাশে এসে পড়ছে না তারা, গ্যাস। তার খাবারদাবার। তাই এক্স-রে আর রেডিও জেটও বেরিয়ে আসছে না। অ্যাবেল-২২৬১ গ্যালাক্সির কেন্দ্রস্থলটিতে সেই কারণেই হতে পারে ঘুটঘুটে অন্ধকার।’’
দ্বিতীয় সম্ভাবনা
অ্যাবেল-২২৬১ গ্যালাক্সিটি সুবিশাল। এটি একটি উপবৃত্তাকার (‘ইলিপ্টিক্যাল’) গ্যালাক্সি। তার মানে, দু’টি স্পাইরাল গ্যালাক্সির মধ্যে সুদূর অতীতে ধাক্কাধাক্কির ফলেই এই সুবিশাল গ্যালাক্সিটির জন্ম হয়েছিল। ফলে, দু’টি গ্যালাক্সির কেন্দ্রস্থলে থাকা দু’টি দৈত্যাকার মহারাক্ষসও খুব ঘেঁষাঘেষি করে কাছে এসে পড়েছিল।
সন্দীপের কথায়, ‘‘দু’টি মহারাক্ষস খুব ঘেঁষাঘেষি করে থাকতে পারে। হয়তো সে জন্যই আলাদা করে কোনও একটিকেও দেখা যাচ্ছে না। কিছুটা দূরে থাকলে একটির খোঁজ না মিললেও সে ক্ষেত্রে অন্যটিকে হয়তো দেখা যেত।’’
নিজেদের বিপদ বাড়িয়েছে মহারাক্ষসরাই?
সন্দীপ জানাচ্ছেন, এই ঘেঁষাঘেঁষি করতে গিয়েই নিজেদের বিপদ বাড়িয়েছে দু’টি মহারাক্ষস। নিজেদের কাছেপিঠে থাকা গ্যাস আর তারাদের গোগ্রাসে খেয়েই তারা গায়েগতরে মহারাক্ষস হয়ে উঠেছিল। কিন্তু এখন ঘেঁষাঘেঁষি করে থাকতে গিয়ে আশপাশের তারাগুলিকে ‘লাথি’ মেরে তারা অনেক দূরে ঠেলে দিয়েছে।
‘‘ফলে, এখন যতটা খাওয়া প্রয়োজন সেই মতো আর খাবারদাবার পাচ্ছে না দু’টি মহারাক্ষসই। তাই তারা দু’জনেই মনমরা হয়ে থাকতে পারে। হতেই পারে সেই কারণেই অ্যাবেল-২২৬১ গ্যালাক্সির কেন্দ্রস্থলটিতে তাই এতটাই ঘুটঘুটে অন্ধকার’’, বলছেন সন্দীপ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সব সম্ভাবনার রাস্তা ধরে এগোলে আগামী দিনে নিখোঁজ মহারাক্ষসের খোঁজ মিললেও মিলতে পারে। না পেলেও, অন্তত এইটুকু জানা যেতেই পারে, কী ভাবে তারা উধাও হয়ে গিয়েছিল? এখনও কেন নাগালের বাইরেই থেকে গিয়েছে আমাদের?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy